সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছানো যেতে পারে যেভাবে
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা। এ অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত এককোটির বেশি মানুষ। বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য সারাদেশ থেকে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী। যে যার মতো সামর্থ্য নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে এ দুর্যোগে। তবে এত ত্রাণসামগ্রী বন্যার্তদের কতটুকু সহায়ক হচ্ছে সেটি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
এরই মধ্যে দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ না পৌঁছানো, খাবার পানিসহ নানা সংকটের খবর জানা যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। ত্রাণ দিতে যাওয়া বিভিন্ন সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীরা একেকজন একেক ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন। আবার বন্যার্তরা তাদের চাহিদা কিংবা ত্রাণ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে দিচ্ছেন তাদের অভিমত। সব মিলিয়ে সুষ্ঠুভাবে কীভাবে ত্রাণের সমবণ্টন করা যায় সে উপায় খুঁজছেন সবাই।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বন্যার্তরা বলছেন, অধিকাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এখনো পনিবন্দি হয়ে আটকা রয়েছেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা সড়ক সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ত্রাণ সহায়তা দিলেও দুর্গম অঞ্চলে যাচ্ছেন না কিংবা যেতে পারছেন না। অনেকে শহরে গিয়ে প্রধান সড়কে ত্রাণ দিয়ে চলে আসছেন। এতে কিছু কিছু মানুষ কয়েকবার ত্রাণ পেলেও অনেকে ত্রাণ পাচ্ছেনই না। ত্রাণ দুর্গম এলাকায় পৌঁছানোর জন্য যে নৌকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা কিংবা যে স্পিডবোট দরকার সেটা না মেলাকেও দায়ী করছেন অনেকে।
শুকনো খাবার একদিন পেয়েছি। কাল থেকে কী খাবো জানি না। নৌকা না থাকায় এদিকে তেমন কেউ আসছে না। বাচ্চাদের ডায়াপার নেই, ঘরে অসুস্থ শ্বশুরের ইনসুলিন লাগে প্রতিদিন, কিছুই নেই।–বানভাসি মাকসুদা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ফেনী। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের কিছু জায়গায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ত্রাণ নিয়ে গেলেও দুর্গমে এলাকায় ত্রাণ না যাওয়ায় বানভাসি মানুষের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পানি ও খাবার না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে এসব এলাকা থেকে। যেসব এলাকায় একটু পানি নামতে শুরু করেছে বসতভিটার অবস্থা দেখে তারা রীতিমতো দিশেহারা।
ত্রাণ বিতরণে যেসব অব্যবস্থাপনার অভিযোগ
জাগো নিউজের ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জানা যায়, ফেনী থেকে তিনটি হাবে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসন, জামায়াত ও ছাত্রশিবির, সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে ত্রাণ যাচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায়। সারাদেশে থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবীরা ম্যাপিং না করে যে জায়গায় অন্যরা দিচ্ছেন সেসব আশ্রয়কেন্দ্রেই যাচ্ছেন। ফলে অন্য আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার যাচ্ছে না। এছাড়াও যেসব এলাকায় একতলা-দোতলা বাড়িতে পানিবন্দি মানুষ রয়েছে সেখানে সবাই পৌঁছাতে পারছে না। অনেকে সাঁতার না জানায় ভয়ে দুর্গমে এলাকায় না গিয়ে শহরের আশপাশে ত্রাণ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নৌকার সংকটও আছে।
নোয়াখালীর সেনবাগ অঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মাকসুদা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুকনো খাবার একদিন পেয়েছি। কাল থেকে কী খাবো জানি না। নৌকা না থাকায় এদিকে তেমন কেউ আসছে না। বাচ্চাদের ডায়াপার নেই, ঘরে অসুস্থ শ্বশুরের ইনসুলিন লাগে প্রতিদিন, কিছুই নেই। এদিকে বাইরে হাঁটু সমান পানি। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বাজার। যাওয়ার মানুষ নেই।’
আরও পড়ুন
- বন্যার কারণ নিয়ে যা জানা গেলো
- ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুরে অবনতি
- বন্যায় মারা গেছেন ২৭ জন: দুর্যোগ উপদেষ্টা
ফেনীর ছাগলনাইয়া এলাকার শামীম হোসেন বলেন, ছাগলনাইয়ার নিম্ন অঞ্চলে যাওয়াই যাচ্ছে না। দোতলা-তিনতলা বাড়িগুলোতে অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সবার কাছে পর্যাপ্ত খাবার নেই। সুপেয় পানির সংকট সবচেয়ে বেশি। ওষুধ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন দরকার। ত্রাণের ক্ষেত্রে শুধু শুকনো খাবারের কথা না ভেবে সব ধরনের জিনিস কমবেশি রাখা দরকার। ত্রাণ যারা পাচ্ছে তারা বেশি পাচ্ছে, কেউ কেউ মোটেই পাচ্ছে না। সুষ্ঠুভাবে সবার কাছে কীভাবে পৌঁছানো যায় সেটা দেখা উচিত।
আমরা অভিযোগ শুনেছি, যে ত্রাণ পাঠাচ্ছি সেগুলো শহরে বা মূল রাস্তার আশপাশে যারা থাকে তারাই শুধু পাচ্ছে। বিষয়টাকে আমরা আমলে নিয়েছি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি যারা আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি বা পানিবন্দি তাদের খুঁজে খুঁজে ত্রাণ দিতে।- সহকারী সমন্বয়ক রেজওয়ানুল ইসলাম রিফাত
বন্যাদুর্গত এলাকার অধিকাংশ মানুষের অভিযোগ, রাস্তার পাশের মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে। কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ যাচ্ছে। কিন্তু একটু ভিতরের দিকে কেউ আসছে না। তাদের অবস্থা খুবই করুণ।
বন্যার্তরা যেসব সহযোগিতা চান
জাগো নিউজের ফেনী প্রতিনিধি বলেন, ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজীর কিছু জায়গা আছে যেখানে অনেক মানুষ এখনো সহযোগিতা পায়নি।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, কেউ কেউ তিনদিন ধরে শুকনো খাবার খেয়ে আছেন। রান্না করার ব্যবস্থা হলেও গ্যাসের সিলিন্ডার না থাকায় রান্না করা যাচ্ছে না। কিছু সংগঠন সিলিন্ডার নিয়ে এলেও দুর্গমে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে না। সাবান নেই, স্যালাইনের সংকট দেখা গেছে। দু-একদিন পর রান্না করার ব্যবস্থা হলে চাল, ডালসহ মুদিসামগ্রী লাগবে। এগুলো এখনো পাননি তারা। রাতে মোমবাতি-কয়েলের অভাবে মশার কামড়ে বাচ্চারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আগামী এক সপ্তাহের খাবার ও পুনর্বাসন চেয়েছেন তারা।
সুষ্ঠু ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় যা গুরুত্ব দেওয়া দরকার
ফেনীতে বন্যার শুরু থেকে সেখানে কাজ করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী একরামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবী বা যারা ত্রাণ দিতে আসেন তারা ম্যাপিং করে আসেন না। স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছাড়া চলে আসেন। ফলে শহর এসে কিছু দিয়ে ঘুরে চলে যান। কোন এলাকায় কীভাবে যেতে হবে, কত জনসংখ্যা রয়েছে, আশ্রয় কেন্দ্র কতটি রয়েছে- এগুলো জেনে গেলে সুষ্ঠু বণ্টন সম্ভব।’
আরও পড়ুন
- লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, ত্রাণের জন্য হাহাকার
- ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ায় নতুন কোনো এলাকা প্লাবিত হয়নি: উপদেষ্টা
- বন্যার পানি কমতেই ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন
আশরাফুল আমিন নামে এক স্বেচ্ছাসেবী ফেনীর পরশুরাম উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ করতে যান। তিনি লিও ক্লাবের সদস্য। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় অনেক সুযোগসন্ধানী রয়েছে, কান্নাকাটি করে তার বাড়িতে প্রয়োজনের অধিক ত্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। স্পটে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গেলে ভালো। অবশ্যই হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে। তাহলে সঠিক মানুষের কাছে উপহার পৌঁছানো যাবে। কয়েকটা গ্রুপ একসঙ্গে এলে কেউ শুকনো খাবার, কেউ চাল-ডাল, কেউ মেডিসিন, কেউ টাকা বিতরণ করলে ভালো হয়।’
আমার পরামর্শ হলো, এসব ত্রাণ যদি ওই অঞ্চলে একটা জায়গা থেকে বিতরণ করা হয়, তাহলে সেখান থেকে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিকল্পনা করে ত্রাণ পাঠানো সম্ভব। আর এ দায়িত্ব যদি ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট পালন করেন, তাহলে ভালো হয়।- ত্রাণ কর্মসূচি কর্মকর্তা অঞ্জন চন্দ্র পাল
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে শুরু থেকে সুনাম কুড়িয়েছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটির চেয়ারম্যান শায়েখ আহমাদুল্লাহ তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বন্যার সময় পানি থাকাকালীন, পানি নামার পর ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া- এই তিনটি ভাগে ত্রাণ বিতরণ করলে ক্ষতিগ্রস্তরা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। প্রথম অবস্থায় আমরা উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি শুকনো খাবার দিয়েছি, দ্বিতীয়ত, পানি নেমে যাওয়ার পর চাল-ডাল-তেলসহ মুদি বাজার দিচ্ছি, তৃতীয়বার যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ও নগর অর্থ দেবো।
ত্রাণ কার্যক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা
বন্যা কবলিত অঞ্চলে ত্রাণ দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এ পর্যন্ত প্রায় নগদ ৬ কোটি টাকা ও বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করে নিয়মিত দুর্গত এলাকায় পাঠানো হচ্ছে।
এই অর্থ তারা কীভাবে পাঠাচ্ছেন, কীভাবে বণ্টন করছেন এবং ঘরের ঘরে কীভাবে পৌঁছে দেবেন এসব বিষয়ে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সহকারী সমন্বয়ক রেজওয়ানুল ইসলাম রিফাত বলেন, ‘বন্যাদুর্গত প্রতিটি জেলায় আমরা নিয়মিত ত্রাণ পাঠাচ্ছি। আমরা অভিযোগ শুনেছি, আমরা যে ত্রাণ পাঠাচ্ছি সেগুলো শহরে বা মূল রাস্তার আশপাশে যারা থাকে তারাই শুধু পাচ্ছে। বিষয়টাকে আমরা আমলে নিয়েছি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি যারা আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি বা পানিবন্দি তাদের খুঁজে খুঁজে ত্রাণ দিতে।’
তিনি বলেন, ‘গত পরশুদিন আমরা বিমান বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে তিন হাজারের বেশি প্যাকেজ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে এয়ার লিফট করি। আজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। যারা এখনো দুর্গম এলাকায় রয়েছেন এবং যেখানে এখনো ত্রাণ পৌঁছাতে পারিনি তাদের সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। যাতে প্রতিটি বন্যাদুর্গত মানুষ খাবার পায়।’
এই সহকারী সমন্বয়ক আরও বলেন, ‘প্রতিটি জেলায় যে সব ডিসি মহোদয় রয়েছেন তাদের সঙ্গে আমরা মিটিং করেছি। ওনাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা সেভাবে পাঠাবো। আমরা প্রতিদিন ৮ লাখ মানুষের খাবারের কর্মযজ্ঞ হাতে নিতে যাচ্ছি।’
যা বলছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রালয়
সুষ্ঠু ত্রাণ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রালয়ের ত্রাণ কর্মসূচি কর্মকর্তা অঞ্জন চন্দ্র পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মূলত ত্রাণ দেই জেলা প্রশাসন বা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে। জেলা থেকে চাহিদা অনুযায়ী সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দেওয়া হয়। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ত্রাণ পাঠান। সেখানে গ্রামের মেম্বারদের লিস্ট অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এতে ভুক্তভোগী সবাই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার পরামর্শ হলো, এসব ত্রাণ যদি ওই অঞ্চলে একটা জায়গা থেকে বিতরণ করা হয়, তাহলে সেখান থেকে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিকল্পনা করে ত্রাণ পাঠানো সম্ভব। আর এ দায়িত্ব যদি ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট পালন করেন, তাহলে ভালো হয়।’
আরএএস/এএসএ/এমএস