ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দেহঘড়ি

নাসরীন মুস্তাফা | প্রকাশিত: ০৩:৫৭ এএম, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

বাউল শিল্পীরা বহুকাল আগেই গেয়েছিলেন, ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি, কোন্ মিস্তরি বানাইয়াছে!’ মন দেহঘড়ির সন্ধানে ব্যস্ত। জানতে চায়, কে বানিয়েছেন এই দারুণ ঘড়িটা? একবার চাবি মেরে এই ঘড়ি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, ঘড়িটা চলছে। ঘড়ি থেমে গেলেই ঘটে মৃত্যু।

বাউল শিল্পীর সুফি দর্শন দেহঘড়ি যে আছে, তা ভাবনায় এনেছিলেন। খুঁজে পাননি। জেফরি সি. হল, মাইকেল রসবাশ এবং মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং নামের তিন বিজ্ঞানী সত্যি সত্যিই পেয়ে গেছেন প্রাণীর দেহঘড়ির সন্ধান। আর তাই ২০১৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারটাও পেয়ে গেছেন।

বৈজ্ঞানিক মতে প্রমাণ হয়ে গেছে, মানুষের শরীর কীভাবে দিনে চব্বিশ ঘন্টার হিসেবে তাল মেলে চলে। দিনের আলো না থাকলেও শরীরের ঘড়ি টের পেয়ে যায়, এখন দিন, দিনের কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। দেহঘড়ির টিক টিক ঠিক ঠিক চালাতে কাজ করে হরমোন, জিন আর অন্য সব শারীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ড। আর তাই আমাদের ঘুম পায়। জ্বর আসে। খাবার হজম হয়। রক্তচাপ বাড়ে, কমে। ঘড়িটা বিগড়ে গেলে শরীরও বিগড়ে যায়। ডায়াবেটিস হয়। হৃৎপিণ্ড ঝামেলা বাঁধায়। আলঝেইমার রোগ বাঁধে। এরকম আরও কত কী!

হল আর রসবাশ জেনেছেন, দিনের সময়গুলো নিয়মিত চক্রে একটি প্রোটিন বাড়ছে আর কমছে। এই প্রোটিনটাই দেহঘড়ির আনবিক গিয়ার, যা ঘড়িটাকে চালিয়ে নেয়। বিজ্ঞানী ইয়ং আবিষ্কার করেছেন আরেকটি প্রোটিনকে। এর কাজ সময়হীন। কখনোই না থেমে পর্যায়ক্রমে ঘড়িটাকে চলতে সাহায্য করে এ। আসলে জিন আর প্রোটিনের তালে তালে কাজ করার ফলেই শরীর প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারে। আর এই তালটা ঠিক করে দেয় পৃথিবীর আবর্তন শক্তি। এর ফলে পৃথিবীর উপর সূর্যের আলো বাড়ে, কমে। দিন আসে, রাত হয়। পৃথিবীর আবর্তনের সাথে শরীরকে মানিয়ে নিতে জন্মের পর কিছু সময় নেয় প্রাণী। এই সময়টাও এক এক প্রাণীর জন্য আলাদা। একবার মানিয়ে নিতে পারলেই চমৎকার ছন্দে চলতে থাকে দেহঘড়ি। সুস্থ থাকে শরীর। ফুরফুরে থাকে মন। গানও আসে তখন, ‘মন আমার দেহঘড়ি!’

মানুষের দেহঘড়ির কাঁটা টিক্ টিক করে কী বলে? বলে, ঠিক্ ঠিক্ ঠিক্ ঠিক্! কি ঠিক্ ঠিক্? ঠিক্ ঠিক্ কাজ করো। এই যেমন, সকাল ছয়টায় স্ট্রেস বা উদ্বেগ-দুঃশ্চিন্তা তৈরির হরমোন কর্টিসলের প্রবাহ ঘটে, সকাল নয়টার দিকে রক্তচাপ বাড়ে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে, দুপুর বারোটার আগে আগে মস্তিষ্ক সজাগ থাকে সবচেয়ে বেশি, দুপুর বারোটার পর সমন্বয়ের কাজ হয় সবচেয়ে ভাল, বিকেল তিনটে নাগাদ প্রতিক্রিয়া জানানোর কাজটা হয় খুব দ্রুত, সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রাও থাকে সবচেয়ে বেশি। এরপর? সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টার ভেতর রক্তচাপ বাড়ে সবচেয়ে বেশি। রাত নয়টার দিকে শুরু হয় রাত পছন্দকারী আলোক সংবেদনশীল হরমোন মেলাটোনিনের নিঃসরণ। রাত বারোটা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত গভীর ঘুমের সময়। রাত তিনটা থেকে শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে। ভোর ছয়টায় আবার ঠিক্ ঠিক্ শুরু হয় করটিসলের মুক্তি।

