স্পিকারের পদত্যাগে কি সাংবিধানিক সংকট হবে?
২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটানা স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। পরদিন ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তার ২৭ দিন পর পদত্যাগ করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এই পদত্যাগের পর কিছু সাংবিধানিক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। স্পিকারের পদত্যাগ নিয়ে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। স্পিকারের পদত্যাগ নিয়ে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর স্পিকার হলেন রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী। সংসদ ভেঙে দিলেও তার পদ যায় না। পদত্যাগ করলেও নতুন স্পিকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি পদে আছেন বলে ধরে নিতে হয়। পরবর্তী সংসদের সদস্যদের শপথ পড়ানোর ভার তার ওপরই বর্তায়। এমনকি রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পিকারকেই রাষ্ট্রপ্রধানের ভার নিতে হয়। এখন, সেই স্পিকার যখন পদত্যাগ করলেন, কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা কি তৈরি হলো?
স্পিকার পদত্যাগ করে ভালো কাজ করেছেন
স্পিকারের পদ শূন্য হওয়ায় পরবর্তী সংসদের এমপিদের শপথ পড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের বিনা ভোটে অবৈধ পার্লামেন্টের প্রধান। ডকট্রিন অব নেসিসিটি সারা ওয়ার্ল্ডে এক্সসেপটেড। এতোদিন যে উনি স্পিকার হিসেবে কাজ করলেন সে তো নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ছিল। উনি যদি মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ হয়ে থাকেন, এ ধরনের একটা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করা খুবই অন্যায়। তার নিজের আসনেও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। এসব খারাপ কাজ করার পর উনি নিজে থেকে পদত্যাগ করে সরে গেছেন, ভালো কাজ করেছেন।’
তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে কিনা এমন প্রশ্নে সুব্রত চৌধুরী জানান, এটা তদন্তসাপেক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয়। তার (পদত্যাগকারী স্পিকার) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতেও পারে। কারণ এ সরকারের অবৈধ কাজে যারা সাহায্য-সহযোগিতায় ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেও হতে পারে। এই সরকারের যারা সহায়ক শক্তি ছিল, তারা সবাই পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হবে।
- আরও পড়ুন
- স্পিকার পদ থেকে পদত্যাগ করলেন শিরীন শারমিন
- স্বামী-সন্তানসহ শিরীন শারমিন চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব
- এবার রংপুরে সাবেক স্পিকারের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা
স্পিকারের পদত্যাগের কারণে সাংবিধানিক শূন্যতা হবে না জানিয়ে সুব্রত চৌধুরী বলেন, পরবর্তীতে সংসদে যারা বসবেন তারাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেটি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, প্রবাসী সরকার যখন গঠন করা হলো তখন অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আমাদের দেশে অতীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়েছে, এখনো ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরে সরকার গঠন করা হয়েছে। এখানে ডকট্রিন অব নেসেসিটির মাধ্যমে হতে পারে।
ডকট্রিন অব নেসেসিটি কাজ করবে
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। স্পিকার তো নেই, প্রধানমন্ত্রীও নেই,বিরোধী দলীয় নেতাও নেই, চিফ হুইপও নেই, কেউই নাই সংসদে। এখন প্রশ্ন পরবর্তী সংসদের কী হবে? আমি মনে করি না যে সংসদের স্পিকার পদত্যাগ করলে দেশে কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। কারণ দেখুন না সংবিধানে অনেক কিছুই ছিল, আর্টিকেল-৭ (ক) ছিল, (খ) ছিল এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ছিল না। সেখানে ক্রাইসিস মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স চেয়েছিল, যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, এক্ষেত্রে কী করার। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর আমরা পরবর্তী সময়ে দেখলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে গঠন করেছে। সেখানে কোনো ব্যক্তির জন্যে রাষ্ট্রের অবস্থা স্থবির থাকে না, বন্ধ থাকে না। স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, কী কারণে করেছেন তা আমি জানি না। তবে ওনার পদত্যাগের কারণে দেশে কোনো সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে না।’
পরবর্তী নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের শপথ পড়াবেন কে? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন জানান, যখন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তখন দেখবেন।
আইন এবং সংসদ কী বলছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডকট্রিন অব নেসেসিটিতে অন্তর্বর্তী সরকার আসছে, সে সময় সিচুয়েশন অনুযায়ী ডকট্রিন অব নেসেসিটি কাজ করবে।
কিন্তু সংবিধানে বলা আছে পদত্যাগ করার পরও স্পিকার স্বপদে বহাল থাকবেন এমন প্রশ্নে মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘খোদা না করুক স্পিকার যদি তখন মারা যান তখন কী হবে বা হতো, সিচুয়েশন আসুক। একটাই মেসেজ, সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে না।’
সংবিধান দিয়ে কিছু হলে তো সাংবিধানিক প্রশ্ন
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী সংসদ গঠন না করা পর্যন্ত স্পিকার পদে থাকেন। পরবর্তী স্পিকার আসার পর হ্যান্ডওভার হয় চার্জ। স্পিকার ইচ্ছে করলেই পদত্যাগ করতে পারেন। উনি ইচ্ছে করেছেন, পদত্যাগ করেছেন।
সাংবিধানিক কোনো সংকট হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দেশে সংবিধান দিয়ে কোনটা হচ্ছে? সংবিধান দিয়ে কিছু হলে তো সাংবিধানিক প্রশ্ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তো সংবিধানে নেই। এগুলো যেহেতু একটি বিপ্লবের মাধ্যমে, অতএব তারা ইচ্ছে মতো করবে। সংসদ বসলে সেটি ঠিক করে নিবেন। সংবিধান নিয়ে তখনই আলোচনা হবে পাওয়ারটা কী? আপনি সকেট যেখানে ঢোকালেন, সেখান দিয়ে বিদ্যুৎ এলে তো লাইনের লাইট বা বাতি জ্বলবে, আয়রন চলবে বিদ্যুৎ এলে। সেখানে যদি সকেট খুলে রাখেন, বিদ্যুৎ থাকা না থাকা নিয়ে কিছু আসে যায় না।’
- আরও পড়ুন
- পলকের দুই আগ্নেয়াস্ত্র স্পিকারের রুম থেকে গায়েব!
- এ সংবিধান রেখে স্বৈরতন্ত্রের বিলোপ ঘটানো যাবে না: আলী রীয়াজ
- পুনর্লিখনে সংবিধান হোক জনবান্ধব
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংসদ নেই, স্পিকার থাকলেই কী করবে? সংসদ যেহেতু নেই, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন ভালো। উনি থাকলেই বা কী হতো।’
এই মুহূর্তে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা নেই
স্পিকারের পদত্যাগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা নেই। মোদ্দা কথা হলো স্পিকার ড. শিরীন শারমিন ৭৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পদত্যাগপত্র দিয়েছেন, পদত্যাগপত্র জমা দিলে সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ডেপুটি স্পিকার তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন স্পিকার দায়িত্ব গ্রহণ না করবেন, ততক্ষণ ডেপুটি স্পিকার দায়িত্ব পালন করবেন। স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, তা গৃহীতও হয়েছে; ডেপুটি স্পিকার জেলে। তিনি জেলে আছেন ঠিক, কিন্তু তিনিতো কেবল অভিযুক্ত এখনও। উনি জেলে থাকলেও সমস্যা নেই। ওনার তো কাজ নেই।’
অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘শূন্যতা তখন সৃষ্টি হবে যখন পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হবে, তখন যদি তাকে না পাওয়া যায়। তখন যদি সমস্যা হয় সে সময় শূন্যতা তৈরি হলে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশন থেকে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভাইজরি ওপেনিয়ন (মতামত) চাইবেন। যেভাবে অর্ন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের সময় তাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল।’
সংবিধানের ৭৪ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– স্পিকারের পদ পাঁচ কারণে শূন্য হতে পারে, যদি (ক) তিনি সংসদ-সদস্য না থাকেন; (খ) তিনি মন্ত্রী-পদ গ্রহণ করেন; (গ) তার অপসারণ দাবি করে সংসদে আনা কোনো প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হয়; (ঘ) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করেন এবং (ঙ) কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনো সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন।
গত ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি যখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিলেন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর এমপি পদও শূন্য হয়ে গেছে। তাহলে ৭৪ (২) অনুচ্ছেদের ‘ক’ দফা অনুযায়ী তখনই কি তার স্পিকার পদ শূন্য হয়ে গিয়েছিল?
এ ব্যাপারে সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্পিকারের পদ শূন্য হলে বা তিনি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলে সংসদ নির্ধারণ করলে তার সব দায়িত্ব পালন করবেন ডেপুটি স্পিকার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু গত ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার হয়েছেন। একটি হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে পুলিশ রিমান্ডেও পাঠিয়েছে আদালত।
সংবিধানের ৭৪(৩) অনুচ্ছেদ বলছে, ডেপুটি স্পিকারের পদও যদি শূন্য হয়, তাহলে সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধি অনুযায়ী কোনো সংসদ-সদস্য তা পালন করবেন। কিন্তু এখন তো সংসদই ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
৭৪(৬) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমতো স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলিয়া গণ্য হবে।
- আরও পড়ুন
- জাতীয় সরকার ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা করতে চায় বিএনপি
- নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও র্যাবের বিলুপ্তি চান বিশিষ্টজনেরা
- সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমাহীন, এটা পরিবর্তন করা হবে
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীও তার উত্তরাধিকার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে।
রাষ্ট্রপতি যখন থাকবেন না, তখন শূন্যতা আসবে
অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘এই মুহূর্তে শূন্যতা নেই। রাষ্ট্রপতি যখন থাকবেন না, তখন শূন্যতা আসবে। শূন্যতা তৈরি হলে সেক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে হবে। যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় তাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল।’
২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসেবে জাতীয় সংসদে আসেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাকে দেওয়া হয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
নবম সংসদের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর সেই জায়গায় যান তখনকার স্পিকার আবদুল হামিদ (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি)। এরপর ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন চৌধুরী। তারপর থেকে তিন মেয়াদে তিনিই টানা স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপির মতো স্পিকারের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা হয়েছে। রংপুরে গয়নার কারিগর মুসলিম উদ্দিনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে গত ২৭ আগস্ট একটি মামলা হয়েছে, সেখানে শিরীন শারমিন চৌধুরীও আসামি।
এফএইচ/এমএমএআর/এএসএম