ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-চেন্নাইয়ে বন্ধ একের পর এক ফ্লাইট, ব্যবসায় ধস
আকাশপথে যাত্রী সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্সগুলো। দেশের কয়েকটি এয়ারলাইন্স এরই মধ্যে ঢাকা থেকে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কয়েকটি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট কমিয়েও পর্যাপ্ত যাত্রী পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ও ভারতের এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকেই আকাশপথে এই অচলাবস্থা তৈরি হয়। এখন ভারত সীমিত আকারে ভিসা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারপরও এয়ারলাইন্সগুলোতে যাত্রী সংকট কাটছে না।
আবার যারা ভারতের ভিসা পাচ্ছেন বা আগের ভিসা আছে তাদের অনেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যাচ্ছেন না। কারণ, তারা মনে করছেন এখন বিমানবন্দর দিয়ে ভারত যেতে চাইলে হয়রানি হতে হবে। আওয়ামী লীগপন্থি হলে আটক বা গ্রেফতারেরও ভয় রয়েছে। এমন নানা কারণে ভারতের বিভিন্ন রুটে যাত্রী সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার, ভারতের ভিস্তারা এয়ারলাইন্স, এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো। সংস্থাগুলো ঢাকা থেকে ভারতের কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই ও মুম্বাই রুটে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ধারণক্ষমতার ৫০ শতাংশও যাত্রী পাচ্ছে না এয়ারলাইন্সগুলো।
ঢাকা থেকে কলকাতা, চেন্নাই ও দিল্লি রুটে ধারণক্ষমতার গড়ে ৫০ শতাংশ যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। বাকি সিটগুলো ফাঁকা থাকছে। তবে এসব ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরার সময় কিছুটা বেশি যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সরকারের আমলা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধরতে বেশ কয়েকটি নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। যেমন বোর্ডিং পাস দেওয়া থেকে শুরু করে ইমিগ্রেশনে প্রত্যেক যাত্রীর কাগজপত্র ও পরিচয় অধিকতর যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যারা পেশাজীবী, তাদের প্রতিষ্ঠানের এনওসি (অনাপত্তিপত্র) না থাকলে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরও জেরা করা হচ্ছে। তবে এ কাজে সাধারণ যাত্রী যাতে হয়রানির স্বীকার না হন, সেদিকে সবাই সতর্ক রয়েছেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
ঢাকা থেকে ভারতের কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লিতে আকাশপথে যাত্রী পরিবহন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কিন্তু এ পথে গড়ে ৫০ শতাংশ যাত্রীও পাচ্ছে না সংস্থাটি। ফলে আগে যেখানে ঢাকা-কলকাতায় ১৪টি ফ্লাইট চলতো এখন সেখানে মাত্র সাতটি ফ্লাইট (দিনে একটি) চলছে। একইভাবে দিল্লিতে আগে প্রতিদিন একটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করতো বিমান। এখন সেখানে সপ্তাহে চারটা এবং চেন্নাইয়ে সাতটির জায়গায় তিনটি ফ্লাইট চলছে। এ অবস্থায় পরিচালন ব্যয় তুলতেই হিমশিম খাচ্ছে বিমান।
আরও পড়ুন
- ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট/আসন ফাঁকা রেখেই উড়ছে বিমান, মাসে লোকসান ২০ কোটি
- শাহজালাল বিমানবন্দরের সেবায় আমূল পরিবর্তন, খুশি যাত্রীরা
- বিমানে এবার অভিজ্ঞ এমডি, সেবায় পরিবর্তনের প্রত্যাশা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বোসরা ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে কলকাতা, চেন্নাই ও দিল্লি রুটে ধারণক্ষমতার গড়ে ৫০ শতাংশ যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। বাকি সিটগুলো ফাঁকা থাকছে। তবে এসব ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরার সময় কিছুটা বেশি যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।’
ধারণক্ষমতার ৫০ শতাংশ যাত্রী হলে পরিচালনা ব্যয় উঠছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বোসরা ইসলাম বলেন, ‘বিমান একটি সেবামূলক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যে যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে, তাতে খরচ উঠছে। একেবারই না পারলে হয়তো ফ্লাইট আরও কমানো বা বন্ধ করবে কর্তৃপক্ষ।’
ভারত ভিসা না দেওয়ায় টিকিট বিক্রিসহ অন্য কাজে ট্রাভেল এজেন্টদের ৭০ শতাংশ ব্যবসা কমে গেছে। অথচ আগে সারা বছরই ভারতে পর্যটক, ব্যবসায়ীরা যেতেন। এছাড়া চিকিৎসার জন্য কলকাতা, চেন্নাইতেও প্রচুর রোগী যেত।- আটাব সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ
ইউএস-বাংলা
ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ভারতের কলকাতায় সপ্তাহে ২১টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। এখন যাত্রী সংকটে ১৫টি ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় সব ফ্লাইটই বন্ধ। এছাড়া ঢাকা থেকে চেন্নাই রুটে সপ্তাহে ১১টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো ইউএস-বাংলা। এখন সেটি কমিয়ে পাঁচে নামানো হয়েছে।
জানতে চাইলে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম জাগো নিউজ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর ভারতের ভিসা ইস্যু সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বাংলাদেশ থেকে কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লিসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রী সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমেছে। এতে এয়ারলাইন্স ব্যবসায় ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অচলাবস্থা দ্রুত কাটাতে হবে।’
নভোএয়ার
ঢাকা থেকে কলকাতা রুটে এটিআর ৭২-৫০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে সপ্তাহে সাতটি ফ্লাইট পরিচালনা করতো নভোএয়ার। এ এয়ারক্রাফটের ধারণক্ষমতা ৭০ জন। ৫ আগস্টের পর ক্রমেই যাত্রী কমতে থাকে। এক পর্যায়ে অর্ধেক সিট ফাঁকা রেখেই ফ্লাইট চালায়। পরবর্তীসময়ে পরিচালন ব্যয় তুলতে না পারায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে সাময়িকভাবে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে নভোএয়ার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও কলকাতায় ফ্লাইট চালু করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ভারতের ভিস্তারা এয়ারলাইন্স, এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সও নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে। একই কারণে এ এয়ারলাইন্সগুলোও তাদের ফ্লাইট কমিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণত পর্যটক, চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসার কাজে লাখো মানুষ ভারতে ভ্রমণ করেন। শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের একদিন পর বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১১ আগস্ট সীমিতি আকারে ভিসা সেন্টার খুললেও আগের আবেদনের ভিসা বা পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছিল। এখন শুধু মেডিকেল ভিসার আবেদন জমা নিচ্ছে। অর্থাৎ, কেউ চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে চাইলে তাকে আগে চিকিৎসার সব কাগজপত্র ভিসা সেন্টারে জমা দিতে হবে। ভিসা সেন্টারের লোকজন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে। পরে ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে বলে।
ভারত পর্যটক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখায় অর্থনীতির সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ভারত ভিসা না দেওয়ায় টিকিট বিক্রিসহ অন্য কাজে ট্রাভেল এজেন্টদের ৭০ শতাংশ ব্যবসা কমে গেছে। অথচ আগে সারা বছরই ভারতে পর্যটক, ব্যবসায়ীরা যেতেন। এছাড়া চিকিৎসার জন্য কলকাতা, চেন্নাইতেও প্রচুর রোগী যেত।’
এমএমএ/এএসএ/এমএস