নিম্নমানের মালামাল, ৯২ কোটির ডাক ভবন তিন বছরেই বেহাল
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ডাক ভবন। ডাকবাক্সের আদলে নির্মিত লাল রঙের ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৯২ কোটি টাকা। ডাক বিভাগের সদর দপ্তরটি উদ্বোধন করা হয় ২০২১ সালের ২৭ মে। এরপর পেরিয়েছে তিন বছর। অথচ এরই মধ্যে ভবনে দেখা দিয়েছে নানান সমস্যা। কিছু ওয়াশরুম ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কিছু দেওয়ালে ড্যাম্প ও ফাটল দেখা গেছে। ফলে রং ও সিমেন্ট ঝরে পড়ছে মূল্যবান কাগজপত্রের ওপর।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, প্রকল্পের নির্মাণ কাজে মানসম্মত মালামাল দেওয়া হয়নি। এছাড়া সরবরাহকারী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ মনিটরিংয়ের ঘাটতি থাকায় প্রকল্প সমাপ্তির চার বছর পার না হতেই নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
ওয়াশরুমের পার্টিক্যাল বোর্ডের ডোরগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিচ থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব জায়গায় পার্টিক্যাল বোর্ডের পরিবর্তে প্লাস্টিক ডোরের প্রয়োজন ছিল। অনেকগুলো ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনি বাঁকা হওয়ায় দরজা সম্পূর্ণ লাগানো যায় না। এগুলো আরও ভালো মানের প্রয়োজন ছিল। মূল প্রকল্পে প্লাস্টিক ডোরের সংস্থান ছিল। পরে সংশোধন করে সলিড পার্টিক্যাল বোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তরের সদর দপ্তর নির্মাণ (সংশোধিত) শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছে আইএমইডি।
আইএমইডির পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে পোস্টমাস্টারের অফিস কক্ষের ওয়াল ড্যাম্প। এ কারণে অফিসের মূল্যবান কাগজপত্রের ওপর রং ও সিমেন্ট ঝরে পড়ছে। দেওয়াল ড্যাম্প হওয়ার কারণ ইটে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং ভেজা অবস্থায় প্লাস্টার করা। এছাড়া পোস্ট অফিস রুমের দেওয়ালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। ডাকঘরের নিচতলায় চালকদের বিশ্রামাগারে দেওয়ালে ড্যাম্প ও ফাটল দেখা গেছে। ওয়াশরুমের পার্টিক্যাল বোর্ডের দরজাগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিচ থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব জায়গায় পার্টিক্যাল বোর্ডের পরিবর্তে প্লাস্টিকের দরজার প্রয়োজন ছিল। অনেকগুলো ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনি বাঁকা হওয়ার কারণে দরজা সম্পূর্ণ লাগানো যায় না। এগুলো আরও ভালো মানের প্রয়োজন ছিল। মূল প্রকল্পে প্লাস্টিকের দরজার সংস্থান ছিল। পরবর্তীসময়ে সংশোধন করে সলিড পার্টিক্যাল বোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে প্রায় ১০ শতাংশ ওয়াশরুমের দরজা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
- আরও পড়ুন
- ডাকঘরে পোস্ট মাস্টারের আইসক্রিম ডিলারের ব্যবসা
- জমানো টাকা না পেয়ে পোস্ট অফিসেই আত্মহত্যাচেষ্টা নারীর
- ডাকের সাবেক ডিজিসহ ২ জনের নামে দুদকে মামলা
- গ্রাহকের অর্ধকোটি টাকা নিয়ে পালালেন পোস্টমাস্টার
প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, প্রায় ফ্লোরে নিম্নমানের টাইলস ব্যবহারের কারণে চলাচলের সময় উঁচু-নিচু মনে হয়েছে। ফলস সিলিং মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। এসির পানিতে রুম স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়। বিশেষ করে নির্মাণের সময় এসির পানির নির্গমনের ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল।
১৪ তলার ছাদটি ক্যাপ আকৃতি সম্পন্ন স্টিল স্ট্রাকচারের। দুর্যোগের সময় ভবনটির ওপরের অংশ দিয়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব নয়। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি বাস্তবে দৃশ্যমান হলেও এর কার্যকারিতা নেই। প্রকল্প চলাকালে নির্মাণ কাজে মানসম্মত মালামাল দেওয়া হয়নি।
আইএমইডি সরেজমিনে আরও দেখেছে, মাঝে মধ্যে গ্লাস ভেঙে পড়ছে। ভবনটির চারদিকই গ্লাসবেষ্টিত। এ কারণে এখানে আরও মানসম্মত গ্লাস ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল।
ডাক ভবনে অবস্থিত পোস্ট অফিস রুমের ড্যামেজ ওয়াল। ছবি: আইএমইডি
৬ থেকে ১৩ তলা পর্যন্ত যোগাযোগের জন্য নেটওয়ার্কজনিত সমস্যা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরূপ সুউচ্চ ভবনের জন্য আলাদা প্রযুক্তিসম্পন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা সংস্থানের প্রয়োজন ছিল। এছাড়া ভবনটির পানি সরবরাহের ট্যাপগুলো মানসম্মত নয়। অন্যদিকে ডে-কেয়ার সেন্টার চালু না হওয়ায় এখানে ব্যবহৃত মালামাল অযত্নে নষ্ট হওয়ার পথে।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, ১৪ তলার ছাদটি ক্যাপ আকৃতিসম্পন্ন স্টিল স্ট্রাকচারের। দুর্যোগের সময়ে ভবনটির ওপরের অংশ দিয়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব নয়। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামাদি বাস্তবে দৃশ্যমান হলেও এর কার্যকারিতা নেই। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পের অধীনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্প চলাকালে নির্মাণ কাজে মানসম্মত মালামাল দেওয়া হয়নি।
- আরও পড়ুন
- পোস্ট মাস্টারের বিরুদ্ধে মুনাফার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
- পোস্ট অফিসের কর্মচারীর কোটি টাকার সম্পদ, ৯ বছর কারাদণ্ড
- জনবল ছাড়াই চলবে স্মার্ট পোস্টবক্স, ডাকসেবা মিলবে ২৪ ঘণ্টা
- প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আবেদন হারিয়েছে ডাকের চিঠি
সরেজমিনে দেখা যায়, অভ্যর্থনা কক্ষে অতিথিদের বসার জন্য কোনো আসবাবপত্র নেই। অথচ প্রকল্প পরিকল্পনায় অতিথিদের অপেক্ষার জন্য আলাদা জায়গা ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের সংস্থান ছিল। তাছাড়া ভবনের সামনের প্রবেশপথ রাস্তার লেভেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে গাড়ি চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে।
রিসিপশনে অতিথিদের জন্য বসার কোনো আসবাবপত্র নেই। অথচ প্রকল্প পরিকল্পনায় অতিথিদের অপেক্ষার জন্য আলাদা জায়গা ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের সংস্থান ছিল।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সরবরাহকারী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ মনিটরিংয়ের ঘাটতি থাকায় প্রকল্প সমাপ্তির চার বছর পার হতে না হতেই নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ এবং পরবর্তীসময়ে কাজ চলাকালীন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ডাক ভবনে ড্রাইভারদের বিশ্রাম রুমের ড্যাম্পওয়াল। ছবি: আইএমইডি
এ প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তরের সদর দপ্তর নির্মাণসহ (সংশোধিত) বেশ কিছু প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রকল্পের কাজে যেখানে ব্যত্যয় হয়েছে, আমরা চিঠি দিয়ে জানতে চাইবো। প্রতিবেদনের আলোকে চিঠি দিয়ে অগ্রগতি জানবো। রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে ত্রুটি পেয়েছি সেটা সংশোধন করতে বলবো। আমরা রিপোর্টে যতগুলো বিষয় পেয়েছি, সবগুলো সমাধানের জন্য চিঠি দেবো।’
আইএমইডির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ভবন নির্মাণের আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অনুমোদন না নিয়েই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ভবন নির্মাণের পর তাদের অনুমোদন নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে তারা কিছু সুপারিশসহ অনুমোদন দেয়।
- আরও পড়ুন
- সবার খোঁজ বয়ে বেড়ালেও সেই ডাক পিয়নদের খবর রাখে না কেউ
- জরিমানার টাকা পরিশোধ করলেই ডাক বিভাগে পৌঁছে যাবে গাড়ির কাগজ
- মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ার আতঙ্ক, বৃষ্টি হলে পড়ে পানি
- ঢাকার প্রথম ডাকঘরের এখন বেহাল দশা!
আইএমইডি বলেছে, ভবনটির নিরাপত্তার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া অতি জরুরি। যেমন- সাবস্টেশন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা আবশ্যক। নিয়মিত সাবস্টেশন রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন। প্রতিটি ফায়ার এক্সিটিংগুইশার রিফিল করে ব্যবহার উপযোগী করা প্রয়োজন। ভবনটির ছাদে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং চারদিক গ্লাস ও লোহার স্ট্রাকচার দ্বারা আবৃত। সুতরাং টপ ফ্লোর ফাঁকা রাখা ও আপদকালীন উদ্ধার কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা দরকার। একই সঙ্গে টপ ফ্লোরে পর্যাপ্ত এক্সিটিংগুইশার রাখা প্রয়োজন।
সার্বিক বিষয়ে ডাক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (সরবরাহ ও পরিদর্শন) এস এম হারুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি যখন বাস্তবায়ন হয় তখন আমি ছিলাম না। দুজন প্রকল্প পরিচালকও অবসর নিয়েছেন। প্রকল্পে যদি কোনো গ্যাপ থাকে, সেই গ্যাপ আমরা পূরণ করবো। তবে আমি প্রকল্পের সঙ্গে ছিলাম না। প্রকল্পের সঙ্গে ছিলেন ডাক অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনজির আহমেদ।’
ডাক ভবনের নিচতলার ওয়াশরুমের দরজা। ছবি: আইএমইডি
আনজির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘স্যার, ভুলে আমার নাম বলেছেন। আমি প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না।’
২০১৬ সালের শেষ দিকে প্রায় পৌনে এক একর জমির ওপর ডাক ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভবনটি হস্তান্তর করে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। ভবনটি প্রথমে আটতলা নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা দাঁড়ায় ১৪ তলায়। বাজেটও বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯২ কোটি টাকায়। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ অর্থ।
এমওএস/এমএইচআর/এমএমএআর/জিকেএস