বেঁচে আছেন আমির
পুলিশ ৬টা গুলি করে, এরপর ৩ তলায় পড়ে যাই
লাফ দিলে রক্ষা নেই, আবার রড ধরে ঝুলে থাকাও কঠিন। এ অবস্থায় খুব কাছ থেকে আমির হোসেনকে ছয়টি গুলি করেন পুলিশ সদস্যরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আমির হোসেনের সেই ঝুলে থাকার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর হাজারো মানুষ চোখের পানি ফেলেছেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, সেই তরুণ হয়তো আর বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে আছেন। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীর মেরাদিয়ার বাসায় ফিরেছেন ১৯ বছর বয়সী আমির হোসেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সেই ভয়াবহ স্মৃতি জানিয়েছেন জাগো নিউজকে।
আমি নিচে লাফ দেই নাই। এরপরেও পুলিশ গুলি করে। প্রথমে গুলি আমার গায়ে লাগে নাই, পাশ দিয়ে চলে যায়। আমাকে বার বার ভয় দেখাচ্ছিল যাতে আমি লাফ দেই। এরপর আরেকজন পুলিশ তিন তলায় গিয়ে ৬টা গুলি করে, সেই গুলি আমার দুই পা ও উরুতে লাগে। সবগুলো গুলি এক জায়গায় দিয়ে ঢুকে অন্য জায়গায় দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর আমি তিন তলায় পড়ে যাই।-গুলিবিদ্ধ আমির হোসেন
১৯ জুলাই কী ঘটেছিল আমিরের সঙ্গে?
১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৩টা কিংবা তার একটু বেশি সময়। বনশ্রীতে থমথমে পরিস্থিতি। হোটেলে কাজ করে বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। বনশ্রী-মেরাদিয়া রাস্তায় দুই পাশে পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে পেয়ে যান তিনি। একপর্যায়ে পাশে থাকা নির্মাণাধীন চার তলা একটি ভবনের ছাদে উঠে পড়েন আমির। তার পিছু পিছু পুলিশও যায়। একপর্যায়ে প্রাণে বাঁচতে রড ধরে ঝুলতে থাকেন তিনি। পুলিশ সদস্যরা তাকে দেখেই গুলি শুরু করেন। আর নিচে লাফ দিতে বলেন।
- আরও পড়ুন
- যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন চোখে গুলি লেগে আহতরা
- ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা
- পরিচয়পত্রটি তার পকেটে ছিল রক্তে ভেজা
আমির হোসেন বলেন, ‘আমি নিচে লাফ দেই নাই। এরপরেও পুলিশ গুলি করে। প্রথমে গুলি আমার গায়ে লাগে নাই, পাশ দিয়ে চলে যায়। আমাকে বার বার ভয় দেখাচ্ছিল যাতে আমি লাফ দেই। এরপর আরেকজন পুলিশ তিন তলায় গিয়ে ছয়টা গুলি করে, সেই গুলি আমার দুই পা ও উরুতে লাগে। সবগুলো গুলি এক জায়গায় দিয়ে ঢুকে অন্য জায়গায় দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর আমি তিন তলায় পড়ে যাই।’
‘আমি তখন পুলিশকে বার বার বলার চেষ্টা করছিলাম, আমি কোনো আন্দোলনের সাথে যুক্ত নই। তারা আমার কথা না শুনে বার বার নিচে লাফ দিতে বলে। কিন্তু নিচে ইট আর রড ছিল। ঝাঁপ দিলে আমি মনে হয় মরে যেতাম। যার কারণে আমি লাফ দেই নাই।’ বলছিলেন আমির হোসেন।
সেদিন পুলিশ যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, পুলিশ আমাকে বুকে পেটে মাথায় গুলি করতে পারতো। তারা চেয়েছে আমি যেন লাফ দিয়ে পড়ে যাই, আর এত ওপর থেকে লাফ দিলে মনে হয় না আমি বাঁচতাম। কিন্ত যেসময় গুলি করছিল, মনে হয়েছিল আমি আর বাঁচবো না। আমি যন্ত্রণায় ছটফট আর গড়াগড়ি করছিলাম।-গুলিবিদ্ধ আমির হোসেন
‘পুলিশ যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে’
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে আমির হোসেন বলেন, ‘সেদিন পুলিশ যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, পুলিশ আমাকে বুকে পেটে মাথায় গুলি করতে পারতো। কিন্তু তারা চেয়েছে আমি যেন লাফ দিয়ে পড়ে যাই। আর এত ওপর থেকে লাফ দিলে মনে হয় না আমি বাঁচতাম। কিন্তু যেসময় গুলি করছিল, মনে হয়েছিল আমি আর বাঁচবো না। আমি যন্ত্রণায় ছটফট আর গড়াগড়ি করছিলাম। এরপর আমার চিৎকার শুনে চার-পাঁচজন লোক এসে আমাকে বনশ্রীর ফেমাস হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যান্ডেজ ও রক্ত বন্ধ করার পর রাত ১টার দিকে আমাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাওয়া হয়। ৫টা গুলি গুলি লাগে পায়ে। একটা গুলি লাগে উরুর পাশে।’
মা নেই, ঢাকায় আমিরের অভিভাবক ফুপু
আমিরের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। কয়েকবছর আগে মাকে হারিয়ে তারা তিন ভাই-বোন ঢাকায় মেরাদিয়ার নোয়াপাড়ায় ফুপুর বাসায় চলে আসেন। বাবা বিল্লাল মিয়া গ্রামে অটোরিকশা চালান। হোটেলে কাজ করে সংসার চালান আমির হোসেন।
- আরও পড়ুন
- রাস্তায় বেরোতেই হঠাৎ কী যেন এসে পেটে লাগে, হাত দিয়ে দেখি রক্ত
- ১৭ জুলাই সাঈদের ছবি পোস্ট, দুদিন পর নিজেই গুলিতে নিহত হন মামুন
- আমাদের কলিজার ওপর দিয়ে গাড়ি গেছে, কঠিন বিচার চাই
ভবিষ্যৎ নিয়ে আমিরের দুশ্চিন্তা
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমির হোসেন বলেন, ‘সুস্থ হলে ঠিকভাবে কাজ করতে পারব কিনা জানি না। ডাক্তার বলেছেন, ভবিষ্যতে ভারী কোনো কাজ করা যাবে না। যেহেতু পায়ে ছয়টি গুলি লাগছে, ভারী কিছু নিয়ে পায়ের ওপর ভর করা যাবে না।’
বর্তমান চিকিৎসার বিষয়ে আমির বলেন, ‘আমরা দুই ভাই ঢাকায় কাজ করি। কিছু টাকা ফুপুর কাছে জমানো ছিল, ছোট বোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই টাকা দিয়ে এখন চিকিৎসা চলে। ইতিমধ্যে কিছু সহায়তাও পেয়েছি।’
এ সময় পাশ থেকে আমির হোসেনের ফুপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওইদিন বিকেলে হাসপাতাল থেকে কল পাই ভাইপুত গুলি খাইছে। এরপর এই থমথমে পরিস্থিতিতে হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল। খুব দুঃসহ দিন যাচ্ছে। ওর মা নেই। ঢাকায় আমরাই সবকিছু দেখাশোনা করি।’
পুলিশ সদস্যদের বিচার দাবি
গুলি করা পুলিশ সদস্যদের বিচার চেয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘আমি ওই পুলিশ সদস্যদের বিচার চাই। আমি নির্দোষ। আন্দোলনেও ছিলাম না। ওই মুহূর্তের কথা মনে উঠলেই কষ্ট লাগে খুব।’
আরএএস/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস