ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

পলিথিনের সহজলভ্য বিকল্প কী, সমাধান কোন পথে?

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ০৫:১২ পিএম, ০১ অক্টোবর ২০২৪

দেশের সুপারশপগুলোতে আজ (১ অক্টোবর) থেকে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপ বা এর সামনে ক্রেতাদের কেনার জন্য পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধে খুশি হলেও মাছ, মাংস, ডাল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্য কীভাবে পলিব্যাগ ছাড়া নেবেন তা নিয়ে চিন্তিত ক্রেতারা। যুক্তিযুক্ত বিকল্পও চান তারা।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পাট মন্ত্রণালয় সব সুপারশপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারেও পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হচ্ছে। একই সঙ্গে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হবে ওই সময় থেকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন প্রণয়নের ২২ বছর হলেও এত বছর পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়নি, আইন প্রয়োগ করা হয়নি। এখন যেহেতু নির্দেশনা আসছে, তাই সুপারশপগুলোতে পলিথিনের পর্যাপ্ত বিকল্প রাখতে হবে। ব্যাগের সর্বোচ্চ সাপ্লাই থাকতে হবে, না হলে মানুষকে ব্যাগ ব্যবহারে বাধ্য করা যাবে না।

আমাদের যে টিস্যু ব্যাগ, জালি ব্যাগ ছিল সেগুলো সরানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ দিয়েছে। যার মূল্য ৬ থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। কাস্টমারদের সেগুলো কিনে মালামাল নিতে হবে।-‘স্বপ্ন’ মালিবাগ আউটলেটের ম্যানেজার হাফিজ হোসেন

বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুপারশপ স্টোরগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যাগ আছে কি না এটা পরিবেশ অধিদপ্তরকে তদারকি করতে হবে। ব্যাগের দাম কম নাকি বেশি সেটাও দেখতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের মনিটরিংয়ে রাখা যায়। ব্যাগ ব্যবহার মানুষের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। যারা বাজারে জুট ব্যাগ তৈরি করবে, তাদের প্রথম দিকে ট্যাক্সমুক্ত রাখতে হবে।’

‘যারা এখনো পিলিথিন ব্যবহার করবে তাদের পলিউশন ট্যাক্স দেওয়া উচিত। শপগুলোতে ব্যাগ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে, তাহলে মানুষও কিনতে বাধ্য হবে।’

পলিথিনের সহজলভ্য বিকল্প কী, সমাধান কোন পথে?

যা ভাবছে সুপারশপগুলো

‘স্বপ্ন’ মালিবাগ আউটলেটের ম্যানেজার হাফিজ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে আমাদের শপের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমাদের যে টিস্যু ব্যাগ, জালি ব্যাগ ছিল সেগুলো সরানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ দিয়েছে। যার মূল্য ৬ থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। কাস্টমারদের সেগুলো কিনে মালামাল নিতে হবে।’

অ্যাগোরা মগবাজার ব্রাঞ্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটলেট ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা আগে কখনো পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করিনি। এতদিন টিস্যু ব্যাগ (নন-ওভেন) ও কাগজের ব্যাগ ছিল সেগুলোও আজ থেকে বন্ধ। আজ থেকে পাটের ব্যাগের ব্যবস্থা রয়েছে। কাস্টমরারও নিজ দায়িত্বে ব্যাগ নিয়ে আসবেন।’

পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ, যা ভাবছেন ক্রেতারা

দেশে প্রথম পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। এরপর থেকে আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় ২২ বছর পলিথিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। বিশেষ করে শহরের মানুষ ব্যাগ ছাড়াই বাজারে যেতে অভ্যস্ত। বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত না করে নিষিদ্ধ করায় কেউ কেউ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা সালেহ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তার যথাযথ বিকল্প আছে কি না সেটা সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে গ্রোসারি (মুদি) মাল প্রতিটি আইটেমের জন্য একটি করে পলিথিন দরকার হয় সেখানে হঠাৎ করে এত ব্যাগ থাকবে কি না সেটা একটা বিষয়। ব্যাগের দাম, ব্যাগ কতদিন টেকসই হবে এগুলোও খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাগ ব্যবহার করতে আমাদের সমস্যা নেই, কিন্তু সেটি দামে মানে ঠিক থাকলে প্রশ্ন থাকবে না।’

পলিথিন নিষিদ্ধ হলো, কিন্তু বিস্কুটের প্যাকেট থেকে শুরু করে দুধ, মসলাসহ যত প্যাকেটজাতীয় পণ্য রয়েছে সেগুলো নিষিদ্ধ হবে কবে। সুপারশপে মাছ, মাংস কীভাবে নেবে। নিরুপায় হয়ে পলিথিনে নিতে হয়, সেটার বিকল্প তৈরি করতে হবে।-ক্রেতা জহিরুল

আরেক ক্রেতা জহিরুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘পলিথিন নিষিদ্ধ হলো, কিন্তু বিস্কুটের প্যাকেট থেকে শুরু করে দুধ, মসলাসহ যত প্যাকেটজাতীয় পণ্য রয়েছে সেগুলো নিষিদ্ধ হবে কবে। সুপারশপে মাছ, মাংস কীভাবে নেবে। কাগজের ব্যাগে তো নেওয়া যায় না। নিরুপায় হয়ে পলিথিনে নিতে হয়, সেটার বিকল্প তৈরি করতে হবে।’

সোনালি ব্যাগ কবে আসবে বাজারে?

সোনালি ব্যাগ দেখতে প্রচলিত পলিথিনের মতোই। এটি হালকা-পাতলা ও টেকসই। পাটের সূক্ষ্ম সেলুলোজ প্রক্রিয়াজাত করে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ মাটিতে ফেললে তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশ দূষিত হবে না। একটি ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।

পলিথিনের সহজলভ্য বিকল্প কী, সমাধান কোন পথে?

জানা যায়, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ। এক কেজিতে গড়ে ১০০ ব্যাগ করা যায়। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫ টন সোনালি ব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

জানা যায়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পাটের ব্যাগ নিয়ে ক্যাম্পেইনটা করছে। পাটের ব্যাগ সম্প্রসারণে পরিবেশ অধিদপ্তর পাট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করছে।

জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) মনিটরিং অ্যান্ড এক্সটেনশন এক্সিকিউটিভ মো. মোজাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পলিথিন নিষিদ্ধের ঘোষণার পর থেকে আমরা পাটের ব্যাগ বা পাট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে এমন উদ্যোক্তা ও সুপারশপ মালিকদের সঙ্গে বসেছি। স্বপ্ন, আগোরাসহ বড় শপগুলো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাগ বানিয়ে নিচ্ছে। তারা এভাবে চুক্তির মাধ্যমে দর-দাম করে ব্যাগ কেনাবেচা করছে। আমাদের ৯৭৫ জন উদ্যোক্তা রয়েছে যারা পাটজাতীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে। আশা করি সংকট হবে না। তবে সুতা, ফেব্রিক্স অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়লে অসুবিধা। আমরা চাই পাটজাতীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হোক।’

পলিথিন নিষিদ্ধ আইনে শাস্তি

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে।

২২ বছরে বাজার থেকে ওঠেনি নিষিদ্ধ পলিথিন

জানা যায়, দেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর বিধান অনুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সে সময় পরিবেশ অধিদপ্তর শর্তসাপেক্ষে সব রকমের পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, মজুত ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে। এরপর দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও যত্রতত্র পলিব্যাগের ব্যবহার বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চললেও উৎপাদন ও সরবরাহ কমেনি। সাবেক পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী গত ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে জানান, গত পাঁচ বছরে ছয় কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ১৭০ জনকে। জব্দ করা হয়েছে দুই হাজার টনের বেশি মালামাল।

পলিথিন যেভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নদী কিংবা সমুদ্রগুলোতে অনেক বেশি প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলার কারণে তা পানির নিচে স্তূপ হয়ে আছে। এই অপচনশীল জিনিস থেকে নদীর মাছ, দ্রব্য ও সামুদ্রিক মাছ খায়। আর এসব মাছ খাওয়ার কারণে আমরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগি। এছাড়া মাইক্রো প্লাস্টিক এখন হার্টে পাওয়া যায়, লাল শাকে পাওয়ার খবর কিছুদিন আগে গবেষণায় এসেছে। পলিথিনের কারণে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে।’

পলিথিন নিষিদ্ধের আইন করার ২২ বছর হলো তবুও বাজারে পলিথিন বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আইনের প্রয়োগ ছিল। এখন অনেকেই বলে পলিথিনের বিকল্প নেই। তখন বিকল্পও ছিল। তাহলে এত বছর কেন পলিথিনের বিকল্প বাজারে এলো না।- এসডো মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন

জানা যায়, পলিথিন থেকে বিষফেনোল নামে বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, বরং মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হয় এসব পলিথিন ব্যাগ। ম্যানহোল, নালা, খাল, নদীতে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো বৃষ্টি হলে পানি নিষ্কাশনে বিপত্তি ঘটায়। পানি নামার পথ রুদ্ধ হয়ে থাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।

পলিথিন নিষিদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের দাবি

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পলিথিন নিষিদ্ধের আইন করার ২২ বছর হলো তবুও বাজারে পলিথিন বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আইনের প্রয়োগ ছিল। এখন অনেকেই বলে পলিথিনের বিকল্প নেই। তখন বিকল্পও ছিল। তাহলে এত বছর কেন পলিথিনের বিকল্প বাজারে এলো না।’

পলিথিনের সহজলভ্য বিকল্প কী, সমাধান কোন পথে?

তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগ করতে ২২ বছর লাগলো কেন। রুয়ান্ডা, কেনিয়ায়ও আইন প্রয়োগ হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ প্রথম দেশ, যে পলিথিন নিষিদ্ধ করে। মূলত প্রশাসনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না, ফলে আইন প্রয়োগ হয়নি।’

মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে জানিয়ে ড. শাহরিয়ার বলেন, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস, তাদের সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। সুপারশপ থেকে যারা কেনাকাটা করে তাদের ব্যাগ কেনার সামর্থ্য রয়েছে। খোলাবাজারে ব্যাগের দাম নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তবে আমরা চেষ্টা করছি ক্রেতার নাগালের মধ্যে রাখার জন্য। আশা করি ব্যাগ ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।’

পর্যাপ্ত ব্যাগ মজুত আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যাগের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাগ তৈরি করবে। হয়তো প্রথম দিকে সংকট দেখা দেবে। কিন্তু ক্রেতারা পাটের ব্যাগ কিনলে সেটা অনেকদিন ব্যবহার করতে পারবেন। একটা ১০ টাকার ব্যাগ ২/৩ মাস ব্যবহার করা যায়। মানুষের রি-ইউজের প্রবণতা বাড়বে।’

আরএএস/এএসএ/এএসএম