বিশ্ব দরবারে জনভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার বার্তা দেবেন ড. ইউনূস
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এবার অনেকটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এবারের অধিবেশনে অংশ নেবে ৫৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল। প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন বলে জানা যায়।
তথ্য অনুযায়ী, ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের বিতর্ক পর্ব শুরু হচ্ছে। এ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ২৩ সেপ্টেম্বর একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে নিউইয়র্ক পৌঁছাবেন। সেখানে অবস্থান করবেন তিনদিন। ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য রাখবেন।
এবছর জাতিসংঘের সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য- ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক মর্যাদার অগ্রগতির জন্য একযোগে কাজ করা।’ বিশ্বব্যাপী আস্থার সংকট, বহুপাক্ষিকতা, আলোচনার পথ উপেক্ষা করার ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে কার্যকর এবং সমন্বিত পদক্ষেপের অনুপস্থিতি প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত অর্থবহ।
নতুন একটি পরিস্থিতির মধ্যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এ সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের এজেন্ডায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিটি বিষয় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সব প্রাসঙ্গিক ইভেন্টে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবো।- পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে এক ধরনের সমস্যায় আমরা ভুগছি। দাতা সংস্থা আগে সহায়তা দিলেও সেটি অনেকটা কমে গেছে। তাই তাদের জন্য যে ব্যয় হয় সেটি বড় চাপ হয়ে যাচ্ছে সরকারের জন্য। বিষয়টি তুলে ধরা হবে বিশ্ব নেতাদের সামনে। একই সঙ্গে নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়ার যে সুযোগ নেই, সেটিও জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে।’
- আরও পড়ুন
- চার্টার্ড নয়, বাণিজ্যিক ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন ড. ইউনূস
- ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস
- নিউইয়র্কে ড. ইউনূস-জো বাইডেন বৈঠক হবে
কূটনীতিকরা বলছেন, বিশেষ সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করছে। সময়টা অনেক চ্যালেঞ্জিং, তাই যুক্তরাষ্ট্রের এ সফর অনেক গুরুত্ব বহন করছে। এটিই ড. ইউনূসের প্রথম সফর হওয়ায় বাড়তি আগ্রহ রয়েছে সবার। তবে প্রধান উপদেষ্টার পরিচিতি ও সুনাম বিশ্বব্যাপী হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এবছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এবছরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বাংলাদেশ একটি উচ্চ-পর্যায়ের রিসিপশনের আয়োজন করছে। এ রিসিপশনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের প্রধানদের পাশাপাশি জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, কিছু দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থা প্রধানরা অংশ নেবেন।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য
জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয় থাকতে পারে।
যত বৈঠক
প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও অংশ নেবেন। তিনি নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, ইউএসএইডের প্রশাসক প্রমুখের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। তবে অনেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তেও হতে পারে। সে বিবেচনায় নতুন বৈঠক তালিকায় যোগ হতে পারে। আবার সময়ের অভাবে কোনো বৈঠক বাদও যেতে পারে। অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ড. ইউনূসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।
সাইড লাইন
এবারের সাধারণ অধিবেশনের সাইড লাইনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও বেশ কয়েকটি আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামিট অব দ্যা ফিউচার। এর সংযুক্তি হিসেবে ডিক্লারেশন অন দ্যা ফিউচার জেনারেশনস এবং গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্ট শীর্ষক আরও দুটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হবে। এই তিনটি ডকুমেন্টের চলমান নেগোসিয়েশন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে।
এছাড়া জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মন্ত্রী পর্যায়ের সভা, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভা, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সভা, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বার্ষিক মন্ত্রী পর্যায়ের সভা, এশিয়া সহযোগিতা সংলাপের মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় যোগ দেবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গেও বৈঠক হবে তার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, জাতিসংঘের অগ্রাধিকার ইস্যুগুলো প্রত্যেক বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুগুলোর ওপর যেসব ইভেন্ট আছে, বাংলাদেশ তার সব কয়টিতেই সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মনে করে। সার্বিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করবে বলে আশা করা যায়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন একটি পরিস্থিতির মধ্যে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এ সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের এজেন্ডায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিটি বিষয় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সব প্রাসঙ্গিক ইভেন্টে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবো। রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের সাইড ইভেন্টও আয়োজন করা হবে। এ ধরনের বেশ কিছু কর্মসূচি আমাদের রয়েছে।’
আইএইচআর/এএসএ/জিকেএস