ঠিক্ ঠিক্ যদি দেহঘড়ির সময় মেপে দেহটা না চলে, তবে? দেহঘড়ির তালে না চললে ‘জেট ল্যাগ’ শব্দটি শুনতে হয়। রাতের ঘুম রাতে না ঘুমিয়ে জেগে থাকলে কি হয়? পরদিন চেহারা দেখেই অন্যরা বুঝে নেবে, শরীর ভাল নেই। যারা রাতজাগার কাজ করেন বা রাতে অনিদ্রা রোগে ভোগেন, তাদের খুব ভয়ে থাকতে হয়। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃপিন্ডের অসুখ, স্থুলতা আর বিষণ্ণতায় ভুগতে হয় এদেরকেই বেশি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই তিন বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন ফলের উপর বসে এমন এক মাছির দেহঘড়ি নিয়ে। নোবেল পুরস্কারটাও মিলেছে এই মাছিরই কল্যাণে। প্রকৃতির সাথে মেলানো মাছির ঘড়ি সময়মতো ঘুম পাড়ায়, জাগিয়ে তোলে। জিন কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তা বুঝতে গিয়ে ১৯৯০ সালে হল এবং রসবাশ ডিএনএ এবং প্রোটিনের মধ্যবর্তী খবরবহনকারী আরএনএ’র একটি ধাপ খুঁজে পান। এই ধাপ নিয়ন্ত্রণ করে কখন প্রোটিন জিন-এর কর্মকাণ্ডকে থামিয়ে দেবে।

জেফরি সি. হল, মাইকেল রসবাশ এবং মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং নামের তিন বিজ্ঞানী সত্যি সত্যিই পেয়ে গেছেন প্রাণীর দেহঘড়ির সন্ধান । ঘড়ি তো মাত্তর এক বছরের হিসাবের উপর স্থির। বিজ্ঞানী ইয়ং এমন একটি জিন খুঁজে পেলেন, যা সময়ের কোন ধার ধারে না। এ সময়হীন। এই জিন’এর প্রোটিনের নাম টিআইএম, যা জিন-এর কর্মকাণ্ডকে থামিয়ে দিতে সক্ষম প্রোটিনের সাথে কাজ করে ঘড়িটাকে চালায়। ঘড়ির কাঁটা কতটুকু পরে পরে গিয়ে টিক্ করবে, তা যেমন দাগ কাটা থাকে ঘড়ির ডায়ালে, সেভাবে ডিবিটি নামের প্রোটিন ঠিক করে দেহঘড়ির কতটুকু সময় পর পর টিক্ করবে। এরকম আরও অনেক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করার পর বিজ্ঞানীত্রয় বুঝতে পারলেন, প্রাণীর প্রায় প্রতিটি কোষে একটি করে ঘড়ি সেট করা আছে। একই তালে চলে প্রতিটি কোষ-ঘড়ির প্রায় সব জিন। কোন কোন জিন তাল দেয় যকৃতে, কেউ ত্বকের কোষে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে চলে সব কাজ। কোষ-ঘড়ির একটার সাথে আরেকটা তাল না মিললেই কিন্তু সর্বনাশ!

বিজ্ঞানী জোসেফ তাকাহাশি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, সিএমওয়াইসি এবং পি৫৩ নামের জিনদ্বয় কোষের বৃদ্ধি আর বিভাজনে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন, দেহঘড়ি টিক্ না করে উঠলে এরা নিজের থেকে এ কাজগুলো করে না। ঘড়ি ঠিক্ না থাকলেই কোষ ক্যান্সারের মতো কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও সংক্রমণ করতে বাধ্য হয় হয়তো। এর উল্টোটাও ভাবা যায়। ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে ঘড়ির টিক্-এর সাথে মিলিয়ে ঔষুধ দেওয়া সম্ভব করা যায় কি না, বিজ্ঞানীরা দেখছেন।

মাছির দেহঘড়ির উপর ভিত্তি করে মানুষের দেহঘড়ি খুঁজে পাওয়ার কাজটা জোরদার হবে। মূল ক্লু যেহেতু মিলে গেছে, মানুষসহ সব প্রাণের দেহঘড়ির সন্ধান পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। ঘড়ির দোকানে নানান নকশার ঘড়ি সাজিয়ে রাখা হয়। এবার বিজ্ঞানীরা সাজাবেন সব প্রাণীর দেহঘড়ি।

দেহঘড়ির কথা এর আগেও একবার উঠেছিল বিজ্ঞানী মহলে। ১৯৭১ সালে সেইমর বেনজের আর রোনাল্ড কোনোপকা ফলের মাছির উপরই গবেষণা করেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন, এই মাছির জিনে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে এর শরীরের তালটা কেটে যায়। তখন এ অকারণে দিনের নানান সময়ে উড়ে বেড়ায়। তাল না কাটলে ওড়ে না। মাছির এই জিনটাকে সনাক্ত করতে ১৯৮৪ সালে হল আর রসবাশ-এর নেতৃত্বে ব্রান্ডিস য়্যুনিভার্সিটির জিনবিজ্ঞানীদের দল গবেষণা শুরু করলেন। একই সময় রকফেলার য়্যুনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়ং মাছির ঐ জিনটির ডিএনএ-র পাঠোদ্ধার করতে ব্যস্ত হলেন। বেশ কয়েক বছর পর এক কনফারেন্সে আসার পর ইয়ং জানলেন হল আর রসবাশ কী করছেন। তিনজনের গন্তব্য একটাই বুঝে গেলেন। সেই থেকে কাজ করছিলেন একসাথে।

প্রেস কনফারেন্সে রসবাশ মজা করে বলছিলেন, নোবেল কমিটি ভোর সকালে টেলিফোন করে তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তাঁর দেহঘড়ির কাজকে ঠিক্ থাকতে দেয়নি। পুরস্কার পাওয়ার খবর দিয়ে তাঁকে হতবাক করা হয়েছে। তিনি দম নিতে পারছিলেন না। তাঁর স্ত্রী তখন দম নিতে বললেন বলে বাঁচা!

ইয়ং-এর ঘুমের বারোটা বাজাতে পারেনি নোবেল কমিটির টেলিফোন। ফোনটা ছিল রান্নাঘরে, তিনি রিং শুনতে পাননি। পরে তাই হাসতে হাসতে বলছিলেন, গোটা দুনিয়া জেনে গেল, আমি তখনো জানি না! রকফেলার য়্যুনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট রিচার্ড লিফটনের ফোন পেয়ে যখন জানলেন, তখন এতটা অবাক হলেন যে জুতো পরতে ঝামেলা হ’ল। জুতো পরার পর দেখলেন, মোজা পরার দরকার ছিল। মোজা আর জুতা পরার পর বুঝতে পারলেন, সবার আগে উচিত ছিল প্যান্টটা পরে নেওয়া।

আবিষ্কার সব সময়ই আনন্দদায়ক। এরপরও দুঃখ হচ্ছে, হল, রসবাশ আর ইয়ং-এর সাথে সেইমর বেনজের আর রোনাল্ড কোনোপকা’ও নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন। নোবেল কমিটি মৃত্যুর পর পুরস্কার দেয় না বলে পেলেন না। আবার নোবেল কমিটি সেই ১৯৭১ সালের দিকে এই ঘটনাকে পুরস্কার দেওয়ার মতো কোন ঘটনা বলেও বিবেচনা করেননি। করলেন এতকাল পর। এ নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, চিন্তায় জেট ল্যাগ ঘটেছিল নোবেল কমিটির। মানুষের এবং অন্যান্য প্রাণীরও চিন্তায় জট বাঁধে। কেন বাঁধে তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। যদি কখনো জানা হয়, তবেই হয়তো নোবেল কমিটির এই কাণ্ডের ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন