খানাখন্দে ভরা রাজধানীর সড়ক, অলিগলিতেও নেই স্বস্তি
• মেয়র-কাউন্সিলর না থাকার প্রভাব পড়েছে সড়কে
• ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে আওয়ামীপন্থি ঠিকাদাররা
• সড়ক সংস্কারে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই দুই সিটি করপোরেশনের
বর্ষা মৌসুমে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টি নতুন নয়। এবারের পরিস্থিতি অতীতের চেয়েও যেন খারাপ। মূল সড়ক, অধিকাংশ অলিগলির সড়কের অবস্থাই বেহাল। আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে আওয়ামীপন্থি সব মেয়র-কাউন্সিলর। যার একটি বড় প্রভাবও রয়েছে সড়ক সংস্কারে।
এ পরিস্থিতি থেকে রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই দুই সিটি করপোরেশনের। তীব্র যানজট, দূষণের পাশাপাশি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করায় শহরে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক সড়কে যান চলাচলও বন্ধ। আবার কোথাও অবস্থা এমন যে হেঁটে চলারও সুযোগ নেই।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্টদের দাবি, চলতি বর্ষা মৌসুমে অতিভারী বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ঢাকার সড়কের এই বেহাল দশা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির দুই মেয়রসহ অধিকাংশ আওয়ামীপন্থি কাউন্সিলর, ঠিকাদার আত্মগোপনে চলে যান। এতে সড়কে সংস্কার কাজ বন্ধ রয়েছে। এসব কাজের পুনঃদরপত্র আহ্বান করার প্রস্তুতি চলছে।
সরকার পরিবর্তনের পর অধিকাংশ ঠিকাদার আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার চলমান বর্ষায় অনেক সড়কে পানি জমে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বড় গর্তগুলোতে সাময়িকভাবে ইটপাথর দিয়ে সমান করছি। আকাশ ভালো থাকলে বিটুমিনও দিচ্ছি। চলতি মাসব্যাপী এ কার্যক্রম চলবে।- ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম
জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্যমতে, ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার (ডিএনসিসি ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার, ডিএসসিসি ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা নিয়ে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি গঠিত। এর মধ্যে ডিএসসিসি এলাকায় ৯৯৩ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। ডিএনসিসি এলাকায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সড়ক। এখন এসব সড়কের এক-তৃতীয়াংশ এখন ভাঙাচোরা।
ডিএসসিসি
যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত সড়কটির নাম শহীদ ফারুক রোড। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কে শত শত ছোট-বড় গর্ত। এর মধ্যে দয়াগঞ্জ বাজার অংশের অবস্থা ভয়াবহ। এখানে সড়কের প্রায় সব ইটপাথর উঠে গেছে। পানি জমে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে সড়ক। একইভাবে জুরাইন রেলগেট থেকে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত সড়কটিও চলাচলের অনুপযোগী। এ সড়কের অবস্থা এতটাই খারাপ যে উল্টে যাওয়ার ভয়ে বড় যানবাহন চলছে না। যে কয়েকটি যানবাহন চলছে, সেগুলো খুবই ঝুঁকি নিয়ে চলছে।
লেকপাড়ের এই সড়কটি দিয়ে খুব সহজেই গুলশান, বনানী, বারিধারা যাতায়াত করা যায়। কিন্তু সড়কটি দিন দিন নালায় পরিণত হচ্ছে। ঠিকমতো যানবাহন চলতে পারছে না। অথচ এ সড়কটি সংস্কার করলে প্রগতি সরণিতে গাড়ির চাপ কিছুটা কমতো।- শাহজাদপুরের বাসিন্দা ইমরুল কায়েস
গেন্ডারিয়া থেকে রিকশায় করে দয়াগঞ্জে যাচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দয়াগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী ও দয়াগঞ্জ থেকে জুরাইন- এ দুটি সড়ক তিন-চার বছর ধরে এমন বেহাল অবস্থায় রয়েছে যে চলতে গিয়ে যানবাহন উল্টে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ নীরব।’
রাজধানীর খিলগাঁও থেকে সবুজবাগ, মুগদা, মানিকনগর, গোলাপবাগ হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত সড়কে (অতীশ দীপঙ্কর সড়ক) দিনে হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু এ সড়কেও শত শত গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গর্তে পানি জমে থাকতে দেখা যায়।
- আরও পড়ুন
- ঢাকার ২৩ সড়ক ডুবে বিকল যানবাহন, তীব্র ভোগান্তিতে নগরবাসী
- একটুখানি বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় ঢাকা
- রাজধানী যেন খোঁড়াখুঁড়ির নগরী
- ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ
সবুজবাগের বাসিন্দা নুর আলম বলেন, ‘চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই অতীশ দীপঙ্কর সড়কে ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়। এসব গর্তের চারপাশ ভেঙে দিন দিন বড় হচ্ছে। ফলে যানবাহন তার নির্ধারিত গতিতে চলতে পারছে না। আবার সড়ক শুষ্ক থাকলে ধুলাবালির জন্য হাঁটাচলা করা যায় না।’
গত এপ্রিলে মুগদা থেকে মান্ডা যাওয়ার সড়ক চওড়া করতে রাস্তার দুই পাশের দোকানপাট ও বাড়িঘর ভেঙে দেয় ডিএসসিসি ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। পরে এ সড়ক সংস্কারে কাজ পায় পিআইপিএ-এমই (জেভি) নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুল হক বাবু। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে তিনি লাপাত্তা। ফলে সড়কটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে রয়েছে।
এদিকে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য চার মাসের বেশি সময় ধরে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এখন সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ। পথচারীদের হেঁটে চলাচলেও সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া নর্থ-সাউথ রোড, নয়াবাজার, বাবুবাজারের প্রধান সড়কগুলোও খুঁড়ে রাখা হয়েছে। আবার মৌচাক, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, আজিমপুর, পলাশী, লালবাগের বিভিন্ন রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়।
ডিএসসিসির প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, গত ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গোপনে দেশ ছাড়েন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। পরে আওয়ামীপন্থি কাউন্সিলর এবং ঠিকাদাররা আত্মগোপনে চলে যান। তারপর থেকেই ডিএসসিসির সব উন্নয়ন কাজ থমকে যায়, যা এখনো স্বাভাবিক হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর অধিকাংশ ঠিকাদার আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার চলমান বর্ষায় অনেক সড়কে পানি জমে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো আমরা সংস্কার শুরু করছি। অর্থাৎ, বড় গর্তগুলোতে সাময়িকভাবে ইটপাথর দিয়ে সমান করছি। আকাশ ভালো থাকলে বিটুমিনও দিচ্ছি। চলতি মাসব্যাপী এ কার্যক্রম চলবে।’
তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের রাস্তাঘাটের অবস্থা এবং ঠিকাদারদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন যেসব ঠিকাদার সময়মতো কাজ শেষ করেননি, তাদের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।’
ডিএনসিসি
শাহজাদপুরের বাঁশতলা রোড থেকে গুলশান লেকের পাড় হয়ে বাড্ডা লিংক রোডের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এই দূরত্বের সড়কটি প্রায় তিন বছর ধরে খানাখন্দ অবস্থায় পড়ে আছে। বৃষ্টি হলে সড়কের গর্তে পানি জমে। আবার বৃষ্টি না থাকলে ধুলাবালিতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। অথচ গুলশানের মতো এলাকায় যাতায়াতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বাড্ডা লিংক রোড থেকে বাঁশতলা পর্যন্ত সড়কটি ছোটবড় গর্তে ভরা। এসব গর্তে বৃষ্টির পানি জমে আছে। রিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত যানবাহন তার নির্ধারিত গতিতে চলতে পারছে না। আবার একইভাবে বাড্ডা লিংক রোড থেকে দক্ষিণ বাড্ডা (পুলিশ প্লাজার দিকে) পর্যন্ত লেক পাড়ের সড়কটিতেও খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকটি গর্তে স্থানীয়দের উদ্যোগে ইট-বালি ফেলতে দেখা গেছে।
শাহজাদপুরের বাসিন্দা ইমরুল কায়েস বলেন, ‘লেকপাড়ের এই সড়কটি দিয়ে খুব সহজেই গুলশান, বনানী, বারিধারা যাতায়াত করা যায়। কিন্তু সড়কটি দিন দিন নালায় পরিণত হচ্ছে। ঠিকমতো যানবাহন চলতে পারছে না। অথচ এ সড়কটি সংস্কার করলে প্রগতি সরণিতে গাড়ির চাপ কিছুটা কমতো।’
প্রগতি সরণির নদ্দা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড সড়কটি পাতাল রেলের কাজ চলমান থাকায় অর্ধেকই খোঁড়া। এর শাখা সড়কগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ রকম খারাপ। যানবাহন চলাচল বন্ধ। মানুষ হেঁটে চলার পথও সংকুচিত। কাদাপানিতে ঠিক গ্রামীণ সড়কের রূপ পেয়েছে বসুন্ধরা ওভারব্রিজ গেট থেকে জোয়ার সাহারা বাজারগামী সড়কটি। এ এলাকার বাসিন্দারা বিকল্প পথ হিসেবে অনেকটা ঘুরে চলাচল করছেন। দুর্ভোগের শেষ নেই এলাকাবাসীর।
মহাখালী থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলে দিনে শত শত বাস যাত্রী পরিবহন করে। অথচ এ টার্মিনালের সামনের রাস্তাটিও ভাঙা। কয়েকটি স্থানে রাস্তা উঁচু-নিচু হয়ে আছে। কোনো যানবাহন দ্রুত গতিতে চলতে পারছে না। একইভাবে তেজগাঁও সাতরাস্তা, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ইন্দিরা রোড, মিরপুরের বিভিন্ন সড়কসহ নতুন ওয়ার্ডগুলোর বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দ।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর ঠিকাদাররা আত্মগোপনে চলে যান। তখন তাদের প্রতিষ্ঠানের লোকজনও কাজ ফেলে চলে গেছে। আবার ডিএনসিসি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে যেসব সড়কে সাময়িক মেরামত করে, শ্রমিকের অভাবে সেগুলোও নিয়মিত করা যায়নি। ফলে এখন শহরের অনেক জায়গায় রাস্তা ভাঙার অভিযোগ পাচ্ছি। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করছি।’
এমএমএ/এএসএ/জিকেএস