ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এবং রোহিঙ্গা ইস্যু

ফারুক যোশী | প্রকাশিত: ০৪:২১ এএম, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

আট বছর আগে একইভাবে গিয়েছিলাম ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে। যেহেতু ইউরোপের বিভিন্ন দেশের এমইপিরা তাদের নিজস্ব কৌটায় বছরে দু’তিনটা ফ্রি ট্রিপ করতে পারেন, সেই সুযোগটাই নিয়েছি আমরা। লেবার পার্টির হয়ে এবারের যাত্রায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এমইপি ওয়াজেদ খান। বয়সে তরুণ, ব্রিটেনের বার্নলি এলাকার লেবার দলের নেতা তিনি। ম্যানচেষ্টার সিটি কাউন্সিলের তরুণ কাউন্সিলার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রভাবশালী লেবার নেতা লুৎফুর রহমানের উদ্যোগে এ ট্রিপটি আয়োজন করে তারা। আমাদের সহযাত্রী ছিলেন আরেক বাংলাদেশী কাউন্সিলার আফিয়া কামালসহ তিনজন কাউন্সিলার,কাউন্সিলের কর্মকর্তা এবং ওয়াজেদ খানের অফিস সহকারী। তাছাড়া ছিলেন লেবার দলের আরও চৌদ্দজন নেতা-কর্মী।

২) রায়ান এয়ারের যাত্রায় ম্যানচেষ্টার থেকে ফ্লাইট ছিলো সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে। একঘন্টার ব্যবধান ব্রিটেন আর ব্রাসেলস’র সময়ে। আমরা পৌঁছে যাই ব্রাসেলস’র বাইরে সারলে এয়ারপোর্টে, বেলজিয়াম সময় ১০টা ১৫ মিনিটে। কোচ কিংবা বাসে এয়ারপোর্ট থেকে ব্রাসেলস পার্লামেন্ট আরও প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানে এমইপি’র আয়োজনে তার সচিব আমাদের দায়িত্ব নেন। ম্যাট ব্রিটেনেরই এক তরুণ, বাস থেকে নেমে গেলেই ম্যাটের নেতৃত্বে আমাদের পথচলা। তাঁর সাথে আমাদের গাইড হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন তরুণী। পার্লামেন্টে ঢোকার পথের বিশাল এলাকায় বিল্ডিং এর উপরের দিকে তাকালেই পৃথিবীর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য মানুষ, ধর্মীয় নেতা পোপ থেকে শুরু করে আন্দোলন-সংগ্রামের দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের কিছু নেতাদের ছবি, শরণার্থীদের ছবি, সভা-সমাবেশের ছবি, সেখানে শোভা পাচ্ছে।

গত বারে যখন গিয়েছিলাম দেখছিলাম, অং সান সু চির ছবি। শান্তি প্রতিষ্ঠা আর তথাকথিক গণতন্ত্রের সংগ্রামী সূ চি কে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের জেনোসাইডের প্রধান রুপকার সু চির ছবি নেই এখন। এর আগেই আমাদের সিকিউরিটি চেক শেষে ভিজিটার ব্যাজ দিয়ে দেয়া হয়েছে। পার্লামেন্টের প্রধান দালানে ঢোকছি, চকচকে গ্লাসের ভেতরেই দেখা যাচ্ছে দু’একটি অফিসের কার্যক্রম চলছে। আমরা পাশ দিয়ে হাঁটছি, আমরাই আমাদেরকে দেখছি ক্যামেরায়, টিভি স্ক্রিনে। গোলাকার একটা দেয়ালে যেন কয়েকটা টিভি রাখা, আমাদের হাতের কাছেই রাখা ঐ টিভিগুলোতে আমরাই আমাদের গতিবিধি দেখছি, দেখা যাচ্ছে অন্য কক্ষের মিটিং এবং মানুষের হাঁটাচলা। এমইপি এসে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। পার্লামেন্টের ভেতরেই সারতে হয় বিশাল আয়োজনের মধ্যাহ্ন ভোজ। তারপর শুরু হয় ভিজিট পর্ব।

৩) পার্লামেন্ট ভবনের কোন একটা নির্দিষ্ট কক্ষে আমাদের সাথে বৈঠকের আয়োজন করা হয় এমইপি’র সাথে। ওয়াজেদ খান এমইপি’ দাঁড়িয়ে-ই ছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন। একে একে সবার সাথে শুভেচ্ছ বিনিময় শেষে শুরু হলো তার সাথে আলাপচারতিা। এর আগে তার ব্যাপারে ম্যাট বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করেছেন আমাদের সাথে। বলেছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা নিয়ে ওয়াজেদ খান এমইপি’র অবস্থানের কথা। ম্যাটকে হয়ত আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদেরকে যেন ইনফর্ম করা হয়, রোহিঙ্গার ব্যাপারটা। কারণ রোহিঙ্গা নিয়েই যে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন এটা এখন বিশ্বের সবাই জানে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমরাও যে রোহিঙ্গা নিয়েই তাকে প্রশ্ন করতে পারি, তা যেন তিনি ধারণা করেই আছেন। ঘুরেফিরে তাই রোহিঙ্গা ইস্যুটাই প্রধান হলো। রোহিঙ্গা নিয়ে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তিনি কি উচ্চারণ করেছেন, তা নিয়ে কথা বললেন। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যূটিকে একটা জেনোসাইড হিসেবেই উল্লেখ করেছেন পার্লামেন্টে। এবং এ ব্যাপারে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট যাতে উদ্যোগ নেয় সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন।

এর আগে ম্যাট আমাদেরকে বলেছেন, তার এই উচ্চারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়া পড়েছে। প্রায় দেড় লাখ মানুষ টুইটার আর ফেসবুকে তার এই বক্তব্যের সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু আসলেই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোথায় দাাঁড়িয়ে আছে, ইইউ’র অবস্থান কি এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন সদুত্তর পাই নি আমরা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যেখানে ডিবেট অনুষ্ঠিত হচ্ছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ এমপি রোশনারা আলী যেখানে ব্রিটেনের দেয়া প্রশিক্ষণ মিয়ানমারে বন্ধ করে দিতে সার্থক ভূমিকা রাখছেন, সেখানে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কি এরকম কোন উদ্যোগ নিতে পারবে- এ প্রশ্ন তাকে করলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সদুত্তর দিতে পারেন নি। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কি এই মুহূর্তে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে, সে বিষয়ে তাকে যখন প্রশ্ন করি, তখন তার উত্তরটা রাজনীতিবিদদের মতোই। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট মনে করে মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থা এমন পর্যায়ে আছে যে, রোহিঙ্গাদের এখন ফিরিয়ে যাবার সময় নয় এটা। রাখাইন একটা শ্বাপদের জনপদ। সেখানে হিংস্র মানুষগুলো আক্রমণ করছে এবং সেজন্যেই তিনি মনে করেন রোহিঙ্গাদের আবাস নিরাপদ করতে আমাদের অনেক দেন-দরবার চালাতে হবে।

সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেয়া এখন এক অনেক দূরের ব্যাপার। অর্থাৎ প্রকারান্তরে সত্যটা হলো, জাতিসংঘসহ পৃথিবীর অন্যান্য সংস্থার মত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও রোহিঙ্গাদের আপাত সহায়তা দানে বড় অংকের একটা ফান্ড দেবে । স্বাভাবিকত্ব হলো এদের প্রত্যাবর্তনে কোনই ভূমিকা রাখতে পারবে না। আর আমাদের জন্যে সত্যটা হলো বাংলাদেশের কাঁধে যে বোঝা পড়ে গেছে, তা বইতে হবে হয়ত চিরটাকালই। বলতে গেলে এটাই বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতা।
৪) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একটা প্রতিনিধি দল আসছে বিবেচনায় রেখেই ব্রাসেলস এ নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহদাত হোসেনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এমইপি ওয়াজেদ খান। নির্ধারিত সময়ে এমইপি আমাদের নিয়ে বসতে পারলেও আমাদের শাহাদত হোসেন আসতে দেরি হচ্ছে দেখে এমইপি নিজেই বিব্রত হচ্ছিলেন। এবং বলছিলেন, কি একটা কাজে আটকা পড়েছেন,শিঘ্রই এসে পড়বেন। ১ ঘন্টা পনেরো মিনিটের এই সেশনে শাহাদত হোসেন আধা ঘন্টা দেরি করে আসলেও এমইপি তার ব্যাপারটাকে সহজ করিয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন সিরিয়াস আলাপচারিতার মধ্য দিয়েই। একসময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এলেন, মনে হলো খুব ব্যস্ত সিডিউলের মানুষ তিনি। শুরু করলেন তার আলোচনা।

ব্রিটেনে বেড়ে উঠা দুজন কাউন্সিলার যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কূটনৈতিক দেন-দরবারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেন ছাড়ছে না বাংলাদেশ’। রাষ্ট্রদূত সে কথার কি উত্তর দেবেন? স্বাভাবিকভাবেই কাউন্সিলারদের মনোপূত হয় নি তার উত্তর, আমরাও মাননীয় রাষ্ট্রদূতের কথায় সায় দিতে পারি নি। কারণ তিনি পারেননি একটা যুৎসই উত্তর দিতে। যখন রাখাইনে পুড়ছে গ্রাম, নিহত হচ্ছে মানুষ, লাখো লাখো মানুষ পাড়ি দিচ্ছে নাফ নদী, তখন মিয়ানমারের সাথে চাউল রাজনীতি কি যৌক্তিক, সে প্রশ্নের উত্তর তো ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বলেছি মিয়ানমারে জেনোসাইড হচ্ছে’ হতে পারে না। যদিও রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান বিশ্বের পর্যবেক্ষণ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মুখপাত্রের কাছ থেকেই শুনতে চেয়েছিলাম কিংবা ইউরোপের লক্ষ্যই শুনতে চাইছিলাম, এবং তা পেয়েছিও এমইপি’র কাছ থেকে।

৪) নির্ধারিত এ সেশন শেষে শুরু হয় পার্লামেন্টের মিউজিয়াম দেখা। ম্যাটকে সাথে নিয়েই আমরা হাঁটছি, ম্যাট দেখাচ্ছেন- পার্লামেন্টের বিভিন্ন জায়গায় বসিয়ে দেয়া বিভিন্ন কাঠের পাথরের মূর্তি, আর্ট দিয়ে সারা ইউরোপকে তোলে ধরার চেষ্টা চালানো হয়েছে পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত বিভিন্ন দেশের পতাকা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটা বিশাল করিডোর। পার্লামেন্টের ভেতরের একটা বিশাল ছবি টাঙ্গানো সেখানে, যার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় পার্লামেন্টের সামনেই বসে আছেন যে কেউ। আছে ইউরোপিয়ান বিভিন্ন ভাষার লেখা দিয়ে সাজানো দেয়াল। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে আবারও সময় বয়ে যায়। আরেকটা সেশনের সময় হয়। সেখানে আসেন নির্ধারিত আরো দুজন এমইপি- জুলি ওয়ার্ড ও তেরেসা গ্রিন। তারা মূলত আলোচনা করেন ব্রেক্সিট নিয়ে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে ভিন্ন নিবন্ধে আলোচনা করা যেতে পারে।

৫) ২০০৯ সালে যেদিন পার্লামেন্ট দেখার সুযোগ পাই, সেদিন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ছিলো উত্তপ্ত। ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) থেকে নির্বাচিত তখনকার সময়ের এমইপি উগ্র বর্ণবাদী নিক গ্রীফিন ঐ দিন পার্লামেন্টে উপস্থিত ছিলেন। তার বর্ণবাদী আচরণ নিয়ে তখন গোটা পার্লামেন্টেই ছিলো অস্বস্তি। তখন আমরা কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সাংসদদের ইংলিশ অনুবাদ শুনেছি আর এবারে আমরা যখন গেছি, তখন পার্লামেন্টের কোন সেশন ছিলো না। গোটা পার্লামেন্ট ভবন খাঁ খাঁ করছে। দর্শণার্থীদের জন্যে খোলে দেয়া শূন্য চেয়ারে বসে ছবি তোলেছি, আর এমইপিরা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন ফটো সেশনে।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী কলামিস্ট।

এইচআর/আরআইপি