ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

মুসা আহমেদ | প্রকাশিত: ১১:৫৯ এএম, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

পুরান ঢাকার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। ঐতিহ্য বিবেচনায় প্রায় ২২শ বাড়ি না ভাঙতে রয়েছে আদালতের নির্দেশনা। এসব ভবন মালিক তাদের স্থাপনা ভাঙা কিংবা নতুন ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না। জরাজীর্ণ হওয়ায় বাড়ছে বসবাসের ঝুঁকি। এসব বাসিন্দাকে পুনর্বাসনেও নেই সরকারের কোনো উদ্যোগ।

আবার পুরান ঢাকার কোন বাড়িগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে বা ভাঙার বিষয়ে আইনগত বাধা আছে তা অনেক বাড়ির মালিকই জানেন না। এসব বাড়ির মালিকদের কোনো চিঠিও দেয়নি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কিংবা সিটি করপোরেশন। ফলে অনেকে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ভবন করতে গিয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ভাষ্য, ২০১২, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার প্রায় ২২শ বাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে রিট করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই রিটের আদেশে বাড়িগুলোর প্রত্নতত্ত্ব বিবেচনা করে সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে বলা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করেনি সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি। তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় ভবন মালিকদের নোটিশ, চিঠিও দিতে পারছে না তারা। ফলে পুরোনো বাড়ি ভাঙা ও নতুন ভবন নির্মাণে জটিলতা সৃষ্টি হয়।

পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভবন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উচ্চ আদালতে রিট করে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপ (ইউএসজি)। এর মধ্যে ২০১৮ সালের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এসব বাড়ি অক্ষত রেখে সেগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য নির্ণয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। মাঠপর্যায়ে জরিপ করে সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল ও নিষ্পত্তির আগে এসব স্থাপনায় কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না বলে আদেশ দেন আদালত। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে পারেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

রিটকারী আরবান স্টাডি গ্রুপ

আরবান স্টাডি গ্রুপ জানায়, উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনার পর বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো কাজ করেনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বিষয়টি তারা আদালতকেও অবহিত করেনি। অথচ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, এমন প্রায় এক হাজার বাড়ি বা স্থাপনা পুরান ঢাকায় রয়েছে। গত সাত বছরে আনেক ভবন গোপনে ভেঙে ফেলেছেন ভবন মালিকরা। অথচ একটি দেশ, শহরের ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভবনগুলোর গুরুত্ব রয়েছে।

আদালতে রিট করার পর ভবনগুলোর ঐতিহ্য যাচাই করতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি।- আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম

আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আদালতে রিট করার পর ভবনগুলোর ঐতিহ্য যাচাই করতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। তারা একবার জানিয়েছিল, ‘এ কাজ করতে তাদের বহুদিন (১০ বছর) লাগবে। তখন আমরা বলেছিলাম, তিন মাস পরপর কাজের অগ্রগতি জানিয়ে আদালতে রিপোর্ট করতে। কিন্তু তারা তা নিয়মিত করেনি। তবে জানতে পেরেছি, তারা প্রায় ৪শ ভবন পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ১০-১২টা ভবন সংরক্ষণ করার মতো পেয়েছে বলে শুনেছি।’

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ) আফরোজা খান মিতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংরক্ষণে আরবান স্টাডি গ্রুপের রিটের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কাগজ পেতে দেরি হয়েছে। এজন্য প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে তথ্য সংগ্রহ ও নকশা করতে দেরি হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক জায়গায় বাধার সম্মুখীন হয়েছি।’

পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের শেষ দিকে পরিদর্শন করা বাড়িগুলোর (প্রায় ১৮৫৭) তালিকা খসড়া করেছি। বাকি বাড়িগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। গত জুনের দিকে অংশীজনদের নিয়ে বৈঠকও করেছি। চলতি বছরই বাড়িগুলোর তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। এরপর নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।’

পৈতৃক ভবন ভেঙে বিপাকে ভবন মালিকরা

গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের ৩৮ দশমিক ৩ কাঠা জায়গার মালিক সুমন চক্রবর্তী ও তার সাত ভাই (চাচাতো ভাই চারজন)। সম্প্রতি তারা তাদের একটি একতলা পুরোনো ভবনের বেশির ভাগ অংশ ভেঙে ফেলেন। উদ্দেশ্য নতুন ভবন নির্মাণ। তখন ভবনটির গুরুত্ব তুলে ধরে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে আরবার স্টাডি গ্রুপ। পরে গত ২৮ অক্টোবর ভবনটি ভাঙার কাজে বাধা দেয় গেন্ডারিয়া থানা পুলিশ। একইভাবে রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকেও তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তখন পুলিশ, রাজউক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ভবন মালিকদের জানানো হয়, এই স্থাপনাটি না ভাঙতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কেন আদালত নির্দেশনা দিয়েছে, কে রিট করেছে, রিটের কারণ কী তার কিছুই জানেন না ভবন মালিকরা।

ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংরক্ষণে আরবান স্টাডি গ্রুপের রিটের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কাগজ পেতে দেরি হয়েছে। এজন্য প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে তথ্য সংগ্রহ ও নকশা করতে দেরি হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক জায়গায় বাধার সম্মুখীন হয়েছি।- প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ) আফরোজা খান মিতা

ভবনটি সরকার ঘোষিত কোনো পুরাকীর্তি অথবা তালিকাভুক্ত ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় ছিল না বলে জানান ভবন মালিক সুমন চক্রবর্তী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আরবান স্টাডিজ গ্রুপের তালিকা অনুযায়ী আমাদের বাড়িটি আছে কি না, তা আমরা জানি না। বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরুর আগে আদালত, প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর, আরবান স্টাডিজ অথবা সিটি করপোরেশন কারও পক্ষ থেকে কোনো নোটিশ বা চিঠি পাইনি। বাড়ি ভাঙার প্রায় শেষ পর্যায়ে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ভবনটিতে এখন আমাদের থাকার কোনো উপায় নেই।’

পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

তবে আরবান স্টাডি গ্রুপ সূত্র জানায়, দীননাথ সেন রোডের এ বাড়িটির নির্মাণকাল ১৮৯৮ সাল। একতলা বাড়িটিতে নিও ক্লাসিক্যাল রীতিতে নির্মিত পাঁচটি খিলান ছিল, এর মধ্যে তিনটির অভ্যন্তরের অলংকৃত অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে ভবনটি এখনো যে অবস্থায় রয়েছে, নকশাগুলো সংরক্ষণ ও ছাদ পুনর্নির্মাণ করে সংস্কার করা সম্ভব। তার জন্য যেটা প্রথমেই দরকার হবে, তা হলো ভবনটি সুরক্ষিত করা।’

কিন্তু উচ্চ আদালতে রিটের বিষয়টি কেন আগে ভবন মালিকদের জানানো হয়নি, তার সদুত্তর দিতে পারেননি আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক (ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ) আফরোজা খান মিতা।

ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস

পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার রোডের দুপাশে অর্ধশত ভবন আরবান স্টাডি গ্রুপের ওই রিট তালিকায় আছে। ফলে জরাজীর্ণ এসব বাড়িও ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে পারছেন না মালিকরা। আবার তাদের ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনও করছে না সরকার।

পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা নারায়ণ চন্দ্র জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাঁখারীবাজারের অধিকাংশ পুরান ভবনে থাকার ব্যবস্থা নেই। ভবনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওই রিট আদেশের কারণে ভবনগুলো ভেঙে নতুন ভবন করতে পারছেন না মালিকরা। আবার সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করছে না।’

এমএমএ/এএসএ/এএসএম