বন্যায় মিশে গেছে নিলু বালার ঘর, দুশ্চিন্তার অন্ত নেই
বানের পানির তোড়ে ভেসে গেছে ঘটিবাটি। ভেঙে গেছে কাঁচাঘর। আসবাবপত্র লেপ্টে গেছে কাদামাটিতে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সবেমাত্র ফিরে এমন দৃশ্য দেখেন বন্যাদুর্গত ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের নিলু বালা দাস।
কোনোরকমে মেরামত করা ঝুপড়ি রান্না ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন তিনি। নতুন করে আবার গোছাতে হবে সবকিছু, ফলে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তার। নিলু বালা দাসের মতো এমন ভয়াবহ অবস্থা বন্যাকবলিত অন্তত ১১ জেলার মানুষের।
ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে গত ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এ বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ১১ জেলার বহু এলাকা পানিতে ডুবে যায়। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, বন্যাকবলিত এসব জেলায় মৃতের সংখ্যা ৭১ জনে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে ২৮ জনই মারা গেছেন ফেনীতে। বাস্তুচ্যুত হয় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত।
‘সেদিন বৃহস্পতিবার বন্যার পানি যখন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন স্বামী-সন্তানকে নিয়ে পাশের বাড়ির দোতলায় চলে যাই। বন্যার পানি কিছুটা কমে গিয়ে যখন হাঁটুসমান, তখন সবাই একে অপরের বাড়িতে চলে গেছে। যে বাড়িতে ছিলাম, সেখানেও থাকা সম্ভব হয়নি। পরে আমার মেয়ের বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম। এভাবে বন্যার কয়েকদিন কাটিয়েছি। এখন নিজের বাড়িতে এলেও কিছুই নেই আর।’ -ফেনীর বন্যাদুর্গত এলাকার নিলু বালা দাস
গেল মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) কথা হয় ফেনীর বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দা নিলু বালা দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেদিন বৃহস্পতিবার বন্যার পানি যখন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন স্বামী-সন্তানকে নিয়ে পাশের বাড়ির দোতলায় চলে যাই। বন্যার পানি কিছুটা কমে গিয়ে যখন হাঁটুসমান, তখন সবাই একে অপরের বাড়িতে চলে যায়। যে বাড়িতে ছিলাম, সেখানেও থাকা সম্ভব হয়নি। আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখি সেখানে থাকার জায়গা নেই। পরে আমার মেয়ের বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম ৩ দিন। এভাবে বন্যার কয়েকদিন কাটিয়েছি। এখনও নিজের বাড়িতে এলেও কিছুই নেই আর।’
নিলু বালা দাস জাগো নিউজকে বলেন, সেদিন শুধু নিজের হাতের মোবাইল, আইডি কার্ড আর জন্মনিবন্ধন কার্ডটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছি। পানি একদম নেমে যাওয়ার পর বাড়ি এসে দেখি ঘরের চালা মাটির সাথে মিশে গেছে। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাই না। ঘরে অনেক কিছুই ছিল, এসে পাইনি। দুইটি পাতিল মাটির ভেতর থেকে বের করেছি। সব জামা কাপড় মাটির ভেতরে। এখন আর কিছুই নেই।
- আরও পড়ুন:
- বালুতে ঢেকে গেছে কৃষকের স্বপ্ন
- বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?
- বাঁধ কাটতেই ভেসে যায় জনপদ, সুরক্ষায় সংস্কার চায় এলাকাবাসী
- বন্যায় ১২০৬ স্কুল-কলেজের ক্ষতি, ৫৬৫টিতে ক্লাস বন্ধ
- বন্যার কারণ নিয়ে যা জানা গেলো
আশ্রয় যখন ঝুপড়ি রান্নাঘর
এই ঘরে কোনো রকম পেট চালানোর মতো রান্না করেন তিনি। সবসময়ে রান্নাও করা যায় না। এমন দুর্দশা আগে কখনো হয়নি, বললেন নিলু বালা। রাতে বেশি কষ্ট হয়। গত কয়েকদিন যে ত্রাণ পেয়েছিলেন সেগুলো দিয়ে এখনও চলছে।
খোলা আকাশে বৃষ্টি যখন আতঙ্ক
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিলু বালা দাস বলেন, ‘এখন বৃষ্টির ভয়ে থাকি। ভারী বৃষ্টি হলেই ভিজে যাই। দ্রুত ঘর করতে না পারলে এভাবে কতদিন নিরাশ্রয় থাকবো জানি না। অনেকে নাম লিস্ট করে নিয়েছে এখনো কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
নতুন ঘর তোলার সেই সামর্থ্য নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বামী চোখে কম দেখে, ছোট্ট একটা লন্ড্রির দোকানে কাজ করেন। জমানো টাকা নেই, দিন এনে দিন খাই।’
‘ক্ষয়ক্ষতির শেষ নেই। এখন একটাই চাওয়া দুই দেশের সমন্বয়ে বাঁধ দ্রুত সংস্কার করা হোক। না হলে বছর-বছর বন্যায় আমরা তলিয়ে যাবো। সরকার আমাদের কতদিন সহায়তা করবে?’ বন্যাদুর্গত এলাকার মানিক বনিক
নিলু বালার মতো ধর্মপুর ইউনিয়নের দু-শোর বেশি পরিবারের একই অবস্থা। ইউনিয়নের আরেক বাসিন্দা মানিক বনিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘সেদিন ৭টায় পানির মধ্যে আমার মাটির ঘর ভেঙে পড়ে যায়। অল্পের জন্য আমি আমার মা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাই। মা প্রেশারের রোগী। আমাদের এই উঁচু এলাকায় কখনও পানি উঠে না, সেখানে এ বন্যায় পানি উঠেছে ৫ ফুটের বেশি।’
মানিক বনিক আরও বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির শেষ নেই। এখন একটাই চাওয়া দুই দেশের সমন্বয়ে বাঁধ দ্রুত সংস্কার করা হোক। না হলে বছর-বছর বন্যায় আমরা তলিয়ে যাবো। সরকার আমাদের কতদিন সহায়তা করবে।’
ধর্মপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফিরোজা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার সন্তান-স্বামী কেউ নেই। রান্না ঘরেই থাকি। ১০ বছর ধরে এভাবেই চলছে। শেষ সম্বল এই রান্না ঘরটা ভেঙে গেছে বন্যার পানিতে। মাটি সরে গর্ত হয়ে গেছে। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েই খাই। এখন কীভাবে ঘর ঠিক করবো, কীভাবে পেট চালাবো জানি না।’
আরএএস/এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম