সৈয়দ আশরাফের স্ত্রীর মৃত্যু এবং যোগাযোগ মাধ্যম
ঢাকা থেকে একজন সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে ইনবক্স করেছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী মারা গেছেন না-কি? ব্রিটেনে থেকেও তাকে আমি সে কথাটার তাৎক্ষণিক কোন উত্তর দিতে পারি নি। সাথে সাথে ফোন দিয়েছিলাম চ্যানেল আই লন্ডনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সতীর্থ বন্ধু রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সোয়েবকে। তিনিও জানেন না। মারা গেলেতো জানবেন। এরপরে ফোন করি লন্ডনে সৈয়দ আশরাফের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত একসময়ের যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাব উদ্দিন চঞ্চল কে। তিনিও ফোন ধরেননি।
পরে তাকে টেক্সট পাঠিয়েছিলাম। চঞ্চল আমার এলাকার মানুষ, একসময় সাংবাদিকতা করতেন লন্ডনে। তিনি তখন লিখলেন, আমি হাসপাতালে, সৈয়দ আশরাফের সাথেই আছি। তবে অবস্থা সংকটাপন্ন। অথচ এর আগে ফেসবুকে দেখেছি, লন্ডনের কেউ কেউ এমনকি বাংলাদেশের ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, কোথা থেকে যে এটা আবিষ্কার করলেন, ইন্নালিল্লাহি পড়লেন এবং শিলা ইসলামকে শেষ যাত্রায় পাঠিয়ে দিলেন। যদিও তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরের দিন অর্থাৎ ২৩ অক্টোবর।
সৈয়দ আশরাফের স্ত্রী তখনও জীবিত আছেন। কিন্তু চাউর হয়ে গেলো তিনি মারা গেছেন। সংকটজনক অবস্থা এবং মৃত্যু দুটোতো পৃথক সংবাদ। কিন্তু এই পৃথক সংবাদটি আমাদের অতি উৎসাহী একটা অংশ মেনে নিতে পারে না। তারা নিউজ তৈরি করতে চায়। কার আগে কে নিউজ দিয়ে চমক দেবে, সেই অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে একজন মানুষকে কল্পনায় মেরে ফেলতে তারা দ্বিধা করে না। তারা খবরের পেছনের খবর যোগাড় করতে গিয়ে জেতা মানুষকে মেরে ফেলেন। শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া মানুষটিকে করে ফেলেন স্পন্দনহীন, মৃত।
লন্ডনে চিকিৎসাধীন ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হককেও নিয়ে এভাবেই কেউ কেউ খেলায় মেতে উঠতে চাইছিলেন। যা হয়েছিলো প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রেও। অথচ যারা এটা করে, তারা কি এটা জানে না, আসলে খবরের পেছনের খবর এগুলো নয়। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে এই খবরগুলো মূলত অজ্ঞতার এবং অজ্ঞানতার। পাঠকদের একটা অন্ধকার আবহের মাঝে সাময়িক সময় তারা আবদ্ধ করে রাখতে চায় । তারা মুমূর্ষু মানুষের স্বজনদের নিদারুণ দীর্ঘশ্বাসের সাথে মসকারা করে।
এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে, আসলে শুধুই কি সংবাদ পাঠকদের পৌঁছে দেয়ার জন্যে তারা এই কাজটা করে? এ প্রশ্নটা আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এখানেও আছে রাজনৈতিক চাটুকারিতার একটা নষ্ট প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুখ-দুঃখে কে কত এগিয়ে আসতে পারলো তা নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতাটা তারা শুরুই করে পরবর্তীতে গুরুর সান্নিধ্য পেতে। কিন্তু সৈয়দ আশরাফের মতো নিখাদ একজন ভালো মানুষের পিছে চাটুকারিতা করে আসলে লাভের লাভ কিছু হবার নয়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের যে মানুষটার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় এগোয়, সেখানে চাটুকারদের কিছু পাবার নেই। যারা এরকম সংবাদ তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন, তারা কোন না কোনভাবে বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই এটা করে থাকেন। নিশ্চয়ই সংবাদকে পাঠকের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে দেবার জন্যে করে না। আর এসব এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ভালো ভালো সাংবাদিকেরা পর্যন্ত কোন কোন ক্ষেত্রে এই ধারায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন। তারা অবশ্য মন্ত্রী আর নেতা-পাতি নেতা কিংবা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের মৃত্যু নিয়ে নিউজ বানাতে চান না, কারণ এটা চাটুকার বশংবদরা করে। তাই খ্যাতিমানরা ‘ইনসাইড’ খোঁজেন। তাইতো আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, ঐ ‘ইনসাইডাররা’ প্রধানমন্ত্রীকে না মেরে তারা তাঁকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনেন। যদিও এটা তাদের জন্যে বুমেরাং হয়েছিলো।
