ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

কয়লায় জীবন

সাঈদ শিপন | প্রকাশিত: ১০:৪২ এএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নদী, হাওর, টিলা ও পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর, চাঁনপুর, বড়ছড়া, উত্তর বড়দল ও লাকমাছড়া। এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার জীবনের গল্প। সীমান্তজুড়ে ভারতের পাহাড়। সেই পাহাড় ডিঙিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে কয়লা চোরাচালান। অভিযোগ আছে অস্ত্রও আসে কয়লার আড়ালে। এটাই এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের পেশা। বলা চলে কয়লায় গাঁথা জীবন। যে জীবনের অংশীদার শিশুরাও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তর শ্রীপুর, চানপুর, বড়ছড়া, উত্তর বড়দল, লাকমাছড়ার সিংহভাগ বাসিন্দা চোরাকারবারিতে জড়িত। বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও যুক্ত এ অন্ধকার জগতে। চোরাচালানের কেন্দ্রবিন্দু কয়লা। ভারত থেকে অবৈধ পথে আনা চোরাই কয়লা ঘিরে আবর্তিত এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দার জীবন। ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম পাহাড় পাড়ি দিয়ে ভারত থেকে বস্তাবোঝাই করে আনা হয় এই কয়লা।

কোনো কোনো চোরাকারবারি কয়লার বস্তার মধ্যে অস্ত্র ও মাদকও আনেন বলে অভিযোগ। যারা কয়লার বস্তায় অস্ত্র ও মাদক নিয়ে আসেন তারা নিজেরা বস্তা বহন করেন না। ভারত থেকে নিয়মিত কয়লা আনেন এমন ব্যক্তিদের ব্যবহার করেন। এজন্য কয়লার মূল্য ছাড়াও অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হয় বস্তা বহনকারীদের। কয়লার সঙ্গে অস্ত্র ও মাদক আনা ব্যক্তিরা বাংলাদেশ অংশে দু-তিন স্তরে লাইনম্যান রাখেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় মূল ব্যবসায়ীও এই লাইনম্যানের কাজ করেন।

পাহাড় বেয়ে মাথায় করে কয়লার বস্তা আনা খুবই কষ্ট। একটু অসাবধান হলেই পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। আবার পাহাড় পাড়ি দিয়ে সমতলে এলে বিজিবি ধরার ভয় রয়েছে। বিজিবি ধরলে সব মাল নিয়ে যায়। তবে বিএসএফ কিছু বলে না।– কয়লা চোরাচালানকারী আবুল কালাম

ভারতের তারকাঁটার সীমানা অতিক্রম করে পাহাড় থেকেই লাইনম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বস্তা বহনকারীরা। লাইনম্যানের কাছ থেকে পুরোপুরি নিরাপদ সংকেত না পেলে তারা পাহাড় থেকে নামেন না। অনেক সময় পাহাড়ে পাথরের আড়ালে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেন। পুরোপুরি নিরাপদ সংকেত পাওয়ার পর পাহাড় থেকে নেমে চলে যান নিরাপদ স্থানে। যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তারা স্বীকার করেন না। তবে স্থানীয়দের কাছে বিষয়টি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’।

চোরাই পথে আনা কয়লা বিক্রি করে যেমন সংসার চলে, তেমনি কয়লা আনতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। একই সঙ্গে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়। সবকিছু জেনে-শুনেই অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়েছেন উত্তর শ্রীপুর, চানপুর, বড়ছড়া, উত্তর বড়দল ও লাকমাছড়ার বাসিন্দারা।

সীমান্ত দিয়ে দিন ও রাতে অহরহ ব্ল্যাকে কয়লা আসে। ওদের (চোরাকারবারিদের) ভ্যাট, ট্যাক্স লাগে না, উভয়দিকে ম্যানেজ করে মাল নিয়ে আসে। ফলে আমরা যারা বৈধভাবে কয়লা আমদানি করি তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।- কয়লা আমদানিকারক আতিক হোসেন

কয়লা থাকে ডিপোতে, মাদক চলে যায় গোপন স্থানে

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয়ভাবে এই চোরাকারবারির নেতৃত্ব দেন সাদ্দাম, আফজাল, আতিকুল ও রনিসহ কয়েকজন। তারা সব সময় পরিপাটি হয়ে এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন। ভারত থেকে আসা কয়লার বস্তা কিনে নিজেদের ডিপোতে (মজুত রাখার স্থান) রেখে দেন। বস্তায় থাকা মাদক বা অস্ত্র চলে যায় গোপন স্থানে। পরবর্তীসময়ে সেই কয়লা, মাদক ও অস্ত্র ঢাকাসহ দেশের ভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করা হয়।

তবে চোরাই পথে কয়লার বস্তায় মাদক বা অস্ত্র আনার বিষয়টি অস্বীকার করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। অভিযুক্ত রনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শুধু কয়লা কিনি। মাদক বা অস্ত্রের কোনো ব্যবসা আমার নেই। ভারত থেকে কয়লা আনতে আমি নিজে বা আমার কোনো লোক যায় না। আমার কয়লার ডিপো আছে, যে কেউ কয়লার বস্তা এনে আমার কাছে বিক্রি করতে পারে। সেই কয়লা বৈধ নাকি অবৈধ তা আমি বলতে পারবো না। কারণ ভারত থেকে যেমন কয়লা আসে, তেমনি নদী থেকেও কয়লা উত্তোলন হয়।’

নদীর এপারে বাংলাদেশ ওপারে ভারতনদীর এপারে বাংলাদেশ ওপারে ভারত

একই ধরনের কথা বলেন আফজাল। তিনি বলেন, ‘আমার কয়লার ব্যবসা আছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে আমি কয়লা কিনি এবং বাইরে বিক্রি করি। ভালো মানের ৫০ কেজির এক বস্তা কয়লা এক হাজার টাকা। এই কয়লা ডিপোতে রেখে টন হিসেবে বিক্রি করি। লাভ খুব বেশি হয় না। আমার কাজ কয়লা কেনা এবং বিক্রি করা। এই কয়লা কোথা থেকে আসে আমি বলতে পারবো না।’

কয়লার ভ্যাট, ট্যাক্স সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আমাদের শুল্ক স্টেশন নির্ধারিত হারে রাজস্ব আদায় করে। সফটওয়্যারে দিলে ভ্যাট, ট্যাক্স অটো ক্যালকুলেশন হয়ে যায়।- সিলেট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. তাসনিমুর রহমান

লাইনম্যান সংকেত না দিলে পাহাড় থেকে নামেন না বস্তা বহনকারীরা

ভারত থেকে অবৈধ পথে কয়লা নিয়ে আসেন নীলাদ্রি লেকের (শহীদ সিরাজ লেক) পাশের এক বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষই ভারত থেকে কয়লা নিয়ে আসে। এটাই এখানকার প্রধান পেশা। কয়লা আনা ছাড়া আয়ের বিকল্প তেমন কোনো পথ নেই। যে কারণে বাবা-ছেলে একসঙ্গে কয়লা আনার কাজ করে।

তিনি বলেন, যারা শুধু কয়লা আনার কাজ করে তাদের লাইনম্যান থাকে না। কিন্তু কয়লার বস্তায় যারা অস্ত্র বা মাদক নিয়ে আসে তাদের দু-তিন স্তরের লাইনম্যান থাকে। ভারতের তারকাঁটার সীমানা পার হয়ে পাহাড় থেকে কিছুটা নামার পর থেকেই লাইনম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। লাইনম্যান সংকেত দিলে ধাপে ধাপে পাহাড় থেকে নামা হয়। অনেক সময় সংকেত ক্লিয়ার না থাকলে এক-দেড় ঘণ্টা পাহাড়ে পাথরের আড়ালে বসে থাকতে হয়। সংকেত পুরোপুরি ক্লিয়ার থাকলে পাহাড়ের নিচে নেমে গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়েন সবাই। যারা বস্তা বহন করেন তারা গ্রামে ঢুকে পড়ার পর আরও ৫-১০ মিনিট রাস্তায় অবস্থান করেন লাইনম্যানরা।

সীমান্ত এলাকা দিয়ে কয়লা আনা অনেক দিনের প্র্যাকটিস। এজন্য আমরা নিয়মিতভাবে এলাকার লোকজনকে বিওপি লেভেলে বিভিন্ন মতবিনিময় সভা ও মোটিভেশন অব্যাহত রেখেছি।- বিজিবির সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (২৮ বিজিবি) সিও লে. কর্নেল মো. মাকসুদুল আলম

তিনি আরও বলেন, ভারত থেকে আনা কয়লা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কিনে ডিপোতে রাখেন। কয়লার বস্তায় মাদক, অস্ত্র বা অন্য কিছু থাকলে সেগুলো গোপন স্থানে রাখা হয়। সেই গোপন স্থান থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সুকৌশলে মাদক ও অস্ত্র ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। কয়লার বস্তায় মাদক বা অস্ত্র আনা হলে কয়লার মূল্য দেওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে বস্তা আনা ব্যক্তিকে আরও এক-দুই হাজার টাকা বেশি দেওয়া হয়।

বিজিবির হাতে ধরা পড়ে কম

চোরাকারবারিরা অনেক সময় মালামালসহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে ধরা পড়েন। অবশ্য এলাকাটি দিয়ে যে পরিমাণ চোরাকারবার হয়, তার খুব সামান্য অংশ ধরা পড়ে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তাহিরপুর উপজেলা থেকে বিজিবি ১ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৩ টাকার মালামাল আটক করে। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে ৮২ লাখ ৯৯ হাজার ৩২ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৭৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৯১ টাকার মালামাল আটক করা হয়। তাহিরপুর উপজেলায় বিজিবির সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (২৮ বিজিবি) দায়িত্ব পালন করে। বিজিবির বিরেন্দ্রনগর বিওপি, চারাগাঁও বিওপি, বালিয়াঘাটা বিওপি, টেকেরঘাট বিওপি, চাঁনপুর বিওপি এবং লাউরগড় বিওপি এসব মালামাল আটক করে।

সামনেই জিরো পয়েন্ট, শিশুটি ভারতে যাচ্ছে চোরাই কয়লা আনতে/জাগো নিউজসামনেই জিরো পয়েন্ট, শিশুটি ভারতে যাচ্ছে চোরাই কয়লা আনতে/জাগো নিউজ

অক্টোবর মাসে বিরেন্দ্রনগর বিওপি ২ হাজার ২শ কেজি ভারতীয় কয়লা, ৭৫ বোতল মদ এবং এক বোতল বিয়ার আটক করে। যার মূল্য ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৫০ টাকা। চারাগাঁও বিওপি ৫০ হাজার ৬৭০ কেজি ভারতীয় কয়লা, তিনটি স্টিলবডি নৌকা এবং ২৮১ বোতল মদ আটক করে। যার মূল্য ৩৭ লাখ ৪৮ হাজার ২০ টাকা। বালিয়াঘাটা বিওপি ৪ হাজার ৫০০ কেজি ভারতীয় কয়লা, একটি বারকী নৌকা এবং ১৩৪ বোতল মদ আটক করে। যার মূল্য ৩ লাখ ৮৩ হাজার ১০০ টাকা। টেকেরঘাট বিওপি ১৩ হাজার ৫০০ কেজি ভারতীয় কয়লা, ৬০০ ঘনফুট ভারতীয় পাথর, দুটি বারকী নৌকা, ২৫৬ বোতল মদ এবং ১৫২ পিস বিভিন্ন প্রকার কসমেটিক্স আটক করে। যার মূল্য ৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।

এছাড়া চাঁনপুর বিওপি ১৬৬ বোতল ভারতীয় মদ, ১০০ কেজি ফুসকা, ৩ হাজার ৮৪০ পিস সুপারি, ১ হাজার ১৮০ কেজি চিনি, ২০ কেজি জিরা, ১৭৭ পিস বিভিন্ন প্রকার কসমেটিক্স এবং ২১৮ পিস চকলেট আটক করে। যার মূল্য ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪২ টাকা। লাউরগড় বিওপি ২৪ হাজার ৯৫০ কেজি ভারতীয় কয়লা, ৬১৫ ঘনফুট পাথর, ৪০ ঘনফুট বালু, ৭০টি বারকী নৌকা, ৫২৫ বোতল মদ, ৮ বোতল বিয়ার, ১৮৫ কেজি ফুসকা, ৫০ কেজি চিনি, ৩৬ ঘনফুট গোলকাঠ, ১৯০ কেজি আপেল, ১ হাজার ১৫২ পিস ড্রিংকস এবং ২৮০ কেজি রসুন আটক করে। যার মূল্য ২৬ লাখ ৯০ হাজার ৩২০ টাকা।

এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে বিরেন্দ্রনগর বিওপি ৯৩ হাজার টাকা মূল্যের ৬২ বোতল মদ আটক করে। চারাগাঁও বিওপি ১ লাখ ২২ হাজার ২০ কেজি ভারতীয় কয়লা, ৩ বোতল মদ, ১১ হাজার ২০ পিস সুপারি, ৮০ কেজি চিনি এবং একটি মোটরসাইকেল আটক করে। যার মূল্য ২৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫০ টাকা। বালিয়াঘাটা বিওপি ১৬ হাজার ৩০০ কোটি ভারতীয় কয়লা এবং দুটি বারকী নৌকা আটক করে। যার মূল্য ৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। টেকেরঘাট বিওপি ১৬ হাজার ৮৮০ কেজি ভারতীয় কয়লা, একটি বারকী নৌকা, ৯৫ বোতল মদ এবং তিনটি মোটরসাইকেল আটক করে। যার মূল্য ৬ লাখ ৭০ হাজার ৩০০ টাকা।

এছাড়া চাঁনপুর বিওপি ১৫শ কেজি ভারতীয় কয়লা, ৩৫২ বোতল মদ, ১০ হাজার ৯০০ পিস সুপারি, ৫০০ কেজি চিনি, ১৮ কেজি জিরা এবং সাড়ে ৬ কেজি কিশমিশ আটক করে। যার মূল্য ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০ টাকা। লাউরগড় বিওপি ১২ হাজার ৯৪০ কেজি ভারতীয় কয়লা, ১৪৮ কেজি পাথর, ৩২টি বারকী নৌকা, ১৩৩ বোতল মদ, ৩ বোতল বিয়ার, ৪২৮ কেজি ফুসকা, ১৭ হাজার ৫০০ পিস সুপারি, দুটি মোটরসাইকেল, ৯১ ঘনফুট গোলকাঠ, ১২৮ পিস বিভিন্ন প্রকার কসমেটিকিস, সাড়ে ৬৫ কেজি বাংলাদেশি ইলিশ মাছ এবং ৩৪ কেজি বিভিন্ন প্রকার মাছ আটক করে। যার মূল্য ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ৪১ টাকা।

দুই উপায়ে আনা হয় কয়লা

সংসার চালাতে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারত থেকে চোরাই পথে কয়লার বস্তা নিয়ে আসেন আবুল কালাম। কৌশলে তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারত থেকে দুই উপায়ে কয়লার বস্তা আনা যায়। একটি হলো সীমান্তের কাছাকাছি বসবাস করা ভারতীয় নাগরিকদের কাছ থেকে কয়লার বস্তা কেনা। অন্যটি ভারতের কয়লা খনি থেকে নিয়ে আসা। সীমান্তের কাছাকাছি বাস করা ভারতীয়দের কাছ থেকে এক বস্তা কয়লা আনতে ৩শ টাকা দিতে হয়। তবে খনি থেকে কয়লা আনলে তার জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না।

পাহাড় বেয়ে চোরাই কয়লা নিয়ে নামছেন চোরাকারবারিরা/জাগো নিউজপাহাড় বেয়ে চোরাই কয়লা নিয়ে নামছেন চোরাকারবারিরা/জাগো নিউজ

খনি থেকে কয়লা আনতে দু-তিনটি পাহাড় ও দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া লাগে। যে কারণে বেশিরভাগই সীমান্তের কাছাকাছি বাস করা ভারতীয়দের কাছ থেকে কয়লা কিনে আনেন। ভারতীয় অংশের লাকমা ও ৪ নম্বর থেকে বেশি কয়লা আনা হয়। ভারত থেকে নিয়ে আসা ৫০ কেজির এক বস্তা কয়লা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ ভারত থেকে এক বস্তা কয়লা আনলে লাভ হয় ৭শ টাকা। একজন দিনে দু-তিন বস্তা কয়লা নিয়ে আসতে পারেন।

পাহাড় পাড়ি দিয়ে চোরাই পথে কয়লার বস্তা আনার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাহাড় বেয়ে মাথায় করে কয়লার বস্তা আনা খুবই কষ্ট। একটু অসাবধান হলেই পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। পাহাড় থেকে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। আবার পাহাড় পাড়ি দিয়ে সমতলে এলে বিজিবি ধরার ভয় রয়েছে। বিজিবি ধরলে সব মাল নিয়ে যায়। তবে বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী) কিছু বলে না।’

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন এভাবে চোরাই পথে কয়লা নিয়ে আসেন? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পেট আছে। পরিবার, ছেলে-মেয়ে আছে। এই কাজ (চোরাই পথে কয়লা আনা) করা ছাড়া তো আমাদের কোনো উপায় নেই। এখানে চাষের জমি খুব কম। বিকল্প কাজের ব্যবস্থা না থাকায় আমরা বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারত থেকে কয়লা আনি। যদি বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এ কাজে জড়াতাম না।’

যেভাবে পাহাড় বেয়ে নিয়ে আসা হয় চোরাই পণ্য

চাঁনপুরের নীলাদ্রিলেক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। এই পাহাড় বেয়ে প্রতিদিন দলে দলে চোরাই পথে কয়লার বস্তা নিয়ে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ভারত থেকে কয়লার বস্তা নিয়ে খুব সাবধানে সীমান্তের কাঁটাতার পার হন তারা। এরপর কয়লার বস্তা মাথায় অথবা পিঠে বেঁধে ধীরে ধীরে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আসেন। নিচে নামার সময় পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে দু-তিনবার বিরতি দেন। নিচে নেমে দৌড় দিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়েন।

এই রুটে নিয়মিত ভারত থেকে কয়লা নিয়ে আসেন এমন একজন শামছুল। তিনি বলেন, ভারত থেকে কয়লা আনতে আমরা চার-পাঁচজন একসঙ্গে যাই। পায়ে গামবুট ও হাতে দস্তানা পরি। এতে হাত ও পায়ে ব্যথা পাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। ভারত থেকে কয়লা নিয়ে পাহাড়ের নিচে নামা পর্যন্ত তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। শুধু সাবধানে পাহাড় থেকে নামতে হয়। কারণ ভারতের বিএসএফ কিছু বলে না। কিন্তু পাহাড়ের নিচে নামার পর পর বিজিবি ধরার ভয় থাকে।

তিনি বলেন, বিজিবি ধরলে সব মাল নিয়ে নেয়। তখন আমাদের সব লোকসান হয়। বিজিবির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে আমরা রাস্তা ভালো করে দেখে নেই। রাস্তা ফাঁকা থাকলে কয়লার বস্তা মাথায় নিয়ে দৌড়ে গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়ি। গ্রামের ভিতরে ঢুকতে পারলে আর সমস্যা হয় না। এরপর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে মাল কিনে নেয়। আমরা বস্তা হিসেবে বিক্রি করি, আর আমাদের কাছ থেকে যারা কেনেন তারা টন হিসেবে বিক্রি করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই কয়লা চলে যায়।

শামছুল আরও বলেন, আমরা শুধু কয়লা আনি, কয়লার ভেতরে অন্য কিছু আনি না। শুনেছি কেউ কেউ কয়লার বস্তায় অস্ত্র ও মাদক নিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।

চোরাকারবারে জড়াচ্ছে শিশুরা

সংসারে অভাব থাকায় ভারতীয় সীমানা ঘেঁষা এ অঞ্চলটির শিশুরাও জড়িয়ে পড়ছে চোরাকারবারিতে। যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে কাঁধে কয়লা তোলার যন্ত্র ও বস্তা নিয়ে অবৈধ উপায়ে ঢুকতে হচ্ছে ভারতের সীমানায়। কাঁধে কয়লা তোলার যন্ত্র ও বস্তা নিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় বারেকের টিলায় কথা হয় শিশু সাকিবের (ছদ্মনাম) সঙ্গে।

সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম/জাগো নিউজসীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম/জাগো নিউজ

এই বয়সে ভারত থেকে চোরাই পথে কয়লা আনতে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এই শিশু বলে, কয়লা না আনলে আমরা খাবো কী? ঘরে মা আছে, ভাই-বোন। আমি আর আব্বা ভারত থেকে কয়লা আনি। আব্বা আগেই গেছেন। এখন আমি যাচ্ছি। ভারতের বিএসএফ জানে আমরা কয়লা আনতে যাই। তাই বস্তা নিয়ে গেলে ওরা কিছু বলে না। আমি প্রতিদিন এক বস্তা করে কয়লা আনি।

সাকিব বলে, সকালে পানি ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। ওপার থেকে কয়লা এনে দুপুরে বাড়িতে গিয়ে ভাত খাবো। মাথায় করে কয়লার বস্তা আনতে খুব কষ্ট হয়। আমি এ কাজ করতে চাই না। স্কুলে যেতে চাই। কিন্তু কীভাবে স্কুলে যাবো। আমাদের তো টাকা নেই। ভারত থেকে কয়লা না আনতে পারলে পেটে ভাত পড়ে না।

এই শিশু বলে, শুধু আমি না, আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই ভারতে কয়লা আনতে যায়। ভারতের মানুষ আমাদের চেনে। বিএসএফ আমাদের চেনে। কয়লা আনতে যাওয়ার সময় মাঝে মধ্যে বিএসএফ গরুর জন্য, ঘোড়ার জন্য আমাদের দিয়ে ঘাস কেটে নেয়। এক-দুই বস্তা ঘাস কেটে দিলে ওরা খুব খুশি হয়। মাঝে মধ্যে আমাদের খেতেও দেয়।

রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

চোরাই পথে দেদারছে কয়লা আসায় এ অঞ্চল দিয়ে বৈধভাবে খুব একটা কয়লা আসে না। বড়ছড়া, বাগলী ও চারগাঁও- এই তিনটি শুল্ক স্টেশন রয়েছে তাহিরপুরে। এর মধ্যে বড়ছড়া দিয়ে বৈধভাবে কয়লা আসে। চলতি বছর এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে দুদিন কয়লা এসেছে। এর মধ্যে একদিন ছয় ও আরেকদিন ২৪টি গাড়ি কয়লা নিয়ে আসে। প্রতিটি গাড়িতে কয়লা আসে ১২ টন করে। অর্থাৎ ৩০টি গাড়িতে বৈধভাবে কয়লা এসেছে ৩৬০ টন। এর মাধ্যমে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এক টন কয়লার মূল্য নির্ধারণ করা আছে ১১৫ ডলার। প্রতি ডলার ১২০ টাকা করে ধরা হলে এক টন কয়লার মূল্য পড়ে ১৩ হাজার ৮০০ টাকা। আর এক টন কয়লা বৈধভাবে এলে সরকার রাজস্ব পায় (ভ্যাট, ট্যাক্স বাবদ) ৩ হাজার ৫০ টাকার মতো। ডলারের দামের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স কম-বেশি হয়। বড়ছড়া দিয়ে চলতি বছর যে ৩০টি গাড়িতে কয়লা এসেছে, সেখান থেকে প্রতি টনে সরকার রাজস্ব পেয়েছে তিন হাজার ৫০ টাকা করে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তর শ্রীপুর, চাঁনপুর ও বড়ছড়া এলাকার প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ কয়লা চোরাচালানিতে জড়িত। এই এলাকা দিয়ে প্রতিদিন ভারত থেকে অবৈধভাবে কয়লা আসে চার-পাঁচ টন। অর্থাৎ মাসে ১২০ টনের বেশি কয়লা আসে অবৈধভাবে। অবৈধভাবে আসায় এসব কয়লা থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পায় না। বিজিবির চাঁনপুর বিওপির আওতায় এসব এলাকা।

সাদাপাথর সীমান্ত, ওপারে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়/ জাগো নিউজসাদাপাথর সীমান্ত, ওপারে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়/ জাগো নিউজ

ভারত থেকে কয়লা আনার কাজ করা আতিকুল ইসলাম নামে একজন বলেন, আমি একা না, আমাদের এখানকার প্রায় সবাই কয়লা আনার কাজ করে। পাহাড় বেয়ে ভারত থেকে কয়লা আনার কাজে এখানকার প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ জড়িত। প্রতিটি বাড়ির কেউ না কেউ কয়লা আসে। আমাদের হিসাবে ভারত থেকে প্রতিদিন চার-পাঁচ টন কয়লা আসে। আমরা যেদিন কয়লা আনি, সেদিনই বিক্রি করি।

ভারত থেকে বৈধভাবে কয়লা আমদানি করেন এমন একজন ব্যবসায়ী আতিক হোসেন। তিনি সিলেট কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যারা বৈধ আমদানিকারক তারা প্রতি টন কয়লা ১১৫ ডলার করে কিনি। এটা নির্ধারিত রেট। এর ওপর সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স বাবদ তিন হাজার টাকার ওপরে দিতে হয়। এছাড়া মাল খালাস করারও ব্যয় আছে। সব মিলিয়ে এক টন কয়লার জন্য আমাদের ২০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়।

তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে দিন ও রাতে অহরহ ব্ল্যাকে (চোরাই পথে) কয়লা আসে। ওদের (চোরাকারবারিদের) ভ্যাট, ট্যাক্স লাগে না, উভয়দিক ম্যানেজ করে মাল নিয়ে আসে। ফলে আমরা যারা বৈধভাবে কয়লা আমদানি করি তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

এক সময় বগলী এলসি স্টেশনে রাজস্ব কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন মো. নাজমুল হুদা। মাসখানেক আগে তিনি বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এই রাজস্ব কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাহিরপুরে যে তিনটি শুল্ক স্টেশন রয়েছে, এর মধ্যে বড়ছড়া দিয়ে কয়লা আসে। বাকি দুটি স্টেশন দিয়ে কয়লা আসে না।

যোগাযোগ করা হলে সিলেট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. তাসনিমুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়লার ভ্যাট, ট্যাক্স সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আমাদের শুল্ক স্টেশন নির্ধারিত হারে রাজস্ব আদায় করে। সফটওয়্যারে দিলে ভ্যাট, ট্যাক্স অটো ক্যালকুলেশন হয়ে যায়।’

চোরাই পথে কয়লা আসায় সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কী পরিমাণ কয়লা চোরাই পথে আসে সে তথ্য আমার জানা নেই।’

চোরাকারবারি ছেড়ে বৈধ উপার্জনে ফিরছেন কেউ কেউ

অঞ্চলটির সিংহভাগ মানুষ চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত থাকলেও কেউ কেউ তা ছেড়ে বৈধ উপার্জনের পথ ধরেছেন। এমন একজন উত্তর শ্রীপুরের রোহান। এক সময় ভারত থেকে চোরাই পথে কয়লার বস্তা নিয়ে আসা রোহান এখন এলাকাটিতে ইজিবাইক চালান। ইজিবাইক চালিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় করেন এই যুবক।

চোরাকারবারে জড়ানো এবং সেই পথ থেকে ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে রোহান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সংসারে বেশ অভাব ছিল। চাষের জমি নেই। আব্বা খুব কষ্ট করে সংসার চালাতেন। বাধ্য হয়ে সংসারের খরচ জোগাড় করতে একসময় আমিও ভারত থেকে কয়লার বস্তা আনার কাজ শুরু করি।

সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম/জাগো নিউজসীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম/জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ভারতের কিছু খনি আছে, সেখান থেকে ফ্রিতে কয়লা আনা যায়। তবে সেই কয়লা আনতে দু-তিনটি পাহাড় পাড়ি দিতে হয়। একদিন আমরা পাঁচজন খনি থেকে কয়লা আনতে ভোরে ৫টার দিকে বাসা থেকে বের হই। তিনটি পাহাড় পাড়ি দিয়ে এক বস্তা কয়লা আনতে আনতে রাত ৮টা বেজে যায়। এরপর খনি থেকে কয়লা আনা বন্ধ করি।

তিনি আরও বলেন, পাহাড় দিয়ে কয়লার বস্তা আনা খুব কষ্টের কাজ। কিন্তু আমাদের আয়ের অন্য কোনো পথ না থাকায় বাধ্য হয়ে এ কাজ করি। পরবর্তীসময়ে টাকা গুছিয়ে একটি ইজিবাইক কিনি। এখন এই ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাই। আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন। বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা থাকলে আমাদের এলাকার অনেকেই এই কয়লা আনার কাজ ছেড়ে দিতেন।

রোহান বলেন, আমাদের এলাকায় প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল ও কলেজ আছে। কিন্তু হাইস্কুল ও কলেজের লেখাপড়ার মান খুব একটা ভালো না। যারা পড়াশোনায় একটু ভালো তারা সুনামগঞ্জ শহরে বা অন্য কোনো শহরে চলে যায়। এখানে যারা থাকে বেশিরভাগ পড়াশোনা শেষ করতে পারে না। সংসারের খরচ জোগাড় করতে স্কুল, কলেজ ছেড়ে কয়লা আনার কাজে নেমে পড়ে।

সাইফুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, ‘আমরা চোরাকারবার করতে চাই না। কিন্তু জীবন বাঁচাতে এ কাজ করতে বাধ্য হই। মাছ ধরা এবং ভারত থেকে কয়লা আনা এখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। আয়ের বিকল্প পথ থাকলে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় বেয়ে মাথায় করে কয়লার বস্তা নিয়ে আসতাম না।’

যা বলছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা

যোগাযোগ করা হলে তাহিরপুরের উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সেলিনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, কে চোরাই পথে কয়লা আনে, কে মাদক আনে সেটা আমি বলতে পারবো না। এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তবে আমাদের এখানে আয়ের পথ খুব কম। চাষের জমিও অল্প।

পাহাড় বেয়ে চোরাই কয়লা নিয়ে নামছেন চোরাকারবারিরা/জাগো নিউজপাহাড় বেয়ে চোরাই কয়লা নিয়ে নামছেন চোরাকারবারিরা/জাগো নিউজ

সাধারণ মানুষ বৈধভাবে যাতে আয় করতে পারে, সে বিষয়ে আপনাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কথা অনেক বলা যায়, কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। এখানে আয়ের বিকল্প কী ব্যবস্থা করবো আমরা।’

চোরাচালান বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে জানতে চাইলে বিজিবির সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (২৮ বিজিবি) সিও লে. কর্নেল মো. মাকসুদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা দিয়ে কয়লা আনা অনেক দিনের প্র্যাকটিস। এজন্য আমরা নিয়মিতভাবে এলাকার লোকজনকে বিওপি লেভেলে মতবিনিময় সভা ও মোটিভেশন অব্যাহত রেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও আমি বড়ছড়া এলাকায় গিয়েছিলাম। তাহিরপুরের ইউএনও এবং ওসি গিয়েছিলেন। আমরা গিয়ে বেশকিছু মাছ ধরা উপকরণ সরবরাহ করেছি এবং পেশাগত পরিবর্তন আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। এলাকার ৮০ শতাংশ মানুষই কিন্তু এসব কাজের (চোরাচালান) সঙ্গে জড়িত। গত দুই মাসে আমাদের আটক করা লোক ও মাদকের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি ইলিগ্যাল ক্রসিং (চোরাচালান) বন্ধ করা বা কমানোর।’

‘তাহিরপুর ট্যুরিস্ট স্পট। ট্যুরিস্ট স্পট কেন্দ্র করে বাইক, অটোরিকশা চালানো, তারপর নৌকা এগুলো চিন্তা করলে তাদের পেশাগত পরিবর্তন কিন্তু আনা সম্ভব। স্থানীয়দের চোরাচালান বাদ দিয়ে বৈধ পেশা বেছে নেওয়ার জন্য মোটিভেশন করছি।’

সীমান্ত দিয়ে অবৈধ কয়লার মধ্যে অস্ত্র আনার অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে লে. কর্নেল মো. মাকসুদুল আলম বলেন, কয়লার ভেতরে অস্ত্র আসে, এমন কোনো কিছু আমরা পাইনি। তবে গত তিন মাসে যৌথবাহিনীর অভিযানে একটি অবৈধ রিভলবার উদ্ধার হয়েছে। অস্ত্রটি একটি বাসায় থাকার ইনফরমেশন ছিল, কিন্তু ওখানে সেটা পাওয়া যায়নি। পরে একটি দোকানে পাওয়া যায়।

কয়লার ভেতরে অস্ত্র আসে স্থানীয়দের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে, উল্লেখ করলে মাকসুদুল আলম বলেন, স্থানীয়রা তো অনেক কিছু বলে। এমনটি হলে কোনো না কোনোভাবে তো আমরা ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে জানতে পারতাম। আমার কাছে মনে হয় এটি রিউমার।

তাহিরপুর সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় আমাদের দুটি ক্যাম্প আছে। ওখানে টহল ডিউটি আছে। আমরা নিয়মিত মামলা দিচ্ছি। পুলিশের যা যা করা দরকার আমরা করছি।’

এমএএস/এএসএ/জিকেএস