ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ভূমিকম্প: বাংলাদেশে এক নীরব বিপর্যয়ের শঙ্কা

ড. হাসিনুর রহমান খান | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০৭ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ইতিহাসে সবচেয়ে পুরোনো ও বিধ্বংসী ঘটনা হলো ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল সংঘটিত আরাকান ভূমিকম্প। ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৮.৫ থেকে ৮.৮ এর মধ্যে, যা উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ভূকম্পন। গবেষণা বলছে, এই ভূমিকম্পের ফলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূলে ৪-৫ ফুট পর্যন্ত ভূমি ডুবে যায় এবং সেখানে জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং প্রাণহানি হয়| সেসময় রেকর্ডিং ব্যবস্থা না থাকায় প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে। এই ভূমিকম্প শুধু বাংলাদেশে নয়, বার্মা ও আন্দামান অঞ্চলেও প্রচণ্ডভাবে প্রভাব ফেলেছিল। ভূ-প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ভূমিকম্পের ফলে বঙ্গোপসাগরের কিছু অংশে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি ও হ্রাস পেয়েছিল। এতে বহু কৃষিজমি অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

এরপর ইতিহাসের পাতায় আসে আরেকটি স্মরণীয় ভূমিকম্প, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন, যার মাত্রা ছিল ৮.১। এই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল মেঘালয়ের শিলং প্লেট, কিন্তু বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা পর্যন্ত এর প্রভাব অনুভূত হয়। রাজধানী ঢাকায় বহু ভবন ভেঙে পড়ে এবং রাস্তায় ফাটল ধরে। ঐ সময়কার ব্রিটিশ সরকারি রেকর্ডে উল্লেখ আছে যে, ঢাকার কুঠিবাড়ি, চার্চ ও স্কুলঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তৎকালীন বাংলায় প্রায় ১,৫০০ মানুষ মারা যায় এবং হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। এই ভূমিকম্প বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক গঠন ও দুর্বল অবকাঠামোর দিকে প্রথমবারের মতো সরকার ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এর ঠিক দুই দশক পর, ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই, নেত্রকোনা অঞ্চলে ঘটে ৭.২ মাত্রার আরেকটি শক্তিশালী ভূমিকম্প। যদিও প্রাণহানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে এটি আমাদের আবারও সতর্ক করে দেয় যে, দেশের অভ্যন্তরে টেকটোনিক চাপ ধীরে ধীরে সঞ্চিত হচ্ছে এবং যে কোনো সময় বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। স্থানীয় বিভিন্ন বাজার ও জনবসতিতে ক্ষতি হয় এবং বহু ঘরবাড়ি আংশিক ধসে পড়ে।

বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাস আমাদের চোখ খুলে দেয় যে, আমরা একটি বাস্তব ও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে বাস করছি। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা আমরা ঠেকাতে পারবো না, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, এবং সচেতনতায় আমরা এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস শুধু স্মৃতি নয়, তা ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৩০ সালের ২ জুলাই, আসামের লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবল কম্পন সৃষ্টি করে। বিশেষত সিলেট, চাঁদপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বহু কাঠামোগত ক্ষতি হয়। সেসময় স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো জানায়, “ভূমি ফেটে যায়, অনেক স্থানে পানির উৎস হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় অথবা নতুন করে উৎস দেখা যায়।” অন্যদিকে, ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট, আসাম-তিব্বত সীমান্তে সংঘটিত হয় ৮.৬ মাত্রার এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প, যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। যদিও বাংলাদেশ ছিল উপকেন্দ্র থেকে দূরে, তবুও সিলেট ও পার্বত্য এলাকার মানুষজন তা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করেন। বহু ভবন ফাটল ধরে এবং ভূমিধসের কারণে যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫-২০টি ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়। বিশেষ করে, গত দুই তিন বছর অসংখ্য ছোট ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশ| ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, এ ধরনের ভূমিকম্পগুলো “warning tremors” হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, এগুলো বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনার সংকেত হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন ২০২১ সালে সিলেটে ৫.২ মাত্রার এবং ২০২২ সালে চট্টগ্রামে ৪.৯ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে।

