বাধা ডিঙিয়ে সাফল্যের সোপানে তিথীর ‘চন্দ্রলতা’
যথাযথ সামাজিক সম্মান, শিক্ষা, কর্ম ও বাসস্থানের অধিকার কখনোই পান না সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। নানা বৈষম্যের শিকার হয়েও সমাজে টিকে থাকার অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সমাজের নানা বিড়ম্বনা ও বৈষম্যের শিকার হওয়ার পরেও কেউ কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদেরই একজন আভা মুসকান তিথী। অনলাইন ও অফলাইনে হস্তশিল্পের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে তিথীর ‘চন্দ্রলতা’।
সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় বৈষম্য ও প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তিথী। ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নার্সিংয়ে ইন্টার্নশিপের সময়ও মুখোমুখি হন তিক্ত অভিজ্ঞতার। একটি ওয়ার্ডে প্রবেশ করার সময় একজন রোগী তার ‘হিজড়া’ পরিচয় জানার পর চিৎকার করে তাকে লাঞ্ছিত করেন। এরপর আর এই পেশায় মন বসেনি নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করা তিথীর।
তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে আভা মুসকান তিথী বলেন, “ইন্টার্নশিপ করার সময় একদিন একজন নারী আমার কাছ থেকে সেবা নিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি বলছিলেন, ‘ওনার হাত থেকে চিকিৎসা নেব না। সিনিয়রদের ডাকেন।’ সিনিয়ররা এসে তার কাছে কারণ জানতে চাওয়ার পর ওই নারী বলেন, ‘হিজড়ারা উল্টা-পাল্টা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলবে।’ সেখানে অনেক মানুষ ছিল। এই কথা বলার পর আমি খুবই লজ্জা পেলাম। সেদিন আমি আর সেখানে ডিউটি করিনি। পরে বাসায় এসে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। মনে হলো আমার লিঙ্গ পরিচয়ের কারণেই এই পেশাটা আমার জন্য সঠিক নয়। সেজন্য আর সেই পেশায় থাকিনি।’
আরও পড়ুন
- সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা
- তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কুয়াকাটায় ব্যতিক্রমী আয়োজন
- নিজেদের নির্মিত মসজিদে নামাজ আদায় ও ধর্মীয় শিক্ষা নিচ্ছেন হিজড়ারা
নার্সিং থেকে সরে আসার পর ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করেন তিথী। বিভিন্ন প্রকারের ব্যাগ, শাড়ি ও হাতে গয়না তৈরির সৃজনশীল প্রতিভা কাজে লাগিয়ে খুব স্বল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা।
২০২১ সালে বাসা থেকে বের হয়ে একা জীবনযাপন শুরু করেন তিথী। তবে চলার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল না। গোপনে মায়ের দেওয়া টাকা দিয়ে চলতেন।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিথী বলেন, ‘যখন ব্যবসা শুরু করি আমার পকেটে ছিল মাত্র দুই হাজার টাকা। সেটি দিয়ে শুরু হয় আমার নতুন যাত্রা। প্রথমে চারটি শাড়ি দিয়ে শুরু। এরপর একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে প্রচারের কাজটা করি। তবে সমস্যা হলো আমার ভালো ফোন ছিল না। সুতরাং শাড়ির ছবিও ভালোভাবে তুলতে পারিনি। কিন্তু তারপরও পরিচিতদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা নিয়মিত রেসপন্স করতেন।’
আরও পড়ুন
- ‘বুঝতে হবে ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া এক নয়’
- ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় ও বিধান
- ঢাবিতে কোটায় আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন না লিঙ্গ পরিবর্তনকারীরা
‘তানহা নামের একজন বড় আপু আমাকে সবসময় দিকনির্দেশনা দিতেন, যা আমার জন্য বড় সাপোর্ট ছিল। তিনি আমার মতো বেশ কয়েকজনকে নিয়ে একটি মেলার আয়োজন করেন। সেখানে আমাদের নিজেদের তৈরি পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করা হয়। প্রথমবারের মতো এমন একটি মেলায় অংশ নিয়েছিলাম। আমার নিজের ডিজাইন করা শাড়ি ও গয়না এত বেশি বিক্রি হয় যেটা আমার চিন্তার বাইরে। মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে আমি এসব পণ্য মেলায় তুলেছিলাম। সেখানে আমার প্রায় এক লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। এই ঘটনা আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করে। সেই আয় আমি আমার ব্যবসার পুঁজি হিসেবে কাজে লাগাই। পণ্যে ভিন্নতা আনার জন্য এই টাকা আমার দরকার ছিল।’
তিথী বলেন, এরই মধ্যে ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামের একটি সংস্থা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। সেখানে আমি আবেদন করে সিলেক্ট হই এবং ভালো অঙ্কের পুঁজি পাই। এতে ব্যবসার প্রসার ঘটানোর কাজটাও সহজ হয়ে যায়।
হিজড়াদের একটা বড় অংশ যখন রাস্তাঘাট, যানবাহন, দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে চাঁদাবাজি করছেন কিংবা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন, ঠিক তখন উদ্যোক্তা হয়ে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখেছেন তিথী। তবে জীবনের পদে পদে থাকা বাধা যেন কাটছিল না তার।
আরও পড়ুন
- ‘এখন নিজের ঠিকানা হয়েছে, এমন আনন্দের মুহূর্ত জীবনে আর আসেনি’
- হাতপাতা বন্ধে সুনির্দিষ্ট কর্মসংস্থান চান তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা
- তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণ বোর্ড গঠনের প্রস্তাব
তিথী বলেন, ‘শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি মেলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। কিন্তু পরে যখন ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া নিয়ে একটা বিতর্ক তৈরি হলো তখন কোনো মেলায় অংশ নিতে পারিনি, কোনো ব্যবসাই করতে পারিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। পরে দুইটি মেলায় অংশ নিলেও কোনো বিক্রিই হয়নি। অনেকে দূর থেকে দেখলেও আমার পোশাক কিনতে আসেনি। ছবি তোলে, আমাকে দেখে, হাসাহাসি করে কিন্তু আমার পণ্য কিনতে আসে না। সেসময় খুবই মন খারাপ হয়।’
মেলায় স্টল নিতে গেলে বৈষম্য করা হয় জানিয়ে তিথী বলেন, এক একটা স্টলের টেবিলে যে জায়গা থাকে সেটা হয়ত ১০ থেকে ১৫ ফুট। সেখানে হয়ত ভাড়া হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আমার জন্য এতো ব্যয় বহন করা সম্ভব হয় না। অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাইলেও কেউই আমার সঙ্গে ভাড়া নেন না বা টেবিল শেয়ার করতে চান না। তখন মেলার আয়োজকরা পুরো টেবিল ভাড়া নিতে বলেন, অন্যথায় মেলায় অংশ নিতে পারব না। ফলে এত বিনিয়োগ করে মেলায় অংশ নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।’
আরও পড়ুন
- তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম
- দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ১২৬২৯ জন
- ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ২০ লাখ টাকা দিলেন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা
- দেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ছাত্রনেতা রাজবাড়ীর শিশির
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিজড়াদের জন্য সরকার যদি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে ঋণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয় তাহলে হিজড়া উদ্যোক্তারা আরো ভালো করতে পারবেন বলে মনে করেন তিথী।
তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার মাধ্যমে অন্যদের কর্মসংস্থান হোক। কিন্তু নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ জরুরি। সরকার বলছে আমরা যেন অপরাধমূলক কাজে না জড়িয়ে সুন্দর জীবনযাপনের প্রতি মনোযোগী হই। কিন্তু আমাদের কমিউনিটির সবার কর্মদক্ষতা তো এক নয়। তাই সহজ শর্তে ঋণসহ আমাদের নানান সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে।’ সরকার সে বিষয়ে সহযোগিতা করলে এই জনগোষ্ঠী আরও এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিথী।
আইএইচআর/এএমএ/এমএমএআর/এমএস