ফেনীতে বন্যা
বালুতে ঢেকে গেছে কৃষকের স্বপ্ন
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী। বন্যার পানিতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। এরই মধ্যে নেমে গেছে বানের পানি। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠেছে জেলার সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
মুহুরী নদীর পানির স্রোতে ভেঙে গেছে মাইলের পর মাইল সড়ক। সেই সঙ্গে নদীর পানির সঙ্গে আসা বালুতে ঢেকে গেছে ফেনীর বিভিন্ন অঞ্চলের ফসলি জমি। বালু পড়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অসংখ্য কৃষিজমি। এমন অবস্থায় জীবিকা নির্বাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ফেনীর কৃষিজীবী মানুষ।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মুহুরী নদী থেকে বন্যার পানির সঙ্গে বিপুল পরিমাণে বালু এসে আবাদি জমিতে জমাট বেঁধেছে। বন্যার পানি নেমে গেলেও নেমে যায়নি কৃষিজমিতে জমে থাকা বালু।
পরশুরাম উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ও মুহুরী নদীর তীর ঘেষা ১নং মির্জানগর ইউনিয়নে দেখা যায়, আবাদি জমিতে ৪ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত বালু পড়েছে। এসব জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি ও ধান চাষাসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করে এই গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, বালু পড়ায় আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর এই অঞ্চলের ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে। বালু অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত এসব জমিতে কৃষিকাজ সম্ভব না।
জানা গেছে, মির্জানগর ইউনিয়নের নিজ কালিকাপুর সীমান্তের শূন্যরেখায় বল্লামুখা খালের বাঁধ। এই বাঁধ কেটে দেওয়ায় মুহুরী নদীর পানি নিজ কালিকাপুর গ্রামের ফসলি জমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফেনীর অন্যান্য অঞ্চলে চলে যায়। বল্লামুখা খাল নিজ কালিকাপুর থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটিয়া, ফকিরের খিল, উত্তর কাউতলী, বাইন্যা গ্রাম, ডিএম সাহেবনগর, মেলাঘর, মির্জানগর, গদানগর, পূর্ব সাহেবনগর, সুনার বাজার, কালীকৃষ্ণনগর গ্রাম দিয়ে সিলোনিয়া নদীতে মিলিত হয়েছে। ফলে এসব অঞ্চলের আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বালু পড়ে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ফসলি জমি।
- আরও পড়ুন
- ফেনীতে বন্যার পানির চাপে ব্রিজ ভেঙে জনদুর্ভোগ চরমে
- বন্যায় ১২০৬ স্কুল-কলেজের ক্ষতি, ৫৬৫টিতে ক্লাস বন্ধ
- ফেনীতে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৬
স্থানীয় কৃষক ও গ্রামবাসী জানান, তাদের জমিগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত সংস্কার না করলে আগামী ২০ বছরেও এই অঞ্চলে চাষাবাদ সম্ভব হবে নয়। এর আগে ১৯৮৩ সালে যখন একইভাবে বন্যা হয় তখন পরবর্তী ১০ বছর এই অঞ্চলে ভালোভাবে চাষাবাদ করা যায়নি। গত ১০ বছর চাষাবাদ উপযোগী হলেও এখন আবার বন্যায় জমি নষ্ট হয়ে গেছে। বালু পড়ার পাশাপাশি অসংখ্য কূপ ও গর্ত হয়ে জমির লেভেল নষ্ট হিয়ে গেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব বালু বিক্রির ব্যবস্থাও নেই। আশপাশের সব রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সবাই ত্রাণ দিচ্ছে, সেগুলো খাচ্ছি। কয়দিন পর আমাদের খাদ্যসংকট দেখা দেবে। বছরের পর বছর যদি ধান চাষ না করা যায় তাহলে আমাদের ভাতের অভাব দেখা দেবে। পেশা পরিবর্তন করতে হবে।
নিজ কালিকাপুর গ্রামের কৃষক আলম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুহুরীর পানি আসার কারণে আমার ১ কানি কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বালু জমে গাছপালা ও ফসল চাপা পড়ে গেছে। বাঁধ কেটে দেওয়ার পর প্রায় ১০ ফুট উচ্চতায় পানির বিশাল স্রোত আমাদের এই জমিগুলোর ওপর দিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এত বালুর মধ্যে কোনো ধান চাষ করা যায় না। জমি উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানিও পাবো না। ফলে আগামী ৪/৫ বছর ফসল হবে না। সীমান্তবর্তী এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। বালু অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আগামী বছর থেকে এই জায়গায় চাষাবাদ সম্ভব না। এছাড়াও ক্ষেতে ঘাস না থাকায় গবাদিপশুর খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে।’
আরেক কৃষক ইউসুফ আলী বলেন, ‘বালু পড়ার কারণে জমিতে এখন ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষ করার সুযোগ নেই। বিভিন্ন জায়গায় চর জেগে উঠেছে। এখন জমি চাষাবাদ উপযোগী করে গড়ে তুলতে বালু সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে বাঁধ সংস্কার করে এমন বন্যার হাতে থেকে রক্ষা করতে হবে।’
- আরও পড়ুন
- বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৬৭: ত্রাণ মন্ত্রণালয়
- বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনামূল্যে ধানের চারা দেবে বাকৃবি
- নোয়াখালীতে বন্যায় কৃষকের ক্ষতি ৬৪৩ কোটি টাকা
এদিকে শুধু পরশুরাম নয়, বানের পানির সঙ্গে আসা এসব বালু ফেনীর ফুলগাজী, সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন আবাদি জমিতে পড়ে ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে এসব অঞ্চলে বালুর পরিমাণ কম থাকায় অতি দ্রুত সংস্কার করলে জমি চাষাবাদ উপযোগী হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
ফুলগাজী উপজেলার ফিরোজ নামে এক বর্গাচাষি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যার পর কোনো জমি গভীর হয়েছে, আবার কোনো জমি বালু পড়ে উঁচু হয়ে গেছে। বালুর চাপে বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা অন্যের জমি চাষ করে অর্ধেক ফসল নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। এদিকে বিভিন্ন জায়গায় ১ ফুটের বেশি বালু জমেছে। এগুলো কোদাল দিয়ে সরাতেও অনেক সময়ের ব্যাপার। প্রশাসন থেকে সহযোগিতা না করলে চাষাবাদ কষ্টকর হয়ে যাবে।’
ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক একরাম উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই বালু পরশুরামের যে স্থান দিয়ে প্রবেশ করেছে সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। জমি থেকে বালু সরানো খুবই কষ্টসাধ্য। আমরা চেষ্টা করবো। পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও জানাতে হবে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবো। এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বাঁধ নির্মাণে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভয়াবহ এ বন্যায় ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধু ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আরএএস/ইএ/জিকেএস