এরকম খবরে স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এই ‘ভেতর খোঁজা’ বোদ্ধারা সরকারের শুধুই চাকচিক্য দেখেন চারদিকে। সরকারের অভ্যন্তরে জমে থাকা আবর্জনার সমালোচনাকেও তারা বিরোধিতা হিসেবে দেখেন কিংবা অন্য দলের দালালী হিসেবে বিবেচনায় নেন, কিংবা ঐ ‘দালাল’দের চিহ্নিত করতে উঠেপড়ে লাগেন।
ইদানিং লক্ষ্য করা গেছে, শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতা কিংবা নেতা-নেত্রীর ঘনিষ্ঠজন, মা-বাবা এদের নিয়ে এরা লম্বা লম্বা স্ট্যাটাস দেন দলীয় কিছু চেলা-চামুন্ডারা। এমন বশংবদ চাটুকারও দেখা গেছে, নেতা যেখানে তার মাতা কিংবা পিতাকে স্মরণ করতে পারছেন না, অর্থাৎ সেই শিশুবেলায় মা কিংবা পিতা তাকে ছেড়ে চলে গেছেন, সেই মায়ের জন্যে একেকজন বশংবদ চাটুকারের বিলাপ কিংবা শোকগাথা। মাসির না হয় দরদ থাকতেই পারে, কিন্তু এখন পালিত মাসতুত ভাইদের পোয়াবারো।
সৈয়দ আশরাফ লন্ডন ছিলেন, তিনি ব্রিটেনের স্থায়ী বাসিন্দাও। তাঁর স্ত্রী শিলা ভারতীয় বংশোদ্ভুত। বিবাহ পরবর্তী কোন কোন নারী তার নামের পরে স্বামীর পারিবারিক নাম ব্যবহার করেন। যদি শিলা এটা করে থাকেন, তাহলে তিনি শিলা ইসলাম। শিলা যা-ই করেন না কেন, শিলার একটা নিজস্ব পরিচিতিও আছে এই লন্ডনে। তিনি বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্যে কাজ করেছেন। যে সময় মেয়েরা শুধুই ছিলেন গৃহিনী, সেসময় হাতেগোনা যে ক’জন নারী বাঙালি নারীদের জন্যে কাজ করেছেন, তার মাঝে একজন শিলা। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত, অথচ কাজ করেছেন অকাতরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্যে। তার স্বামী বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রধান দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব ছিলেন একসময়। অথচ শিলা ছিলেন এসব কিছুরই ঊর্ধ্বে।
বাংলাদেশি ক্ষমতাসীনদের গায়ে গায়ে লেগে থেকে লন্ডনের দলের, সরকারের ‘ভাই-দাদা-লিডার’ ভাবার একটা হম্বিতম্বি ভাব আছে কারো কারো, সত্যি কথা হলো কেউ কেউ হয়ত এই হম্বিতম্বি দিয়ে দেশেও একটা অবস্থান করে নিয়েছেন কিংবা নেবার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অথচ শিলার ইমেজ ছিলো, ছিলো তার স্বামীর ব্যাপক ক্ষমতা, কিন্তু তিনি চাকরী করতেন, মেয়ে দেখাশোনা করতেন। এবং বাংলাদেশের সংকটজনক সময়ে সৈয়দ আশরাফকে বাংলাদেশে চলে যেতে, সেখানে অবস্থান করে তার দেশ আর দলের জন্যে কাজ করতে কোনই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতো করেননি, বরং সহায়তাই করে গেছেন। মিডিয়ায় এগুলোই আসা উচিৎ। যে কোন মানুষের মৃত্যুটা চিরন্তন। কিন্তু কিছু মানুষ মুত্যুর পরও কর্মে বেঁচে থাকেন। সেভাবেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে। শিলা এভাবেই বেঁচে থাকবেন।
শিলা’র মৃত্যু সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে তার জীবনের একটা বিরাট ক্ষত। তাদের মেয়ের জন্যে এক অপরিসীম শূন্যতা। তবুও সৈয়দ আশরাফকে দেশ আর দল নিয়ে কাজ করতে হবে। শূন্যতা নিয়েই তাদের মেয়েও এগিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক, জীবনের পথচলা। এই ক্ষত কিংবা শূন্যতার মাঝে প্রহসন করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরেট কান্ডজ্ঞানহীন এই মানুষগুলো। সেজন্যেই হয়ত তার শেষ সময়ের নিউজ কিংবা প্রচারণা বাংলাভাষী পাঠকদের একটা নতুন ভাবনাও দিয়ে গেলো। কিছু কিছু গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী কথিত সাংবাদিকদের সংবাদ কিংবা তথ্য গ্রহণ-বর্জন করতে অর্থাৎ যাচাই-বাছাই করার নতুন একটা দায়িত্ব এসে গেলো আবারও আমাদের ওপর। একইসাথে চাটুকার দুর্বৃত্তদেরও চিহ্নিত করার ব্যাপারটাও নতুন করে ভাবনায় রাখারও ইঙ্গিত দিলো। এটা আমাদের ভাবতে হবে। প্রয়োজনে শিখতে হবে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম