ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

সিদ্ধান্ত গ্রহণের মারপ্যাঁচে টালমাটাল প্রশাসন

মাসুদ রানা | প্রকাশিত: ০৮:৩৬ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে চলছে সংস্কার। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে চলছে রদবদল। চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে অনেককে। কেউ কেউ হচ্ছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)। একই সঙ্গে বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হচ্ছে।

এসব কাজ করতে গিয়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সিদ্ধান্ত গ্রহণের মারপ্যাঁচে পড়ে অনেক যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তা পদোন্নতি, গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পাননি বলে অভিযোগ তুলে প্রতিবাদও করেছেন। কর্মকর্তারা নজিরবিহীনভাবে জানিয়েছেন তাদের ক্ষোভ। এটি প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। যদিও পরে সিদ্ধান্ত সংশোধনের চেষ্টাও ছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর।

একই সঙ্গে প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের। বিলম্ব সিদ্ধান্তে অস্থিরতায় টালমাটাল প্রশাসন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ-কর্মে নেমেছে স্থবিরতা।

তবে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, তারাও দায়িত্বে নতুন। পদোন্নতি-পদায়নের ক্ষেত্রে তাদের ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। ভুল ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছেন তারা। তবে ত্রুটি ধরা পড়লেও যতটা সম্ভব সংশোধন করেও নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।

এক মাসের রদবদল
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির দিনে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট শপথ নেয় ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। রয়েছেন ২০ জন উপদেষ্টা।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের মারপ্যাঁচে টালমাটাল প্রশাসন

গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, ২৮তম বিসিএস থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বিপিএসসি (সরকারি কর্মকমিশন) সুপারিশ করলেও অনেকে নিয়োগবঞ্চিত হয়েছেন। ৮ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত তাদের ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, গত এক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৯৮টি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনপ্রশাসনে ১৩৫ জনকে অতিরিক্ত সচিব, ২২৭ জনকে যুগ্মসচিব ও ১২০ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ৬৭ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ওএসডি করা হয়েছে ১০ জন যুগ্মসচিব, আটজন অতিরিক্ত সচিব ও ছয়জন সচিবকে।

পুলিশের ৮০ জন ডিআইজি, ৩০ জন পুলিশ সুপারসহ ১১০ জনকে পদোন্নতি, একজন ডিআইজি, একজন অতিরিক্ত ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপারকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এছাড়া আইজিপিসহ ১০ জন অতিরিক্ত আইজি, ৮৮ জন ডিআইজি, ২১ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ১৭৭ জন পুলিশ সুপারসহ মোট ২৯৭ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পদোন্নতির তালিকায় ‘বিতর্কিত’ কর্মকর্তারা
অন্তর্বর্তী সরকার যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে মোট ৪৮২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। অভিযোগ ওঠে এদের মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের কেউ কেউ অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভাগীয় মামলায় পেয়েছিলেন শাস্তি। কেউ কেউ ছিলেন পতন হওয়া আওয়ামী লীগের নানা অপকর্মের সহযোগী। এখন মওকা বুঝে ‘বঞ্চিত’ সেজে অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।

প্রত্যাহারের ২০ দিন পর ডিসি নিয়োগ
গত ২০ আগস্ট ২৫ জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে কর্মকর্তাদের সরানোর সিদ্ধান্ত হয় ফিটলিস্ট না করেই। এমনিতেই সরকার পতনের পর কোনো কোনো জেলা থেকে ডিসিরা স্বেচ্ছায় চলে এসেছিলেন। প্রত্যাহারের আদেশ জারির পর যারা কাজ করছিলেন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কোনো কোনো জেলায় কাজ-কর্মে নামে স্থবিরতা। বন্যাকবলিত জেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ব্যাহত হয় বলেও অভিযোগ ওঠে।

পরে ডিসি ফিটলিস্ট করে ২০ দিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর এসব জেলায় ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়।

ডিসি নিয়োগ: সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের নজিরবিহীন বিক্ষোভ-হট্টগোল
গত ১০ সেপ্টেম্বর ৩৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগের দিন নিয়োগ দেওয়া হয় ২৫ জেলায়। দুদিনে ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়।

ডিসি পদে নিয়োগপ্রত্যাশী উপসচিব পদমর্যাদার ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা ১০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নিজেদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এমন ক্ষোভ প্রকাশ, হট্টগোল এর আগে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা।

‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের দাবি, যাদের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। গত সরকারের অনুগত থাকায় তারা ভালো জায়গায় চাকরি করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। তারা ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিল চান।

পরে ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন- মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এমন আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ফিরে যান তারা। তবে পরদিনও সচিবালয়ে হট্টগোল করেন কর্মকর্তারা।

বাতিল হয় ৯ ডিসির নিয়োগ
প্রতিবাদের মুখে ১১ সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। ওইদিন লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, দিনাজপুর ও রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসকের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পি কে এম এনামুল করিমকে সিলেটের ডিসি হিসেবে নিয়োগও বাতিল করা হয়। যদিও পরে তাকে ওএসডি করা হয়েছে।

ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর ফেনীর সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এনামুল করিমের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এনামুল করিম ২০১৯ সালে ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বাঁচাতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। মৃত্যুর আগে নুসরাত জাহান রাফি ও তার মা শিরিন আক্তার ন্যায়বিচারের আশায় তার কাছে গিয়েছিলেন। এরপর এনামুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ ওঠে। একই সঙ্গে ডিসি নিয়োগ পাওয়া চারজনের জেলাও বদলে দেওয়া হয়।

এখনো শূন্য ৭ সচিব পদ
প্রশাসনে সাত সচিব ও সচিব পদমর্যাদার পদ খালি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন সচিবদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা এবং রদবদলের কারণে এসব সচিবের পথ শূন্য হয়েছে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের মারপ্যাঁচে টালমাটাল প্রশাসন

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (কার্যক্রম বিভাগ), বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) চেয়ারম্যানের (সচিব) পদ খালি রয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়।

একজন উপদেষ্টার হাতে একাধিক মন্ত্রণালয়, এর ওপর সচিব না থাকায় এসব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

স্বাস্থ্যের ডিজি নিয়োগ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, পরে বাতিল
গত ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারীদের একাংশের বাধার মুখে তিনি অফিসে ঢুকতে পারেননি।

গত ১৯ আগস্ট তার পদত্যাগের দাবিতে মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে এক সভায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনেই হট্টগোল করেন চিকিৎসক-কর্মচারীরা। পরে বিএনপিপন্থি স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবির মুখে রোবেদ আমিনকে ডিজির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

পরে গত ১২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার শীর্ষ পদে নিয়োগ নিয়ে অস্থিরতাসহ নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য
গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের আমলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন কিংবা দায়িত্ববিহীন অবস্থায় একই পদে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের সবার কথা বিবেচনায় নিয়ে জনপ্রশাসনকে দাঁড় করানোই ছিল প্রথম মাসের কঠিনতম সময়। সব সমস্যার সমাধান করে একটি নতুন জনপ্রশাসন কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি, এটিই আমাদের প্রথম মাসের সবচেয়ে বড় অর্জন।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে নানা বিচ্যুতির বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘আপনি এই চেয়ারে বসেন, আমি সাংবাদিক হই। সত্যি কথা বলতে আমরা কী ভালো মানুষ? আমি সহকর্মী ভুল তথ্য দিচ্ছি, আমি তথ্য গোপন করছি। ১৫ দিন রাত ১১টা পর্যন্ত ডিসিদের ফিটলিস্ট করতে ইন্টারভিউ নিয়েছি। ৬০০ অফিসারের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের আরও সচেতনতার সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমরা করছি। তারপরও আমরা মানুষ। কোথাও কোনো ফাঁক-ফোকর থাকলে আপনারা ধরিয়ে দেবেন। আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

আরএমএম/এএসএ/জেআইএম