২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের কাছে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যা ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায়ও কম্পন সৃষ্টি করে। ২০২৪ সালের ৫ মার্চ ভারতের মণিপুরে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যার প্রভাব ঢাকা, সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়। ২০২৫ সালের ২৮ মার্চ মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে ৭.৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প ঘটে, যার প্রভাব আশেপাশে দেশগুলো সহ বাংলাদেশেও অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্পে মিয়ানমারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন। এগুলোর প্রকৃতি থেকে বোঝা যায় যে ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক চাপ সঞ্চিত হচ্ছে, এবং এর নিষ্কাশন হঠাৎ এক বৃহৎ ভূমিকম্পের মাধ্যমে ঘটতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ভূমিকম্পের পিছনে মূল কারণ হল পৃথিবীর অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটগুলোর চলমান গতিশীলতার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন এক অঞ্চলে, যা ভূমিকম্পের জন্য বিশেষভাবে সংবেদনশীল। দেশের পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, এবং মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক সীমান্তে, যেখানে ভারতীয় প্লেট, ইউরেশীয় প্লেট, এবং বার্মা মাইক্রোপ্লেট একে অপরের সংস্পর্শে রয়েছে। এই তিনটি প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ ও ঘর্ষণ ঘটে চলেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। ভারতীয় প্লেট উত্তরদিকে ধীরে ধীরে ইউরেশীয় প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে, যাকে বলে সাবডাকশন। এই প্রবণতা শুধু হিমালয় পর্বতমালার উচ্চতা বাড়াচ্ছে না, বরং এর ফলে প্লেট সীমান্তে বিশাল পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, যা শত শত পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি। এই শক্তি কোনো এক সময় ভূমিকম্প হিসেবে হঠাৎ মুক্তি পায়।

বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব অঞ্চল বিশেষভাবে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ এই অঞ্চলটিতে ভূ-ভাগের নিচে একাধিক ভাঙন রেখা (fault lines) সক্রিয় অবস্থায় আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই এলাকায় বর্তমানে কয়েক শত বছর ধরে টেকটোনিক চাপ সঞ্চিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলছে। ২০১৬ সালে Nature Geoscience-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিচে একটি ‘বিপজ্জনক টেকটোনিক টাইম বম্ব’ অবস্থান করছে, যেখানে প্রায় ১৪০-১৫০ বছরের জমে থাকা টেকটোনিক চাপ একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের দিকে ইঙ্গিত করছে। গবেষণাটি ২০০৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপন করা ২৫টিরও বেশি জিপিএস স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই পূর্বাভাস প্রদান করে। এতে বলা হয়, ভবিষ্যতে ৮ বা তারও বেশি মাত্রার একটি ভূমিকম্প বাংলাদেশ ও আশেপাশের দেশগুলোতে ঘটতে পারে, যার উপকেন্দ্র হতে পারে চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিকটবর্তী অঞ্চল। এই ধরনের ভূমিকম্প ঘটলে এর প্রভাব পড়বে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের জনবহুল এলাকায়, এবং এর ফলে প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞের সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে রয়েছে বিভিন্ন গঠনগত দুর্বলতা যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভূমিকম্প-অপ্রতিরোধী ভবন, এবং অপর্যাপ্ত জরুরি সেবা| যা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে। ভূতাত্ত্বিক আরেকটি দিক হলো, ঢাকা শহরের মাটির গঠন। এটি মূলত নরম ও কাদামাটি দ্বারা গঠিত, যাকে বলে alluvial soil। এই ধরনের মাটিতে ভূমিকম্পের সময় liquefaction (ভূ-তরলীকরণ) ঘটে, অর্থাৎ মাটি জলীয় রূপে পরিণত হয়ে যায় এবং মাটির ওপরের কাঠামো ধসে পড়ে। এই ভৌম প্রকৃতি ঢাকার ঝুঁকিকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে। প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা নগরীতে প্রতিনিয়ত উচ্চ ভবন, বিপণিবিতান, ফ্লাইওভার, ও আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিস্তৃত নির্মাণযজ্ঞ কি ভূমিকম্পের ঝুঁকি বিবেচনা করে পরিকল্পিত?

