ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপির হ্যাঁ না

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৯:০৮ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব বিষয়ে বিভিন্ন দলের মতামত চাওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের মতামত দিতে কিছুটা সময় নিয়েছে। তাদের মতামতের দিকে সংস্কার কমিশনগুলো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল ছিল। তবে সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো নিয়ে বিএনপি অনানুষ্ঠানিক মন্তব্য অনেকদিন আগে থেকেই করে আসছিল। যার প্রতিফলন তাদের মতামতেও দেখা গেছে।

এর আগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলগুলো আনুষ্ঠানিক মতামত জানিয়েছে। আর সেগুলো সংস্কার প্রস্তাবকে মোটামুটিভাবে সমর্থন জানানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিএনপির মতামত সেক্ষেত্রে সবার নজর কাড়ে। আর তাদের মতামত বলতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবের উল্টোমুখী। এই মুহূর্তে বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির মতামতকে উপেক্ষা করে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা কিংবা বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব হবে সে বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। বিএনপি সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনার অধিকাংশ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর ব্যাপারে যেভাবে অসমর্থন জানিয়েছে ঠিক তার উল্টো দিক দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামিসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে। যাদের জনসমর্থন সাংগঠনিক ভিত্তির কোনোটাই বিএনপির সঙ্গে তুলনীয় নয়। দেখা যাক তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামতগুলো কি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এক ব্যক্তি একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবে না এমন প্রস্তাব মানতে নারাজ বিএনপি। এর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয় কি না ভাবার অবকাশ আছে। রাজনৈতিক দলগুলো গঠনতন্ত্রে যদি এমন বিষয় সংশ্লিষ্ট না থাকে, অর্থাৎ কোনো দল যদি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় নেতা একই ব্যক্তি হতে বাধা না দিয়ে থাকে, তাহলে আইন মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা করা কি যৌক্তিক হতে পারে? তবে প্রস্তাবটি আইনি বিধান হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এটা বলা যায়। অবশ্য এর অন্য একটি দিকও আছে। প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান যদি একই ব্যক্তি হয়ে থাকেন তাহলে সরকারকে দল থেকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার দলও সরকারের কোনো কাজে দ্বিমত প্রকাশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে একটা দল নির্বাচনের সময় তার দলের লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে ভোটারের কাছে যায়। ইশতিহারে দলের নেতা থেকে শুরু করে তাদের পরিকল্পনাসমূহ তারা সবই জনগণের সামনে হাজির করে। এক্ষেত্রে দলগুলোর গঠনতন্ত্রে সংস্কার আনতে হবে। এই আইনি বিধান কি উদার গণতান্ত্রিক মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না?

বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটোরই চর্চা হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট আমলে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে দেখা গেছে দলীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করতে গিয়ে। আবার স্বাধীনতা লাভের পরপরই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে তাদের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে দলীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হওয়ার প্রয়োজনে। সেসব ছিল দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিষয় ছিল না।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সংস্কার প্রস্তাবে সরকারের মেয়াদ ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছর করার কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবের পেছনে যদি বলা হয়, মেয়াদ বেশি হলে সরকার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে তাও কি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়? ৫ বছর মেয়াদ হলে স্বৈরাচার হবে আর ১ বছর কমিয়ে দিলে হবে না এর পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। বরং বাংলাদেশের ইতিহাস বলে দীর্ঘস্থায়ী সরকারে উন্নয়নমূলক কাজ হয় বেশি। আবার এও ঠিক ৫ বছর মেয়াদি সরকার, ৯ বছর কিংবা ১৫ বছর মেয়াদের সরকার সবগুলোর ভাগ্যেই স্বৈরাচারের বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। এ নিয়ে তর্ক করলে শেষ হবে না। বাংলাদেশের প্রতিটি বড় দলের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন হয়েছে। প্রতিটি দলকেই স্বৈরাচার গণতন্ত্র হত্যাকারী ও গণহত্যাকারী হিসেবেও আখ্যায়িত হতে হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো গরিব একটি দেশে নির্বাচন ঘনঘন হওয়ার মতো অবস্থা কি আছে? ৫ বছর মেয়াদ হলে স্বৈরাচারী হবে একবছর কমিয়ে দিলে হবে না এর যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাই না। বরং একটা সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে কাজ শুরু করতে করতেই দুই তিন বছর পেরিয়ে যায়। বড় প্রকল্পগুলো আবার এক সরকারের মেয়াদে শেষও হয় না। এক্ষেত্রে মেয়াদ কমিয়ে আনা হলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে এমন আশঙ্কা বেড়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

একই ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না এমন প্রস্তাবও বিএনপি মানতে নারাজ। প্রস্তাবকারীদের বক্তব্য দুইবারের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকলে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে না। নেতৃত্ব কি প্রধানমন্ত্রী পদ দিয়ে বিকশিত হয়? আমরা উদাহরণ হিসেবে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা বলতে পারি। তিনি কি প্রধানমন্ত্রী কিংবা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন? তার নেতৃত্ব নিয়ে কারোই প্রশ্ন আসে না। এই প্রস্তাবকে ইতোমধ্যে অনেকে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কোনো ব্যক্তি যদি নিজ যোগ্যতায় বার বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো হন, ভাগ বাটোয়ারার জন্য সেই যোগ্যতাকে আইন দিয়ে বাতিল করে দেওয়াটা কতটা গ্রহণযোগ্য তা ভাবার বিষয় আছে। যে কোনো প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা ভেবে দেখতে হবে। প্রতিটি দলেই একজন আইকনকে ঘিরে রাজনীতি আবর্তিত হয়ে থাকে। যদি আইন করে তা রহিত করা হয়, তাহলে দলের ভিতরে বিভেদ এবং অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাবে এটা নিশ্চিত। দলে চেইন অব কমান্ড থাকবে কি না সন্দেহ আছে। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে তাই এর প্রতিফলন ঘটবে সরকারেও।
মূল জায়গায় হাত না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কয়বার হতে পারবেন এমন বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে মনে করি। দলগুলোর ভিতরে যদি গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ থাকে তাহলে অবশ্যই এই পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা নেই বললেই চলে, সেখানে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিধান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পদ বণ্টন হয় দরজা বন্ধ করে- টেবিলে আলোচনায়। কিংবা উপর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়, কাল থেকে তুমি ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হয়ে গেছো। হয়ত বলা হবে, পশ্চিমা বিশ্বে এভাবে একক নেতৃত্ব নেই। সেখানে বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে ভাবতে হবে। এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এর নাগরিক চিন্তার উচ্চতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার কথাটা ভাবতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার না এনে এধরনের চিন্তা কতটা বাস্তবসম্মত তা ভাবার দরকার আছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি যারা করেন, তারা নিজেরাই যদি দলীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষ না থাকেন,তারা যদি দলের মধ্যে স্বৈরাচার লালন করেন তাহলে তাদের ক্ষমতার আসনটি নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক হবে তেমনটা কি আশা করা যায়? তাই সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্র চর্চার দিকে অধিক গুরুত্ব দিলে ভালো করতো একথা বলা যায়।

এই মতামতগুলো এসেছে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের ভিত্তিতে। সেখানে যেভাবে ‘স্প্রেডশিট’ তৈরি হয়েছে তা নিয়েও কথা উঠেছে। সংস্কার প্রস্তাবগুলোর পক্ষে নাকি বিপক্ষে এভাবেই তা তৈরি হয়েছে। অনেকটা ‘হ্যাঁ- না’ ভোটের মতো। আবার প্রশ্ন উঠেছে, মতামতে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের বিষয়টি কীভাবে দেখা হবে।

বিজ্ঞাপন

আরেকটি দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হলে কোনো প্রস্তাব কি সিদ্ধান্ত আকারে গ্রহণীয় হবে। আজকে বিএনপি তাদের মতামত জানিয়েছে যা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবের বিপক্ষে। যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে মনে করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সমর্থক। তাদের পাশ কাটিয়ে কি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যাবে? সেক্ষেত্রে কি হবে?

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি সংস্কার প্রস্তাবগুলোর পক্ষে। সঙ্গে জামায়াতে ইসলামি ও কয়েকটি ক্ষুদ্র দল আছে। এই বিভক্তিকে দূর করার কোনো চেষ্টা চোখে পড়ে না। এত বড় একটি জাতীয় ইস্যু তা নিয়ে পেশাজীবী সংগঠন,সুশীল সমাজের সঙ্গেও কি আলোচনা হয়েছে? কিংবা তাদের মতামতও কি চাওয়া হয়েছে?

এই মুহূর্তে সংস্কার প্রস্তাবকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই। যদি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হয় তাহলে নির্বাচনের আগে কি সংস্কার সম্ভব হবে? সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে কীভাবে? গণভোট গণপরিষদ নিয়েও জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। মুখোমুখি নয়, পাশাপাশি বসতে না পারলে সহসা নির্বাচিত সরকার প্রত্যাশা করা যাবে বলে মনে হয় না। সে কাজটি কীভাবে করতে হবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকেই ঠিক করতে হবে। না হলে সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতার পথ ধরে সরকার বিরোধিতাও শুরু হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তেমনটি যেন না হয়, সেটাই কাম্য।

বিজ্ঞাপন

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এমএস

বিজ্ঞাপন