ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

শতকোটি টাকার প্রকল্পে পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০৬:১৬ পিএম, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫

২০১৫ সালে ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকায় রংপুরে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করা ও শিক্ষার মানোন্নয়ন সামনে রেখে শুরু হয় কাজ। তবে দরপত্র প্রভাবিত করা, ক্রয়নীতি লঙ্ঘন, অর্থ লোপাটসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পটিতে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ চিত্র।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

অনিয়মের এসব অভিযোগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে এম নূর উন নবী, সাবেক উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাবিব অ্যান্ড কোংসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে এক হাজার আসনের ১০ তলা আবাসিক ছাত্রী হল ও তার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার নামে ১০ তলা গবেষণা ইনস্টিটিউট ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। পাশাপাশি একটি স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণ করার কথা ছিল।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শতকোটি টাকার প্রকল্পে পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি

২০১৮ সালের জুন মাসে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তিন দফা সময় বাড়িয়েও তা শেষ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আট মাস পর ফের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়।

দুই ভবনের স্থলে অসমাপ্ত চার ভবন!

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে নেওয়া এ প্রকল্পের অর্ধশত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠে। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করেই পুরো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি সংস্থার অনুসন্ধানে অর্থ আত্মসাতের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।

এ সংক্রান্ত নথি ঘেঁটে ও সরেজমিনে দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট নামে ৯ হাজার বর্গমিটারের একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণের কথা। তবে অনুমোদন ছাড়াই একটি ভবনের পরিবর্তে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি ভবন। যার একটি পাঁচতলা ও অন্য দুটি দোতলা বশিষ্ট।

এ বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। আমার কোনো বক্তব্য নেই। প্রকল্পের কাজে কোনো অনিয়ম বা ব্যত্যয় হয়নি।-বেরোবির সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে এম নূর উন নবী

সিঁড়ি ও পিলার ছাড়া এসব ভবনের কিছুই নির্মাণ হয়নি। এমনকি চারপাশেও দেওয়াল নেই। দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজ না হওয়ায় ভবনে পড়েছে শ্যাওলার আস্তরণ। ভবনের আশপাশে জমেছে আগাছা। এছাড়া স্যানিটারি, ওয়াটার সাপ্লাই, বিদ্যুতায়ন কিছুই হয়নি ভবন দুটিতে।

একই অবস্থা শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের। সেখানে ১৭ হাজার ৫০০ বর্গমিটারের ১০ তলা ভবন নির্মাণের বদলে একটি পাঁচতলা বিশিষ্ট ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। পিলারের ওপর রয়েছে শুধু কাঠামো। শেখ হাসিনা ছাত্রী হল, ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৭৪ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৯ টাকা। এই তিন প্রকল্পেই লঙ্ঘন হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শতকোটি টাকার প্রকল্পে পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি

শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৪৭ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৬ টাকা। ১০ তলা বিশিষ্ট ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ২৫ কোটি ২৭ লাখ ৬২ হাজার ৯৫৩ টাকা। এছাড়া প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণের অনুমোদন হয়। অনুমোদিত নকশা ও নিয়ম না মেনে এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

ছোট ভুলে সর্বনিম্ন দরদাতা পরিবর্তন

অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নির্মাণকাজের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সামান্য ত্রুটির কারণে সর্বনিম্ন দরদাতা পরিবর্তন করা হয়। দুটি প্রকল্পেই তুলনামূলক বিবরণীতে গাণিতিক ভুল দেখিয়ে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা পরিবর্তন করা হয়েছে। পিপিআর ২০০৮ এর বিধি ১১ অনুযায়ী, এরূপ গাণিতিক ভুল পরিলক্ষিত হলে তা সংশোধন করে তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দরদাতাকে লিখিতভাবে জানানোর কথা থাকলেও তা হয়নি।

টাইলসের মূল্য ২ টাকা, পিডির অনুমতি ছাড়া ৮৪ লাখ টাকা ছাড়!

প্রকল্পের দরপত্র নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুটি ভবনের প্যাকেজেই অস্বাভাবিক হারে মূল্য দাখিল বা ফ্রন্ট লোডিং করা হয়েছে, যা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি উল্লেখ করেনি। পিপিআর ২০০৮ এর বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উভয় ভবনের চুক্তিমূল্যে টাইলস, মোজাইক ইত্যাদিতে অস্বাভাবিক কম মূল্য (২ টাকা) দেওয়া হয়েছে। আবার ভবনের কংক্রিট ও ম্যাট ফাউন্ডেশনের কংক্রিটে দেওয়া হয়েছে অস্বাভাবিক হারে উচ্চমূল্য।

তৎকালীন পিডব্লিউডি রেট শিডিউল-২০১৪ অনুসারে ম্যাট ফাউন্ডেশনের কংক্রিটের মূল্য ১০ হাজার ৯৭০ টাকা/কিউবিক মিটার হলেও ২০ হাজার/কিউবিক মিটার দরে চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যের আইটেমের (ম্যাট ফাউন্ডেশন) কাজ ডিপিপিতে উল্লেখ না থাকলেও, অননুমোদিত অতিরিক্ত ব্যয়ের কাজ সম্পাদন করে বিপুল অর্থ বিল দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন বাজারদর/পিডব্লিউডি রেট শিডিউল-২০১৪ থেকে অস্বাভাবিক হারে মূল্য দাখিল বা ফ্রন্ট লোডিং থাকা সত্ত্বেও পিপিআর ২০০৮ এর বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছেন।

একইভাবে প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তিন কিস্তিতে ক্যাশ চেকের মাধ্যমে মোট ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকার বিল দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) কোনো অনুমতি আছে বলে উপস্থাপিত কোনো দলিলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনাকে দুর্নীতি বলছে দুদক।

এছাড়া ডিপিপিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সিএসই ও ইটিই বিভাগের আসবাবপত্র কেনার জন্য একটি উন্মুক্ত টেন্ডার (ওটিএম) পদ্ধতির পরিবর্তে তিনটি আলাদা আরএফকিউ পদ্ধতির (রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন) টেন্ডারের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৫ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা ইনস্টিটিউট ও শেখ হাসিনা হলের মতো স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণেও মানা হয়নি কোনো নিয়ম-কানুন। ৭৫০ বর্গমিটারের স্মারক নির্মাণের স্থানে ১৯০০ বর্গমিটার স্মারক নির্মাণাধীন।

জানা যায়, তিনটি স্থাপনা নির্মাণে ব্যত্যয়গুলোর পিএসসি এবং পিআইসির অনুমোদনের কোনো প্রমাণাদি না থাকায় প্রমাণিত হয়, অতিরিক্ত এরিয়া ও ভবনের ওয়ার্কিং ডিজাইনটি অনুমোদিত নয়।

প্রকল্পের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী/দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে মো. জাহাঙ্গীর আলম অননুমোদিত অতিরিক্ত এরিয়া ও ভবনের বাস্তবায়ন শুরু করেন। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ড. এ কে এম নূর-উন-নবী এ ধরনের অননুমোদিত অতিরিক্ত এরিয়া ও ভবনের ওয়ার্কিং ডিজাইনটি অনুমোদন করেন। এই দুজনকে এমন অনিয়মের জন্য সমানভাবে দায়ী করছে দুদক।

সূত্র জানায়, দুটি ভবনেই ভিত হিসেবে কাস্ট-ইন-সিটু পাইল করার কথা থাকলেও ভবন দুটিতে ম্যাট ভিত করা হয়েছে। যা পিএসসি এবং পিআইসির কোথাও উপস্থাপন না করে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পের দুটি ভবনেই ভিত সংক্রান্ত ব্যয় বরাদ্দ থেকে অনেক বেড়েছে। পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত কাজ বাস্তবায়ন করা ব্যক্তিগত চক্রান্ত ও দুর্নীতির শামিল বলছে দুদক।

আরও জানা যায়, প্রকল্পের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম অননুমোদিত অতিরিক্ত এরিয়া ও ভবনের বাস্তবায়ন শুরু করেন। এ ঘটনায় তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ড. এ কে এম নূর-উন-নবী নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই তিন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের পুরো টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।

বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এ কে এম নূর উন নবী। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। আমার কোনো বক্তব্য নেই। প্রকল্পের কাজে কোনো অনিয়ম বা ব্যত্যয় হয়নি।’

দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) নুজহাত ইয়াসমিন।

সাবেক উপাচার্যের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানকে আমরা সহযোগিতা করছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের অনেক নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন হয়েছে। প্রকল্পটি ৯৭ কোটি টাকার ছিল। পরে এটা বাড়িয়ে ১৭৮ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেটি মন্ত্রণালয় আটকে দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারকে কাজের চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ম বহির্ভূত। ঠিকাদার কোনো কাজই সম্পন্ন করেননি।’

এছাড়া আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আইন ২০১৫-এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী ৩০ কোটি টাকার ওপরের অর্থমূল্যের চুক্তি করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৪৭ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৬ টাকা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগে উপস্থাপন করে অনুমোদন গ্রহণ না করে প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. এ কে এম নূর-উন-নবী চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এ সংক্রান্ত কাজের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মন্ত্রণালয়/বিভাগের অনুমোদন সংক্রান্ত নথিও পাওয়া যায়নি।

স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণের জন্য এক কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলেও পিএসসি এবং পিআইসির অনুমোদন ব্যতীত উক্ত কাজের জন্য অসম্পূর্ণ দরপত্র আহ্বান করা হয়। বর্তমানে স্থাপনাটির কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

দোষ ও দায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির কোনো তদবির না শোনায় তিনি ইউজিসিসহ সরকারের সব শক্তি আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন। দীপু মনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আস্থাভাজনদের প্ররোচিত করছিলেন যাতে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা না হয়, আবার পাশাপাশি আমাদের বলছিলেন যে টাকা আছে এটা যাতে আমরা ব্যয় না করি।– সাবেক উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

ঠিকাদারদের আর্থিক সহযোগিতার কারণ দেখিয়ে ব্যাংক গ্যারান্টি গ্রহণ করে অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছে। নিয়ম না মেনে পরবর্তীসময়ে কাজ ও অগ্রিম দেওয়া বিল সমন্বয়ের আগেই তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক কর্নেল (অব.) মনোয়ারুল ইসলাম ও উপাচার্য প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর যৌথ স্বাক্ষরে উক্ত ব্যাংক গ্যারান্টি অবমুক্ত করেন। এ ঘটনাকে দুর্নীতি বলছে দুদক।

এছাড়া নিয়মের তোয়াক্কা না করে প্রকল্পের উভয় ভবনের ঠিকাদারের বিভিন্ন সময়ের বিল থেকে কথিত জামানতের টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে রাখা হয়েছে। পরে ঠিকাদারদের আর্থিক সহযোগিতার কারণ দেখিয়ে এফডিআরের বিপরীতে প্রকল্প ঠিকাদারদের ঋণ দিয়েছেন একই ব্যক্তিরা।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ওপর দায়

এ বিষয়ে ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দোষ ও দায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির কোনো তদবির না শোনায় তিনি ইউজিসিসহ সরকারের সব শক্তি আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। দীপু মনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আস্থাভাজনদের প্ররোচিত করছিলেন যাতে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখা না হয়, আবার পাশাপাশি আমাদের বলছিলেন যে টাকা আছে এটা যাতে আমরা ব্যয় না করি।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শতকোটি টাকার প্রকল্পে পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি

ঠিকাদারদের আর্থিক সহযোগিতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে। ঠিকাদাররা তো টাকা ছাড়া কাজ করবে না। তারা ম্যাটেরিয়াল কীভাবে কিনবে। সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থায় এ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু এই অর্থের অপব্যয় হয়নি। যে টাকা অবশিষ্ট ছিল, যতদূর মনে পড়ে ১৮ কোটি টাকা ছিল সেটা আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারিতে জমা দিয়ে দিয়েছি।’

আগের উপাচার্য নিয়মের ব্যত্যয় করেছেন জানিয়ে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘ফাউন্ডেশনে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পরিকল্পনায় যে পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ ছিল তার অতিরিক্ত অনেক জায়গাজুড়ে স্থাপনা শুরু করা হয়েছে। টাকা যেহেতু ব্যয় হয়েছে, আর প্রথম থেকেই ব্যত্যয় হয়েছে এরপর কোনো কিছুই আগের প্ল্যানমাফিক করা সম্ভব হয় না।’

অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাবিব অ্যান্ড কোংয়ের আব্দুস সালামের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফোন করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আইএমইডি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে অনিয়ম চিত্র

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে প্রকল্পটিতে অনিয়মের চিত্র। এ পরিস্থিতিতে ওই প্রকল্প বাতিল করেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পে দুটি ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত নির্মাণসহ সার্বিক ব্যয় হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন গত জুলাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করার কথা জানায়।

ইউজিসি ও আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদন ও বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কলিমউল্লাহ উপাচার্য হয়ে ২০১৭ সালের জুনে ওই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। গত ১৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে এই প্রকল্পে দরপত্র আহ্বানসহ বাস্তবায়ন পর্যায়ে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে জানায় পরিকল্পনা কমিশন।

পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা বাড়ানোর সুযোগ নেই জানিয়ে কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করার কথা জানায় কমিশন। পাশাপাশি অসমাপ্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ চাইলে নতুন প্রকল্প নিতে পারে বলে চিঠিতে জানানো হয়। একই চিঠিতে দুদকের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

এসএম/এএসএ/জেআইএম