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন যে, ঢাকা একটি উচ্চ ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, শহরটি বেশ কয়েকটি সক্রিয় ভূ-প্রকৌশলীয় (seismotectonic) লাইনের নিকটবর্তী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মধ্য মেঘনা ভ্যালি ফল্ট, ময়মনসিংহ ফল্ট, এবং দাউদকান্দি ফল্ট। এই লাইনে প্রচুর পরিমাণ টেকটোনিক চাপ জমে রয়েছে, যা যে কোনো সময় মুক্ত হয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পের রূপ নিতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি ঢাকায় ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, তবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে। TBS News–এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এমন মাত্রার একটি ভূমিকম্পে প্রায় ৭০,০০০ ভবন সম্পূর্ণ ধসে পড়তে পারে, এবং ১ লাখের বেশি মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিহত বা গুরুতর আহত হতে পারে। জরুরি সেবা যেমন ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি কার্যকরভাবে পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে, কারণ রাস্তা ধ্বংসপ্রাপ্ত ও যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

যা জানা যায়, তাতে ঢাকার অধিকাংশ ভবনই ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নকশা ছাড়া নির্মিত। বেশিরভাগ ভবনের কোনো পর্যাপ্ত ভিত্তি নেই, এবং নির্মাণকালে ভূমিকম্প সুরক্ষা আইন বা বিল্ডিং কোড মেনে চলার প্রবণতাও কম। রাজধানীর পুরান ঢাকায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি শতবর্ষ পুরোনো এবং তীব্র কম্পনে ধসে পড়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। নতুন এলাকাগুলোতেও-যেমন বসুন্ধরা, উত্তরা, মিরপুর ইত্যাদিতে-উচ্চ ভবন গড়ে উঠলেও, সব ভবনে ভূমিকম্প-নিরোধক ব্যবস্থা যথাযথভাবে নেই।

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও, রাজধানীর জরুরি সেবা খাত, হাসপাতাল, স্কুল ও সরকারি অফিস-সবই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং প্রায় সবই ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নকশা ছাড়া নির্মিত। ফলে এই স্থাপনাগুলো ধসে পড়লে, শুধু হতাহত নয়, পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রমও চরমভাবে ব্যাহত হবে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ থাকলেও, বাস্তবায়নের ঘাটতি স্পষ্ট। রাজউক-এর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিল্ডিং কোড কার্যকর না হলে ও প্রকৌশলীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকলে ভবিষ্যতের বিপদ অনিবার্য।

তাই প্রয়োজন, দ্রুত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অন্যান্য বড় বড় শহরের অবকাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের। এগুলি অত্যন্ত ব্যয় এবং সময় সাপেক্ষ হলেও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন| প্রয়োজন প্রত্যেক ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা যাচাই করা, পুনঃনির্মাণ অথবা রেট্রোফিটিং (retrofitting) উদ্যোগ নেওয়া, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, এবং প্রশিক্ষিত উদ্ধার ও চিকিৎসা দল প্রস্তুত রাখা। ঢাকা শুধু একটি শহর নয়, এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানকার একটি বড় ধ্বংসযজ্ঞ সমগ্র দেশের উপরই বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ভূমিকম্প মোকাবিলায় ঢাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।

ভূমিকম্প একটি আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা পূর্বাভাস ছাড়াই ঘটতে পারে, এবং মুহূর্তেই হাজার হাজার মানুষের জীবন, সম্পদ ও অবকাঠামো ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভূমিকম্প প্রতিরোধ নয়, বরং প্রস্তুতিই পারে বিপর্যয়ের ক্ষতি কমাতে সহায়ক হতে। তাই, জনসচেতনতা ও দুর্যোগ প্রস্তুতি-এই দুইটি দিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

একটি সচেতন সমাজ ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয়কে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও বাসাবাড়ির পর্যায়ে ভূমিকম্প-প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড চালু থাকা জরুরি। যেমন, স্কুল ও কলেজে নিয়মিত সিমুলেশন মহড়া করা, জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা ও আগুন নির্বাপণ প্রশিক্ষণ দেওয়া, বাসা বা অফিসে জরুরি ব্যাগ বা survival kit প্রস্তুত রাখা, যাতে পানীয় জল, শুকনো খাবার, টর্চ, ব্যাটারি, ওষুধপত্র থাকে।

পরিবারিক প্রস্তুতি পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ| পরিবারের সব সদস্যকে জানাতে হবে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে, কীভাবে দ্রুত বের হতে হবে, ইত্যাদি। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধ সদস্যদের জন্য আগে থেকেই নিরাপদ প্রস্থান পরিকল্পনা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এছাড়া, স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকা অপরিহার্য। প্রতিটি ওয়ার্ড বা মহল্লায় থাকা উচিত প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল যারা প্রাথমিক উদ্ধার কাজ, আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা এবং স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারবে।

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে, এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো, ভূমিকম্প পূর্বাভাস বা Earthquake Forecasting। উন্নত দেশগুলোতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস প্রদান ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ভূমিকম্প ঝুঁকি দিন দিন বেড়ে চলেছে, অথচ পূর্বাভাস বা আগাম সতর্কতার ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে।

বিজ্ঞাপন

ভূমিকম্প পূর্বাভাস মানে এই নয় যে, নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়ে কোথায় ভূমিকম্প হবে তা বলে দেওয়া যাবে। এ ধরনের প্রযুক্তি এখনো মানুষের হাতে আসেনি। বরং এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায় কোনো অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেমন: আগামী ১০ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৭.০ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা ৩০%, এই ধরনের মূল্যায়নই পূর্বাভাসের উদ্দেশ্য। এই পূর্বাভাস প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন উপাত্ত ব্যবহৃত হয়, যেমন, অতীতের ভূমিকম্পের নিখুঁত পরিসংখ্যান, ভূগর্ভস্থ টেকটোনিক প্লেটের নিখুঁত গতিবিধি, Fault line বা ভাঙন রেখার সঠিক অবস্থান, ভূমিকম্প ঘনত্ব মানচিত্র (Seismic Hazard Map)।

এই তথ্য বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক মডেল যেমন Poisson Model, Gutenberg-Richter Law, কিংবা ETAS Model ব্যবহার করে ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা নির্ণয় করা যায়। এসব মডেল উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ধাপে ধাপে প্রয়োগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ভূমিকম্প পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি অংশ নয়, এটি একটি জীবন রক্ষাকারী উদ্যোগ। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য নগরীর জন্য আলাদা পূর্বাভাস এবং সতর্কতা পদ্ধতি তৈরি করা হলে, সঠিক পরিকল্পনা, মহড়া, ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা অনেক সহজ হবে। অতএব, সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীদের একত্রে কাজ করে বাংলাদেশে একটি কার্যকর ভূমিকম্প পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কারণ সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতির সাথে যদি আমরা পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে যুক্ত করতে পারি, তবে তা একটি নীরব বিপর্যয়কে প্রতিরোধযোগ্য দুর্যোগে রূপান্তর করতে পারে।

বাংলাদেশের ভূমিকম্পের ইতিহাস আমাদের চোখ খুলে দেয় যে, আমরা একটি বাস্তব ও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে বাস করছি। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা আমরা ঠেকাতে পারবো না, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, এবং সচেতনতায় আমরা এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। মহামারি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস শুধু স্মৃতি নয়, তা ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতীতের এই ভূমিকম্পগুলো যেন আর কেবল পঠিত ঘটনা না থাকে, বরং সেগুলো আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতির অংশ হয়ে উঠুক-এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান এবং ডেটা সায়েন্স, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

hasinur@du.ac.bd

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন