ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

খালপাড়ে গাছ লাগানোর নামে ‘পুকুর চুরি’

মফিজুল সাদিক | প্রকাশিত: ০৪:৪৯ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২৪

লালমনিরহাটের আদিতমারির ধুরিরদৌলা খাল ২০২১-২২ অর্থবছরে খনন করা হয়। কাজের অগ্রগতি ১০০ শতাংশ। অথচ প্রকল্পে থাকলেও খালের উভয় পাড়ে একটি গাছও লাগানো হয়নি। এতে খালপাড়ের মাটি দ্রুত সরে যাচ্ছে। একই অবস্থা ভোলার বেতুয়া খালের। গাছ না লাগালেও এ বাবদ ঠিকই কৌশলে দেখানো হয়েছে খরচ। তুলে নেওয়া হয়েছে টাকা।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। ‘সারাদেশে পুকুর, খাল উন্নয়ন’ প্রকল্পে ঘটেছে এ অনিয়ম। প্রকল্পের আওতায় বন বিভাগের পরিপত্র মেনে প্রতি কিলোমিটারে এক হাজার গাছ লাগানোর কথা ছিল। অথচ খালপাড়ে গাছের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাননি আইএমইডি পরিদর্শকরা।

১৭৫৭ কোটি টাকার প্রকল্প
জানা যায়, ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে এক হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশজুড়ে পুকুর ও খাল উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। একই সঙ্গে পুকুর ও খালের পাড় যাতে না ভাঙে সেজন্য এক হাজার ৭শ কিলোমিটার খালের পাড়ে গাছ লাগানোর কথাও প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়।

তবে তিন বছর মেয়াদি (২০১৭-২০২০) এ প্রকল্পে ১৬৯ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হলেও খাল খননে কত, গাছ লাগানো খাতে কত খরচ করা হয়েছে সে বিষয়টি এড়িয়ে গেছে এলজিইডি। প্রতিটি গাছ কেনা বাবদ খরচ ধরা ছিল ৩৭ টাকা। খনন ও গাছ লাগানো বাবদ এ টাকা তুলে নেওয়া হলেও কোনো গাছ লাগায়নি এলজিইডি।

আইএমইডি প্রতিবেদনের পরিদর্শন পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংশোধিত ডিপিপিতে খাল উন্নয়নে খালের উভয় পাড়ে গাছ লাগানোর কথা থাকলেও সরেজমিনে গাছ লাগানোর বিষয়টি তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। খাল উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণ প্রকল্পের জন্য ধরা হয় ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত এ খাতে খরচের ১৬৯ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হলেও খননের পর খালের পাড়ে গাছ লাগানো হয়নি।

প্রকল্পটি ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও তিন বছরের প্রকল্পটি সাত বছরেও শেষ হয়নি। দুই দফায় ছয় বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আর প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে করা হয়েছে এক হাজার ৫৯৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

যা বলছেন এলজিইডি প্রকৌশলী
এ বিষয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আলি আখতার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মনে হয় গাছ লাগানোর বিষয়টি পরে বাদ দেওয়া হয়েছে।’

গাছ না লাগানোর ফলে পুকুর-খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘আমার মনে হয় গাছ থাকা উচিত।’

 ‘পুকুর চুরি’

গাছ না লাগিয়েও টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি আমি জানতে চাইবো।’

গাছ লাগানো বাবদ প্রতি অর্থবছরই বরাদ্দ
প্রকল্পের খরচ ও বরাদ্দে দেখা যায়, গাছ লাগানোর কথা বাদ দেওয়ার কথা বললেও এলজিইডি ডিপিপিতে গাছ বাবদ ব্যয় ধরেছে। প্রকল্পের বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৭-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত গাছ লাগানো বাবদ ব্যয় ধরা হয় পাঁচ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে খালপাড়ে বৃক্ষরোপণ বাবদ ব্যয় ধরা হয় ১৪৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় ছিল ২২৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা করে। এভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খালপাড়ে বৃক্ষরোপণ বাবদ ১৪২ কোটি ৭৯ লাখ ৯ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রতিটি গাছের ক্রয়মূল্য ধরা আছে ৩৭ টাকা।

আইএমইডি জানায়, প্রকল্পের ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) খাল ও পুকুর খননের পরে সৌন্দর্যবর্ধন তথা খাল ও পুকুর পাড়ের মাটি মজবুত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বৃক্ষরোপণের কথা থাকলেও বাস্তবে বিষয়টি সব জায়গায় প্রতিফলিত হয়নি। কিছু কিছু স্থানে খাল ও পুকুর পাড়ের মাটি সরে যাচ্ছে। এ স্থানগুলো চিহ্নিত করে প্রকল্পের অবশিষ্ট উন্নয়ন কাজে যেন বৃক্ষরোপণ বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে আইএমইডি।

যা উঠে এসেছে আইএমইডি প্রতিবেদনে
আইএমইডি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভোলা জেলার চর ফ্যাশন উপজেলায় আঞ্জুরহাট খালের উভয় পাড়ের স্লোপ অতিরিক্ত খাঁড়া হওয়ায় এবং খনন করা মাটির লেভেলিং ড্রেসিং না করার কারণে মাটি ধসে পড়ে খালের পাড়ে বসবাসরত মানুষের ঘর-বাড়ি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দ্রুত খালের খনন করা মাটি খালের পাড়ে মিনিমাম ২ থেকে ৩ মিটার খালি জায়গা (বার্ম) রেখে নির্দিষ্ট স্লোপে লেভেলিং/ড্রেসিং করা প্রয়োজন।

তজুমদ্দিন উপজেলায় বেতুয়া খাল ও পটুয়াখালী সদর উপজেলার ইসহাক মৃধাবাড়ী খালসহ কয়েকটি খালের সাইড স্লোপ খাঁড়া হওয়ায় অতিবর্ষা হলে খালের পাড়ের মাটি পুনরায় খালে গিয়ে খাল ভরে যাবে, তাই সাইড স্লোপগুলো ম্যানুয়ালি শ্রমিক দিয়ে ঠিক করা প্রয়োজন। খালের পাড়েই অতিরিক্ত মাটি রাখা হয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত বার্ম নেই। উক্ত স্থানগুলো বার্ম রেখে নির্দিষ্ট স্লোপে লেভেলিং/ড্রেসিং করা প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা যায়, এক হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অর্থছাড় হয়েছে ৬২১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৫৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অব্যয়িত আছে ৮৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। দেশের বেশিরভাগ জায়গায় খাল খনন করা হলেও গাছ লাগানো হয়নি।

গাছ না লাগিয়ে কেন টাকা উত্তোলন করা হলো বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবো। আমরা যদি কাজ না করি তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মনে ভয় ধরবে না। গাছ না লাগালে অবশ্যই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হতে হবে। যে কাজটা করা হলো না এটা আমরা দেখবো। বিষয়টি পর্যালোচনা করবো।- আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা এলজিইডির কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, গুমনাতলী কাটাখালী খাল খনন করা হলেও গাছ লাগানো হয়নি। বর্ষায় হয়তো লাগানো হতে পারে। আবার জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় খোঁজ নিলে বলা হয় তারা গাছ লাগিয়েছে। তবে আইএমইডি সেখানে গাছ লাগানো বিষয়টি খুঁজে পায়নি।

সরেজমিনে পরিদর্শনে গাছের অস্তিত্ব পায়নি আইএমইডি
আইএমইডির সরেজমিনে পরিদর্শন পর্যবেক্ষণ বলছে, ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় আঞ্জুরহাট খালের উভয় পাড়ের স্লোপ অতিরিক্ত খাঁড়া হওয়ায় এবং খনন করা মাটি লেভেলিং না করায় ধসে খালের পাড়ে বসবাসরত মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তজুমদ্দিন উপজেলার বেতুয়া খাল, পটুয়াখালী সদর উপজেলার ইসহাক মৃধাবাড়ি খালসহ কয়েকটি খালের সাইড স্লোপ খাঁড়া হওয়ায় অতিবৃষ্টিতে খালের পারের মাটি ফের খালে পড়ে ভরাট হয়ে যাবে।

খনন করা বেশির ভাগ স্থানে দেখা যায়, খালপাড়েই অতিরিক্ত মাটি রাখা হলেও গাছ লাগানোর পর্যাপ্ত চিহ্ন নেই। ওই স্থানগুলোতে গাছ লাগানোর চিহ্ন রেখে নির্দিষ্ট স্লোপে লেভেলিং করা প্রয়োজন। আরডিপিপিতে খাল উন্নয়নে খালের উভয় পাড়ে গাছ লাগানোর কথা থাকলেও সরেজমিনে গিয়ে তেমনটি পরিলক্ষিত হয়নি।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, কিছু স্থানে খালের আশপাশের বাজারের ময়লা-আবর্জনা ফেলে পানির গতিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে খালে জোয়ার-ভাটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলায় মাসুদ জয়ার খালে সরাসরি ল্যাট্রিনের সংযোগ দেওয়ায় ওই খালের পানি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

যা বলছেন আইএমইডি সচিব
গাছ না লাগিয়ে টাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আমাদের কিছু বাধা ছিল। এখন কোনো বাধা নেই। আমি উপদেষ্টা (অর্থ-পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ) স্যারকে বিষয়টি শেয়ার করেছি। আইএমইডি আর নামকাওয়াস্তে রিপোর্ট করবে না। রিপোর্ট করে লাভও হচ্ছে না। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে অ্যাকশনে যাবো।’

তিনি বলেন, ‘গাছ না লাগিয়ে কেন টাকা উত্তোলন করা হলো বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখবো। আমরা যদি কাজ না করি তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মনে ভয় ধরবে না। গাছ না লাগালে অবশ্যই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হতে হবে। যে কাজটা করা হলো না এটা আমরা দেখবো। বিষয়টি পর্যালোচনা করবো।’

‘ডিপিপিতে গাছ লাগানোর কথা থাকলে গাছ লাগাতে হবে। গাছ না লাগিয়ে টাকা উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। সরকারি খালের পাড়ে গাছ লাগাতে স্থানীয়রা বাধা দেবে কেন! বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। আমি মনে করি পুকুর ও খাল পাড়ে গাছ লাগানো উচিত। না হলে খাল ও পুকুর বর্ষায় ভরাট হয়ে যাবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে খাল উন্নয়ন বা পুনঃখনন এক হাজার ৭শ কিলোমিটারের মধ্যে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৬০৯ কিলোমিটার খাল উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে। ২১৯ কিলোমিটার খালের উন্নয়নের কাজ চলমান। পুকুর/দিঘি (প্রাতিষ্ঠানিক) উন্নয়ন/পুনঃখনন এক হাজার ৯শ একরের মধ্যে ১২২০ দশমিক ৪১ একর প্রাতিষ্ঠানিক পুকুর উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে এবং ৯৫ দশমিক ৩৩ একর প্রাতিষ্ঠানিক পুকুর উন্নয়নের কাজ চলমান। খাস খাল ও প্রাতিষ্ঠানিক পুকুরের চলমান খননকাজের অগ্রগতি ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ। অবশিষ্ট ৮৭০ দশমিক ৯৯৮ কিলোমিটার খাল এবং ৫৮৪ দশমিক ২৬ একর প্রাতিষ্ঠানিক পুকুর উন্নয়নের কাজ ধারাবাহিকভাবে চলবে। তবে এসব কাজের মধ্যে গাছের চিহ্ন খুঁজে পায়নি আইএমইডি।

এমওএস/এএসএ/জেআইএম