শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি
ক্লাশ অফিস সহশিক্ষা কার্যক্রম খোলা-বন্ধের বিষয় স্পষ্ট করা উচিত

আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত। সাধারণত দেখা যায় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বছরে ছুটি থাকে কমবেশি ৭৫ দিন। এর বাইরে খোলার দিনগুলোতে সপ্তাহে দু’দিন করে থাকে সাপ্তাহিক ছুটি। এভাবে বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ছুটি থাকে ১৫০ দিনেরও বেশি! এক্ষেত্রে মেনে চলা উচিত আন্তর্জাতিক মান ও সমতা।
জানা উচিত কোন দেশে কী কারণে কতদিন ছুটি থাকে কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? বাস্তবতার ভিত্তিতে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা উচিত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে। যেমন, পূজায় মাদ্রাসা এবং রোজায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা উচিত কিনা? প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের ছুটির তালিকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা কতটা যৌক্তিক?
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবারের পরিবর্তে বৃহস্পতি ও শুক্রবার নির্ধারণ করা অধিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে; যা শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে কর্মজীবী অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের শুক্রবারে নিজেদের মত সময় দিতে পারবেন এবং শনিবারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সন্তানদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে শিক্ষকগণের পরামর্শ নিতে পারবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দিতে পারবেন। অর্থাৎ অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি (পিটিএ) এর কার্যক্রম আরো জোরদার করা যাবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় এটি পরিষ্কার করে লেখা উচিত যে, কোন দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ছুটি থাকবে, কোন দিন শুধু শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, কোনো দিন অফিস খোলা থাকবে, কোন দিন বিশেষ দিবস উদ্যাপনের জন্য কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য সবাই প্রতিষ্ঠানে আসতে বাধ্য থাকবে। যখন অফিস বন্ধ রাখা হবে তখন কোনো সরকারি কাজ করার আদেশ সাধারণত দেওয়া উচিত নয়।
পরিচালনা কমিটিতে (জিবি, এসএমসি, এমএমসি) অধিক শিক্ষিত কর্মজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে শনিবারে সভা করে উপস্থিতি বৃদ্ধি করে অধিক সহযোগিতা নেওয়া যাবে। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবারে ছুটি না নিয়ে নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অপারেট করাসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে পারবেন। তদুপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন চাইলে বৃহস্পতিবারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিসিয়াল কাজও জরুরি ভিত্তিতে সম্পাদন করতে পারবেন। অপরদিকে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও পানি-বিদ্যুৎ বণ্টনের ক্ষেত্রেও তা সামান্য সহায়ক হবে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিবস ছুটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন: ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, বাংলা নববর্ষ, ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু সেসকল দিবস উদ্যাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। দিবস উদ্যাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বিধায় কর্মচারীদেরও প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মত শিক্ষক-কর্মচারীরা ঐ সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বাস্তবে ছুটি ভোগ করতে পারেন না।
এক্ষেত্রে অনেকের মনে অসন্তোষ বিরাজ করে। এসকল দিবস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছুটির দিন নাকি খোলার দিন তা পরিষ্কার নয়! তাই প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে শিক্ষকদের মতপার্থক্য হয়, দূরত্ব বৃদ্ধি পায় ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছুটির দিনে এক বা একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা পরিষ্কারভাবে বলা না থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ চরম বেকায়দায় পড়েন।
শিক্ষার্থীদের বিশেষ দিবসে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ও বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের বা প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত করে কিছুটা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা গেলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার তেমন কোন নির্ধারিত উপায় ঘোষণাকৃত নেই। কোন শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ দিবসে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে অর্থাৎ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকতে চাইলে বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকলে প্রতিষ্ঠান প্রধান কী করবেন বা কী ধরনের ব্যবস্থা নিবেন তা পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকা উচিত।
একজনকে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐদিন অনুপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হলে ১০ জন ১০ রকমের সমস্যা উত্থাপন করে অনুপস্থিত থাকার আবদার করেন! সবার আবদার রাখতে গেলে দিবস উদ্যাপন করা সম্ভব হয় না। আবার অনুপস্থিতির সংখ্যা হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ক্ষমতা বলে ওই দিনের অনুপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর একদিনের নৈমিত্তিক ছুটি কমিয়ে দেওয়া হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন; যদিও ছুটিবিধি অনুসারে কর্মী বৎসরে পূর্ণ বিশ দিন নৈমিত্তিক ছুটি অধিকার হিসেবে প্রাপ্য নন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান তা দিতে বাধ্য নন।
বিজ্ঞাপন
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সরকারি আদেশ অনুসারে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদ্যাপনের এবং তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের দায়িত্ব কেবল প্রতিষ্ঠান প্রধানের ও আগ্রহী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই দায়সারা ভাবে জাতীয় দিবস উদ্যাপিত হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় বিশেষ জাতীয় দিবসগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি তালিকার বাইরে রাখা অথবা অন্য কোনো কার্যকর নির্দেশনা থাকা আবশ্যক।
অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ছুটি বিদ্যমান যে সকল ছুটির দিনে বা ভ্যাকেশনে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সরকারি অফিস খোলা থাকে। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি, সরকারি অফিস খোলা। তাই সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস থেকে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ এসে থাকে; যা জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হয় বিধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস খোলা রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বিভিন্ন অফিসিয়াল বা হিসাব সংক্রান্ত কাজেও ভ্যাকেশনের সময় অফিস খোলা রাখার প্রয়োজন পড়ে। শিক্ষার্থীদের ভর্তি, টিসি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, সনদ প্রদান, প্রবেশপত্র প্রদান, বইয়ের চাহিদা প্রদান, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-বিল তৈরি ইত্যাদি কাজে প্রতিষ্ঠানের অফিস নিয়মিত খোলা না রেখে কোন উপায় থাকে না।
তখন প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারীদের উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ তারা ওই ভ্যাকেশন উপভোগ করতে পারেন না। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের কর্মী হিসেবে ট্রিট করার কারণে বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা ছুটি অর্জন ও বিক্রির সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং তারা পিআরএল ভোগের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারী প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে কী রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা থাকা উচিত। তবে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অবকাশ বিভাগের সুবিধা ভোগ করতে পারেন না তাদেরকে অবকাশ বিভাগের কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভাবতে হবে।
বিজ্ঞাপন
তাছাড়া বিশেষ দিবসে ও অন্যান্য ভ্যাকেশনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “ছুটি/বন্ধ থাকবে” এমন কমন কথা ছুটির তালিকায় বা সরকারি আদেশে মোটেও লেখা উচিত নয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের গেট বা দরজা ছুটির দিনে বন্ধ থাকে। সে হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছুটির দিনে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকারই কথা এবং সেদিন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানে আসতে না চাওয়ারই কথা। তাই নির্ধারিত ছুটির/বন্ধের দিনে কেউ আসতে না চাইলে তাকে বাধ্য করা খুবই কঠিন। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় এটি পরিষ্কার করে লেখা উচিত যে, কোন দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ছুটি থাকবে, কোন দিন শুধু শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, কোনো দিন অফিস খোলা থাকবে, কোন দিন বিশেষ দিবস উদ্যাপনের জন্য কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য সবাই প্রতিষ্ঠানে আসতে বাধ্য থাকবে। যখন অফিস বন্ধ রাখা হবে তখন কোনো সরকারি কাজ করার আদেশ সাধারণত দেওয়া উচিত নয়। কেননা, বাড়তি সুবিধা দেওয়া না গেলে ছুটির দিনে কাজ করার আদেশ অমান্য হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
সর্বোপরি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অফিসের জন্য পৃথকভাবে যৌক্তিক বার্ষিক মোট কর্মদিবস তথা মোট কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে ও অন্যান্য ভ্যাকেশনে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধান, সহপ্রধান, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য পুরস্কার-তিরস্কার নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। সেইসাথে অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখা উচিত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সচ্ছলতা ও কাঙ্ক্ষিত জীবনমান।
লেখক: অধ্যক্ষ ও প্রাবন্ধিক।
বিজ্ঞাপন
এইচআর/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন