দ্বিপক্ষীয় চুক্তি না থাকায় শোষণের শিকার প্রবাসী শ্রমিকরা
উন্নত জীবনমানের আশায় প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু তাদের যাওয়ার পথ বন্ধুর হয় না। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কিংবা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও প্রতারণার শিকার, শ্রম শোষণ, বেতন বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন তারা।
বর্তমান বৈশ্বিক শ্রমবাজারের পরিস্থিতি, শ্রমিকদের বঞ্চনা এবং বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ। সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব থাকছে আজ।
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাই।
আসিফ মুনীর: আমাদের শ্রমবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বলতে গেলে, এটা এখনো ট্র্যাডিশনাল রয়ে গেছে। আমাদের নতুন শ্রমবাজার খুলছে না। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। যেগুলো খোলা আছে সেখানেও কর্মীদের নানাবিধ সমস্যা। এছাড়া দুবাই, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার অস্থিতিশীল। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া নারীদের ভোগান্তি রয়েই গেছে। শ্রমিকদের সঙ্গে দালালদের প্রতারণার ঘটনা কমছে না। অভিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করে অভিবাসন প্রক্রিয়া নিয়মতান্ত্রিক করার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। কারণ বিদেশের সঙ্গে আমাদের অভিবাসন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই। আছে শুধু সমঝোতা স্মারক, তাও পুরোনো। আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নিজেদের যোগাযোগের মাধ্যমে ভিসা নিয়ে আসে। সরকারিভাবে উদ্যোগটা নেই। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা।
‘দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলে বাধ্যবাধকতা থাকে। শ্রমিকরা গিয়ে প্রতারিত হলে জবাবদিহিতার সুযোগ থাকে। ফলোআপ করা যায়। বিদেশ থেকে যে কোম্পানি লোক নেবে তারা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করবে।’
জাগো নিউজ: দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলে শ্রমিকদের কেমন সুবিধা হবে?
আসিফ মুনীর: দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলে বাধ্যবাধকতা থাকে। শ্রমিকরা গিয়ে প্রতারিত হলে জবাবদিহিতার সুযোগ থাকে। ফলোআপ করা যায়। বিদেশ থেকে যে কোম্পানি লোক নেবে তারা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করবে। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, রিক্রুটিং এজেন্সি প্রতিনিধিসহ আন্তর্জাতিক এনজিওর প্রতিনিধিরা থাকবেন। চুক্তি অনুযায়ী, প্রবাসী কল্যাণের নির্দেশনায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো লোক পাঠাবে। তখন এজেন্সিগুলো ব্যবসা করতে পারবে না। মানুষের প্রতারিত হওয়ার হার কমবে।
‘সবসময় সরকার রিক্রুটিং এজেন্সিকে দোষ দেয়, আবার এজেন্সি প্রবাসী কল্যাণকে দোষারোপ করে। শুধু ব্লেইম গেম দিয়ে এ সেক্টর ঠিক হবে না। দুই পক্ষকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’
জাগো নিউজ: এজেন্সিগুলোর সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় কম। কেন এমন হচ্ছে?
আসিফ মুনীর: বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং হয়। সেখানে থাকেন আমলারা। আমি মনে করি প্রবাসী কল্যাণে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ খুবই কম। তারা বিদেশি শ্রমবাজার ও কর্মীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে প্রশিক্ষিত নন। এছাড়া শ্রমিক পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি। তারা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিংয়ে থাকেন না। এজেন্সি বলতে পারবে লোক পাঠাতে সমস্যা কী কী। তারা বলতে পারবে, আমাদের এই সুযোগ দিতে হবে। সবসময় সরকার রিক্রুটিং এজেন্সিকে দোষ দেয়, আবার এজেন্সি প্রবাসী কল্যাণকে দোষারোপ করে। শুধু ব্লেইম গেম দিয়ে এই সেক্টর ঠিক হবে না। দুই পক্ষকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
আরও পড়ুন:
- জুলাই আন্দোলনে প্রবাসীদের আত্মত্যাগ ভাষায় বোঝানো যাবে না
- শ্রমিকের রক্ত চুষছে এজেন্সি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য
- মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে সুযোগ দেওয়ার দাবি
- শাহজালাল বিমানবন্দরে বেড়েছে যাত্রী সন্তুষ্টি, আসছে আরও পরিবর্তন
‘দুবাইয়ে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনাটা মানবিক। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই হয়েছে। মানবিক জায়গা থেকে এবার কাজটা দ্রুত হয়েছে।’
জাগো নিউজ: সম্প্রতি সরকার দুবাইয়ে গ্রেফতার হওয়া লোকজনকে ফিরিয়ে এনেছে এবং লেবাননে অবরুদ্ধ শ্রমিকদের ফিরিয়ে এনেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আসিফ মুনীর: দুবাইয়ে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনাটা মানবিক। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই হয়েছে। মানবিক জায়গা থেকে এবার কাজটা দ্রুত হয়েছে। আবার এখানে যারা আন্তর্জাতিকভাবে অভিবাসন নিয়ে কাজ করে সেসব সংস্থার অবদানও রয়েছে। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়ও এভাবে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আমি এটাকে পলিটিক্যালি দেখি না, এটা মানবিক কাজ। বর্তমান সরকার দেখিয়েছেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে আসলে সব সম্ভব।
‘বাংলাদেশের মানবপাচারের আইনের ধারা ভালো কিন্তু প্রসিকিউশন কম। কারণ মানবপাচারের ক্ষেত্রে দালালদের ধরা, বিচারের আওতায় আনা, শাস্তি দেওয়া এটা একদম কমেছে।’
জাগো নিউজ: আমাদের অভিবাসন নীতিমালায় কোনো ঘাটতি আছে কী?
আসিফ মুনীর: আমাদের সব সেক্টরেই নীতিমালা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। আমাদের দেশে মানবপাচারের যে আইন রয়েছে সেটা নিয়ে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের যে রিপোর্ট হয়, সেখানে সমালোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের মানবপাচারের আইনের ধারা ভালো কিন্তু প্রসিকিউশন কম। কারণ মানবপাচারের ক্ষেত্রে দালালদের ধরা, বিচারের আওতায় আনা, শাস্তি দেওয়া এটা একদম কমেছে। অভিবাসন আইনের ক্ষেত্রে আমি মনে করি যথেষ্ট আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। বিগত সরকারের সময়ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় অভিবাসন সেক্টর নিয়ে পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। পলিসিগত জায়গায় ডকুমেন্ট আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা খুবই কম।
‘সেবা দেওয়াই মিশনের কাজ, তারা সেটা না করতে পারলে আমি মনে করি, মিশন ব্যর্থ। এটা সরকারের দুর্বলতা মনে করি। দুটি মিনিস্ট্রি সরকারের আন্ডারে। ব্লেইম গেম দিয়ে এখন আর চলে না।’
জাগো নিউজ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজে অনেক সংশ্লিষ্টতা থাকে। দুই দপ্তরের সমন্বয় না থাকায় ভুগতে হয় প্রবাসীদের। কেন হচ্ছে? এর সমাধান কী?
আসিফ মুনীর: প্রবাসীরা বিদেশি পাসপোর্ট জটিলতাসহ নানান ভোগান্তিতে পড়েন। প্রবাসীদের ভরসার একমাত্র জায়গা হাইকমিশনে অভিযোগ দেন। নারী শ্রমিকরা নির্যাতিত হয়ে হাইকমিশনের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সেগুলোর সুরাহা হয় না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সবসময় বলা হয় লোকবল কম। কিন্তু লোকবল বাড়ানো হচ্ছে না কেন? আমি মনে করি, সরকারের ওপর থেকে চাপ নেই। এখানে দেখতে হবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কে কাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। হাইকমিশন চলে ওয়েলফেয়ার বোর্ডের টাকায়। অথচ তাদের সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে না। এটা অমানবিক। মিশনের একটা গাড়ি থাকে কর্মীদের সার্ভিস দেওয়ার জন্য। সেটাও পলিটিক্যাল প্রোটোকল দেওয়ার জন্য ব্যবহার হয়। সেবা দেওয়াই মিশনের কাজ, তারা সেটা না করতে পারলে আমি মনে করি, মিশন ব্যর্থ। এটাকে সরকারের দুর্বলতা মনে করি। দুটি মিনিস্ট্রি সরকারের আন্ডারে। ব্লেইম গেম দিয়ে এখন আর চলে না। রাষ্ট্রপ্রধানের দিক থেকে বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
আরও পড়ুন:
- অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ টাকার মধ্যে আনার দাবি
- বৈধপথে অভিবাসন সম্মানের, শান্তিরও
- অবৈধ অভিবাসন বন্ধে উপায় খুঁজছে যুক্তরাজ্য
‘আমাদের দেশে রেমিট্যান্সের ফিগার যা আসে তা কিন্তু যথার্থ তথ্য নয়। আমি মনে করি যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তারও অর্ধেক আসে হুন্ডিতে। সরকার এই সুফল থেকে বঞ্চিত।’
জাগো নিউজ: হুন্ডিতে টাকা পাঠানো কমছে না কেন?
আসিফ মুনীর: আমাদের দেশে রেমিট্যান্সের ফিগার যা আসে তা কিন্তু যথার্থ তথ্য নয়। আমি মনে করি যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে তারও অর্ধেক আসে হুন্ডিতে। সরকার এই সুফল থেকে বঞ্চিত। এখানে সমস্যা হলো বিদেশে বড় বড় ব্যাংকের শাখা আরেক শহরে। ফলে শহর থেকে দূরে যারা বাস করেন তাদের ছুটি নিয়ে শহরে আসা কষ্ট। শ্রমিকরা তো এমনিতেই ছুটি পান না। এজন্য তারা সহজেই হুন্ডিতে পাঠান। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে তারা মুখে মুখে বলেই টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। টাকাও বেশি পাচ্ছেন। অভিবাসীদের জন্য এমন চ্যানেল খোলা উচিত যাতে তারা বৈধপথে যখন ইচ্ছা তখন টাকা দিতে পারেন। দ্রুত পাঠাতে পারবেন। এজন্য মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট করতে হবে। প্রয়োজনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ করতে হবে। টাকা আসবে দ্রুত এবং অফিসিয়াল চ্যানেলে, পদ্ধতিটা হবে সহজ।
আরও পড়ুন:
জাগো নিউজ: মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিক বেশি, কিন্তু রেমিট্যান্স কম। সৌদি আরবে সর্বোচ্চ শ্রমিক থাকার পরেও গত এক বছরে রেমিট্যান্স কমেছে। কারণ কী?
আসিফ মুনীর: আমাদের শ্রমিকরা দক্ষ নন। অধিকাংশ খুবই কম মজুরিতে চাকরি করেন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় টেকনিক্যাল শিক্ষা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের কর্মীরা ভাষার সমস্যার কারণেও ভালো চাকরি পান না। নিজ উদ্যোগেও তারা শেখেন না। কর্মীদের বোঝাতে হবে, একটু ভালো আয় করতে গেলে, ভালোভাবে থাকতে হলে এসব দক্ষতা অর্জন করেই যেতে হবে, না হলে সেখানে গিয়ে পস্তাতে হবে। এছাড়া দালালের ফাঁদে পড়ে অনেক মানুষ বিদেশ যাচ্ছে, আমরা কাউন্ট করছি যে লোকজন বেশি যাচ্ছে, কিন্তু এরা গিয়ে কাজ পাচ্ছে কি না, বেকার আছে কি না, কত পারিশ্রমিক পাচ্ছে সেটার খোঁজ রাখা হয় না।
ফিলিপাইন, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা এরা দেশে থেকেই ইউরোপের কাঠামোয় গড়ে ওঠে। ওদের পড়াশোনায় হাতেকলমে শিক্ষা থাকে। ইউরোপের কাজের সঙ্গে আপডেট থাকে। এজন্য তারা ভালো অ্যামাউন্টের জব পান। দেশের যেসব এলাকা থেকে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেশি, সেসব এলাকায় আলাদা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা যায়।
আরএএস/এসএনআর/এমএমএআর/এমএস