ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

দাবি আদায়ে কর্মবিরতি-অবরোধ কতটা যৌক্তিক?

মুসা আহমেদ | প্রকাশিত: ০৮:৫২ এএম, ২২ আগস্ট ২০২৪

• চাকরি রাজস্বকরণের দাবি নিয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেসের কর্মীরা
• চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও ও সড়ক অবরোধ করেন গ্রামপুলিশ সদস্যরা
• দোকান ভাড়া কমানোর দাবিতে সড়ক অবরোধ করছেন বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের দোকানিরা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের টানা ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনের অবসান হয় গত ৫ আগস্ট। অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে সবে দায়িত্ব নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ যেখানে সবচেয়ে বড়। নতুন সরকার দায়িত্ব নিতে না নিতেই বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ, কর্মবিরতি শুরু করেছেন সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, সংগঠনও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিদিন পথে নামছে। ফলে সরকারের সামগ্রিক কাঠামোতে পড়ছে প্রভাব। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনাসহ সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয় মনোযোগ হারাচ্ছে। আর্থিকখাত, প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে।

দাবি আদায়ে কর্মবিরতি-অবরোধ কতটা যৌক্তিক?

কিছু তরুণ প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যখন অনিয়ম-দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সংস্কারের পথে হাঁটার চেষ্টা করছে তখন বিভিন্ন দাবিতে রাস্তাঘাট অবরোধ, কর্মবিরতি, আন্দোলন কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।

এখন যে পরিস্থিতি, সরকার এখনো স্ট্যাবল হতে পারেনি। এই সময়ে কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্মবিরতি করা অন্যায়। আমি মনে করি সরকারকে একটু স্ট্যাবল হতে দিতে হবে।- বিকেএমইএতে নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম

সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো সব কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু এর মধ্যেই বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখনই তাদের এ আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। সবার উচিত দেশ পুনর্গঠনে আগে সরকারকে সহযোগিতা করা। আর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকারের প্রথম কাজ হবে সবার যৌক্তিক দাবি পর্যালোচনা করা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। এ সরকারের উপদেষ্টারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন তারা নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বিভিন্ন অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দ খোঁজ নিচ্ছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন-অবরোধে তারাও অনেকটা বিপাকে। কোনো কিছুর সমাধান দিতে গেলে তাদের আগে বোঝার বিষয় থাকে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা যেন কোনো সময় দিতেই নারাজ!

এ সময়ে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা কতটুকু

চাকরি রাজস্বকরণের দাবিতে বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুবিভাগের আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেসের (আইডিইএ)-২ প্রকল্পের ২ হাজার ২৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের এ কর্মবিরতির কারণে সারাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যদিও তাদের নিয়োগপত্রে রাজস্বকরণের কোনো শর্ত ছিল না।

সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি আদায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। তাদের দাবি চাকরি স্থায়ী করার।’

এখন দাবি আদায়ের নামে যা হচ্ছে, তা তো ব্ল্যাকমেইল করার মতো। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। তারপর যার যা দাবি, সেটা অফিসিয়ালভাবে জানাতে পারে।-বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়াদের এভাবে স্থায়ী করাটা কতটা সঠিক- এমন প্রশ্নে পিএসসির সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেখুন, কোন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়াকে স্থায়ী করা হচ্ছে, সেটা বড় বিষয়। টেকনিক্যাল একটা পদে একজনকে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি হয়তো এক্সপার্ট নন। তাকে স্থায়ী করা মানে তো আত্মহত্যা করার শামিল। আবার গ্রামপুলিশ, আনসার। তাদের তো স্থায়ী করা যায়। সরকারকে পরিস্থিতি সামলাতে আশ্বস্ত করার পথে হাঁটতে হবে। কিছু জায়গায় কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে হবে। তা না হলে এটা চলতেই থাকবে।’

দাবি আদায়ে কর্মবিরতি-অবরোধ কতটা যৌক্তিক?

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করেন গ্রামপুলিশের সদস্যরা। এতে গুলিস্তান, পল্টন, শিক্ষাভবন এলাকার সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ নিজ ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘দেশ পুনর্গঠনের জন্য যথাযথ সময় না দিয়ে সচিবালয় ঘেরাও করা এবং রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলনের নামে ১৬ বছরের ব্যর্থতার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপানো একটি স্বৈরাচারী ষড়যন্ত্র।’

একই দিন এইচএসসি ও সমমানের স্থগিতের দাবিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঢুকে যায় শতাধিক শিক্ষার্থী। পরে তাদের দাবির মুখে পরীক্ষা বাতিল করে সরকার। শিক্ষার্থীদের এ আচরণ ভালোভাবে নেয়নি অনেকে। এমনকি বড় একটি অংশের অভিভাবকরাও পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে ছিলেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহও গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিলের বিষয়টি তারা সমর্থন করেন না।’

ফ্লাইট সার্ভিসে সব চুক্তিভিত্তিক কেবিন ক্রুদের চাকরি স্থায়ী ও পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করা, করোনার সময়ে সব রকম স্থগিত করা ভাতা পুনর্বহালসহ ২০ দফা দাবিতে গত ৮ আগস্ট থেকে বিক্ষোভ করছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রুরা। রোববার (১৮ আগস্ট) বিমানের বলাকা ভবনে অবস্থান নিয়ে তারাও কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিমান কেবিন ক্রু ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে কেবিন ক্রুরা সর্বাত্মক বৈষম্যের স্বীকার হয়েছে। ক্রুদের মনে এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। দাবি আদায়ে কেবিন ক্রু ইউনিয়ন কর্মবিরতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।’

কর্মবিরতি দিয়ে দাবি আদায় করা সঠিক পথ বলে মনে করেন নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি, সরকার এখনো স্ট্যাবল হতে পারেনি। এই সময়ে কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্মবিরতি করা অন্যায়। আমি মনে করি সরকারকে একটু স্ট্যাবল হতে দিতে হবে। সরকার স্ট্যাবল হলে যৌক্তিক দাবি তারা মেনে নেবে। এজন্য কর্মবিরতির প্রয়োজন হবে না। মানুষের যৌক্তিক দাবি সরকার মেনে নেবে বলে বিশ্বাস করি।’

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিংমলে দোকান ভাড়া কমানো ও মার্কেটের ইনচার্জের পদত্যাগের দাবিতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছেন ব্যবসায়ীরা। তারই ধারাবাহিকতায় বুধবার (২১ আগস্ট) সকালে সড়ক আটকে বিক্ষোভে নামেন তারা। ফলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ফার্মগেট, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর রোডসহ বেশিরভাগ সড়কেই তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

গত ১৮ ও ১৯ আগস্ট ঢাকার সাভারে অবস্থিত ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) সামনে বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রার্থীরা। এতে নবীনগর থেকে চন্দ্রা মহাসড়কের উভয় পাশের অন্তত ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। এ কর্মসূচির কারণে ভোগান্তিতে পড়েন সংশ্লিষ্ট যাত্রী ও চালকরা।

দাবি আদায়ের নামে সড়ক অবরোধ করে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন দাবি আদায়ের নামে যা হচ্ছে, তা তো ব্লাকমেইল করার মতো। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। তারপর যার যা দাবি, সেটা অফিসিয়ালভাবে জানাতে পারে।’

কিছুদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যে আন্দোলন হচ্ছে তার অধিকাংশ দাবি অযৌক্তিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত সবার দাবি একত্রিত করে পুরো চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলা করা। এজন্য সরকারের উচিত এসব দাবির বিরুদ্ধে জনসমর্থন তৈরি করা এবং আন্দোলনকারীদের বলা, আপনারা ধৈর্য ধরেন, যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হবে। রাস্তা বন্ধ করে জনদুর্ভোগ করবেন না।’

সরকারের করণীয় কী হতে পারে

অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই দাবি দাওয়ার বিষয়ে সদয় ছিল বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সদয় ছিল। এখন সবাই মনে করছে, আমি চাইলেই পাবো। আর অন্তর্বর্তী সরকারও বিভিন্ন চাপে একটু নাজুক অবস্থায় আছে। এই সুযোগটা নিচ্ছে অনেকে। যেটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। আগে তো দেখবে জনস্বার্থ, দেশের স্বার্থ। তারপর যেটা যৌক্তিক দাবি পূরণ করবে। আস্তে-ধীরে দেবে।’

দাবি আদায়ে কর্মবিরতি-অবরোধ কতটা যৌক্তিক?

‘এত তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে খুব তাড়াহুড়া হয়ে যাচ্ছে। সবাই মনে করছে আমি চাপ দিলেই পাবো। সবাই নিজ নিজ গ্রুপ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এভাবে সব গ্রুপের দাবি দাওয়া নিয়ে নেমে পড়াটা হতাশাজনক, দুঃখজনক, এমনটা হওয়া উচিত নয়।’

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এতটা উদার হয়ে আপনি যদি সব দাবি মানেন, দেশের যে আর্থিক অবস্থা, সামাল দেবেন কীভাবে? সবার দাবি কীভাবে পূরণ করবেন। এত পদ কোথায় সৃষ্টি করবেন, এতগুলো দেবেন কী করে? তাহলে প্রশাসনে ভারসাম্য নষ্ট হবে। দেশের স্বার্থ চিন্তা না করে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে দাবি-দাওয়া পূরণে সরকার অগ্রসর হলে এটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। খুব সুচিন্তিতভাবে ভালোভাবে এটা সামাল দিতে হবে।’

এমএমএ/এএসএ/জিকেএস