নতুন বছরে দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। চলতি বছর অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি, বন্যা, গ্রীষ্মে তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা, দেরিতে শীত নামা, শৈত্যপ্রবাহ, বছরজুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের ডঙ্কার মধ্যেই কেটেছে দেশবাসীর। প্রতি বছর ঘটছে মৃত্যু, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে নেই উল্লেখযোগ্য টেকসই পরিকল্পনা।
দুর্যোগ এলে সেই অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষার উপায় না খুঁজে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে থাকা দীর্ঘদিনের সাধারণ অনুশীলনে পরিণত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্যোগ পরবর্তীসময়েও বিভিন্ন রোগে প্রাদুর্ভাব প্রাণ হারাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। এতে মানবসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙে পড়ছে অবকাঠামো। এতে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধে পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে যত দিন যাবে, বাংলাদেশ আরও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়বে।
যেমন ছিল চলতি বছরের আবহাওয়া
চলতি বছরের জানুয়ারিতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও অস্বাভাবিক শীতের অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন বিভিন্ন স্তরের মানুষ। কারণ ছিল দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। অন্য বছরের তুলনায় এবার দীর্ঘ সময় ধরে ঘন কুয়াশা পড়তে দেখা যায়। কোথাও কোথাও ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল।
এপ্রিলে ছিল ৭৬ বছরের রেকর্ড তাপপ্রবাহ ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ৩০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা গত ২৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া এপ্রিলে টানা ২৬ দিন তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি।
শুধু তাপপ্রবাহ নয়, সেটি না পেরোতেই সাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। ঘূর্ণিঝড় রিমাল দীর্ঘসময় বাংলাদেশে অবস্থান করে ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত তাণ্ডব চালায়। এতে ১৬ জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়।
আমাদের প্রি-ডিজাস্টারের প্রস্তুতি খুবই কম। দুর্যোগের এখন তিনটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ। কিন্তু সে অনুযায়ী প্রগ্রেসিভ রেসপন্স নেয়নি প্রশাসন। সামনে বন্যা বাড়বে, দুর্যোগ বাড়বে। এজন্য গ্রামীণ পর্যায়ে ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্স দরকার।-চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান
উজানে অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে আগস্টে আকস্মিক বন্যায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। গত ৩৬ বছরে এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি তাদের। অতিবৃষ্টিতে দুই মাস স্থায়ী ছিল নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরের বন্যা। শেরপুর ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাও বন্যাকবলিত হয়। বন্যা ও তাপপ্রবাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
২০২৫ সালে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি কী?
সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে বাড়বে ক্ষতি
জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের প্রি-ডিজাস্টারের প্রস্তুতি খুবই কম। দুর্যোগের এখন তিনটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ। কিন্তু সে অনুযায়ী আমাদের প্রগ্রেসিভ রেসপন্স নেয়নি প্রশাসন। সামনে বন্যা বাড়বে, দুর্যোগ বাড়বে। এজন্য গ্রামীণ পর্যায়ে ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্স দরকার। কিন্তু এগুলো আমাদের দেশে উপেক্ষিত।’
- আরও পড়ুন
- বন্যা পরবর্তী ফেনীতে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট, দিশেহারা কৃষক
- ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ
- ইতিহাসের দীর্ঘতম তাপপ্রবাহ বইছে
- এবার শীত বাড়বে, অতিবৃষ্টি-তাপপ্রবাহ থাকবে আগামী বছরও
তিনি বলেন, ‘সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে প্রায়োগিক কার্যক্রম দরকার। সরকার, প্রাইভেট সেক্টর, জনগণ সবাই মিলে অ্যাকশন প্ল্যান দরকার। পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি সব রিসোর্স কাজে লাগাতে হবে। দেশে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা মোকাবিলায় পূর্ভাবাস দেখেই ফোর্স গঠন দরকার। যেন আকস্মিকভাবে দুর্যোগে কুইক রেসপন্স টিম জরুরি।’
দুর্যোগ মোকাবিলায় সদিচ্ছার অভাব
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জাতীয় কমিটির সদস্য গওহর নঈম ওয়ারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আমাদের সবকিছু আছে, শুধু নেই সদিচ্ছা। আমাদের জিওগ্রাফি এমন এক জায়গায়, দুর্যোগ আসবেই। কিন্তু এগুলো মোকাবিলার মতো যথেষ্ট শক্তি ও সম্পদ আমি মনে করি আছে। শুধু কাজটাই করা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘নিয়ত (ইচ্ছা) ঠিক করলে আমাদের সমস্যা সমাধান হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র আছে। এটার মেয়াদ ২০২৫ সালে শেষ হবে। এটা আজ পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়নি। অথচ বিদেশে বলে বেড়ানো হচ্ছে আমাদের কৌশলপত্র আছে। এটা এক ধরনের প্রতারণা। দেশে সার্কাস চলে। সবার নিয়ত হচ্ছে, দেশ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে চলে যাওয়া। এজন্য নিয়ত, দেশপ্রেম ঠিক না হলে কিছুই হবে না। দেশের জন্য দায়-দরদ সব থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের দুটির একটিও নেই।’
দরকার বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন
এম জাকির হোসাইন খান বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে ফান্ড পাওয়া দরকার। লোন নয়, লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড আদায় করতে হবে। এই ফান্ড আমরা ঠিকভাবে পাচ্ছি না। কারণ আমাদের জবাবদিহি নেই। উন্নত বিশ্ব দেখে আমরা ফান্ডের যথাযথ ব্যবহার করতে পারবো কি না। এজন্য কমিউনিটি লেভেলে গিয়ে রিয়েল টাইমে প্রজেক্ট নিতে হবে। কোটি কোটি টাকার এসব প্রজেক্টের জন্য আমাদের দেশে গবেষণা করা হয় না। আগামী ১০ থেকে ২০ বছর পর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কী কী চ্যালেঞ্জ আসবে, এর ডেটা আমাদের কাছে নেই। ফলে প্রজেক্টের উপকার জনগণ ঠিকভাবে পাচ্ছে না। আবার প্রজেক্ট পাস হলে সেগুলো পাস হয়ে আসতে আসতে চার-পাঁচ বছর লেগে যায়।’
এবারের বন্যায় পশু-পাখি নিয়ে মানুষ প্রাইমারি স্কুলে ছিল। আমরা আরও নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কর্মসংস্থানের প্রকল্প নেবো। দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অধীনে মানুষকে সহায়তার জন্য বর্তমানে আটটি প্রকল্প চলমান।- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান
তিনি বলেন, দেশে যারা বেশি দূষণ ছড়াবে তাদের জন্য কার্বন ট্যাক্স চালু করা দরকার। যে যত বেশি দূষণ করবে, তাকে তত বেশি টাকা দিতে হবে। ফেনী, শেরপুরের বন্যায় অনেক পরিবারের অবলম্বন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি হারিয়েছে। মানুষের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে এসব প্রাণীর নিরাপত্তা দরকার।’
দুর্যোগের যথাযথ পূর্বাভাস দরকার
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে পারি না। আমরা ঝুঁকিতে থাকা দেশ। আমাদের যেটা করতে হবে, জনদুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে। আমি মনে করি এই জায়গায় আমরা খুবই পিছিয়ে আছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতি জেলায় ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স প্ল্যান করা দরকার। প্রতি জেলায় আলাদা শেল্টার সেন্টার দরকার। যেটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে এটা হওয়া উচিত। তাহলে জনদুর্ভোগ কমানো যাবে। প্রতি বছর নদীভাঙন হচ্ছে। এটাও কিন্তু দুর্যোগের ফলে হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উচিত আগে থেকে পূর্ভাবাস দিয়ে এদের সরিয়ে নেওয়া। অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না।’
দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও নতুন প্রকল্প আসছে
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কদিন আগে স্পেনে একটা বন্যা হয়েছে, সেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল দুই শতাধিক। এবছর বাংলাদেশ পাঁচটি বন্যা মোকাবিলা করেছে। মৃত্যু ৭০। প্রতিটি মৃত্যু আমাদের কাছে খুবই বেদনাদায়ক। আমরা কিছু ফ্যাসিলিটি ডেভেলপ করার কারণে মৃতের সংখ্যা কমাতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘দুর্যোগ অধিদপ্তর তিনটি ফেজে কাজ করে। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগকালীন, দুর্যোগ পরবর্তীসময়ে। আমাদের আর্লি ওয়ার্নিং একটা কর্মসূচি থাকে। তিনটি জেলা সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার, কুড়িগ্রামে রিস্ক রিডাকশন প্রোগ্রাম রয়েছে। এটার উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া, দুর্যোগের সময় আমরা কীভাবে তাদের সহায়তা করবো সেটা জানা।’
মহাপরিচালক রেজওয়ানুর বলেন, ‘ঢাকা থেকে গ্রামীণ ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি বানাই। এরা দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করবে। একটা সময় ছিল, দুর্যোগ হলে শুধু মানুষকে সহায়তা করা হতো, এখন পশু-পাখিদের জন্যও শেল্টার রয়েছে। সারাদেশে সাতশর অধিক ফ্লাড শেল্টার আছে। এবারের বন্যায় পশু-পাখি নিয়ে মানুষ প্রাইমারি স্কুলে ছিল। আমরা আরও নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কর্মসংস্থানের প্রকল্প নেবো। দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অধীনে মানুষকে সহায়তার জন্য বর্তমানে আটটি প্রকল্প চলমান।’
আরএএস/এএসএ/এএসএম