‘মুগ্ধ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে মুগ্ধ করেছিল’
পানি লাগবে, কারো পানি? এই কণ্ঠ যেন এখনো প্রতিধ্বনি হয়। স্মৃতিতে ভেসে উঠে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর সেই মায়াবি চেহারা। মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক ছাত্র ছিলেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার উৎখাতের আন্দোলনে নিহত মুগ্ধকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন তার শিক্ষকরা।
মুগ্ধ কীভাবে তার আচরণের জাদু দিয়ে পুরো ক্যাম্পাসকে বিমোহিত করে রাখতেন, অন্যদেরকে মানবিক হতে উৎসাহিত করতেন তার ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন শিক্ষকরা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের গণিত বিভাগের প্রধান প্রফেসর মো. আজমল হুদা বলেন, মুগ্ধর বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল দুর্দান্ত, যা তাকে গণিতে ভালো ফলাফল অর্জনে সহায়তা করে। ২৫ বছর বয়সী মুগ্ধ ছিলেন ১৯-ব্যাচের ছাত্র। গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
অধ্যাপক হুদা বলন, মুগ্ধ নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ ছাত্র ছিলেন। তার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে তিনি বিশ্বের সেরা অনলাইন কর্মক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ফাইভার-এ ৫-স্টার রেটিংসহ প্রায় ১,০০০ অর্ডার সম্পন্ন করেন।
তিনি বলেন, মুগ্ধ জন্মগতভাবে নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামের যে কোনো ইভেন্টে নিজেকে সেরা হিসেবে তুলে ধরতেন এবং প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যে কোনো পাঠ বুঝতে এবং অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করতে সাহায্য করতেন।
আরও পড়ুন:
- দক্ষ ফ্রিল্যান্সার ছিলেন মুগ্ধ, ফেসবুকে আলোচনায় তার সাফল্য
- শরীরে গুলির ক্ষত, জীবনে অনিশ্চয়তা
- আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে, কঠিন বিচার চাই
প্রফেসর হুদা বলেন, ‘১৯-ব্যাচের প্রথম দিনগুলোতে, গণিত বিভাগের সফরে আমি শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিতে এবং জুনিয়রদের দেখাশোনা করার জন্য দু-জন সমন্বয়কারী নির্বাচন করতে বলেছিলাম। এই দুইজনের একজন শিক্ষকদের অন্যতম প্রিয় ছাত্র মুগ্ধ।
একই বিভাগের অধ্যাপক ডা. মুন্নুজাহান আরা বলেন, সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী মুগ্ধকে অনেক ভালোবাসে। গণিত বিভাগের সব শিক্ষকই তার হাস্যোজ্জ্বল মুখ পছন্দ করতেন যা ছিল নির্মলতার প্রতীক।
তিনি বলেন, মাঝে মাঝে যখন আমি তাকে ক্লাসে কোনো অ্যাসাইনমেন্টের বিষয়ে রাগ করে কথা বলতাম, তখন সে হাসতো যা আমার মেজাজ ঠান্ডা করে দিতো। আশ্চর্যজনকভাবে পরের দিন সে তার কাজ জমা দিতো। সে গণিত ডিসিপ্লিনের একজন উজ্জ্বল বিতার্কিক ছিল। সে গিটার বাজাতে পছন্দ করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগীয় অনুষ্ঠানে গিটার বাজাতো। মুগ্ধ বাইক চালাতে খুব আগ্রহী ছিল।
মুন্নুজাহান বলেন, সে বাইকে চড়ে সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, মুগ্ধকে যখন ঢাকার রাস্তায় পানি লাগবে, পানি (পানি দরকার)’ বলতে দেখেন ভিডিওতে এবং পরে জানতে পারেন গুলিতে নিহত হয়েছে সে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে মুগ্ধ এমবিএ করার জন্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) ভর্তি হয়।
১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে পানি বিতরণকালে মুগ্ধ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে একটি গুলি তার কপালে লেগে ডান কান দিয়ে বেরিয়ে যায়।
মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত বলেন, গুলিবিদ্ধ মুগ্ধকে তার বন্ধুরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু বাঁচাতে পারেনি।
তিনি বলেন, ছোটকাল থেকেই মুগ্ধ সর্বদা অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার আওয়াজ তুলেছিল। মুগ্ধ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার ছিল। ২০১৯ সালে বনানী অগ্নিকাণ্ডের সময় লোকদের উদ্ধারকাজে ভূমিকা রাখার জন্য মুগ্ধ বাংলাদেশ স্কাউট থেকে ‘জাতীয় পরিষেবা পুরস্কার’ অর্জন করে।
এসএনআর/এমএস