সাবেক আইজিপিদের মত
ইউনিফর্ম-লোগো পরিবর্তন কাজে আসবে না যদি কার্যকলাপ পরিবর্তন না হয়
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও হাসিনা সরকারের পতনের পর টালমাটাল অবস্থা দেশের পুলিশ বাহিনীর। একাধিক দাবিতে ৫ আগস্টের পর থেকেই কর্মবিরতি পালন করছিল তারা। সুযোগ নিয়ে চুরি, ডাকাতি, লুটসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এক শ্রেণির মানুষ।
গত ১২ আগস্ট স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি পেয়ে কর্মবিরতিসহ সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কাজে ফেরেন পুলিশ সদস্যরা। বর্তমান ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন নিয়ে ওঠে দাবি। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ঘোষণা দেন পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন হবে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তনের বিষয়ে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে পুলিশ সদরদপ্তর। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ইউনিফর্ম-লোগো পরিবর্তনের বিষয়ে সাবেক আইজিপিরা (পুলিশের মহাপরিদর্শক) ভিন্ন মত দিয়েছেন। তারা বলছেন, একটা বাহিনীর ইউনিফর্ম পরিবর্তন করে খুব বেশি কাজে আসবে না, যতক্ষণ নিজেদের কার্যকলাপ পরিবর্তন না করা যায়। আগেও অনেকবার পোশাক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পুলিশের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইউনিফর্ম পরিবর্তনের দাবি যদি পুলিশ সদস্যদের ভেতর থেকে আসে তবে সরকার বিবেচনা করে দেখবে। যুক্তিসঙ্গত ন্যায্য দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহোদয়।’
ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন করলে সদর্থক কী পরিবর্তন হতে পারে তা আমি নিশ্চিত না। যারা করছেন তারা বলতে পারবেন। ইউনিফর্ম পরার জন্য ওই ব্যক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কযুক্ত মনে হয় না।- সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা
জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তন করলে সদর্থক কী পরিবর্তন হতে পারে তা আমি নিশ্চিত না। যারা করছেন তারা বলতে পারবেন। ইউনিফর্ম পরার জন্য ওই ব্যক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কযুক্ত মনে হয় না। আমি যে কাপড় পরি সেই কাপড় আমাকে নির্দিষ্ট করে দেয় না আমার ব্যবহার-আচরণ কেমন হবে।’
আরও পড়ুন
- ছাত্র আন্দোলন দমনের নির্দেশ শেখ হাসিনার, গুলির নির্দেশ কামালের
- ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা
- জীবন বাঁচাতে ৯৯৯-এ ফোন দেন পুলিশ সদস্যরাও
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পোশাক-লোগো পরিবর্তনে পুলিশের বাহ্যিক বিষয়গুলো না দেখে ভেতরেরগুলো দেখা দরকার। এই মুহূর্তে পোশাক পরিবর্তন করা প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) কি না সেটা আমার প্রশ্ন। মানুষ একটা জায়গায় এসে প্রথমে প্রায়োরিটি ফিক্স (নির্ধারণ) করে কোনটা আগে কোনটা পরে করা হবে। পোশাক-লোগো পরিবর্তন করে পুলিশের ভেতর পরিষ্কার করতে পারবেন? পারবেন না। আগে অনেকবার লোগো পরিবর্তন হয়েছে, পোশাক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কোনো পরিবর্তন হয়নি।’
সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে চাইবে পুলিশের লোগোর মধ্যে ধানের শীষ লাগাতে, আওয়ামী লীগ এলে চাইবে ওইগুলো বাদ দিয়ে নৌকা লাগাতে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীসময়ে খুব বেশি কার্যকর হবে তা বলতে পারি না। অন্তর্বর্তী সরকার থাকে অল্প সময়ের জন্য। তারা পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো করবে, যাতে ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারে। এখন জরুরি হলো পুলিশকে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরিয়ে আনা। আনার পর সাধারণ মানুষের আস্থা, বিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা।’
নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘পুলিশে দক্ষ কর্মচারী-কর্মকর্তার অভাব নেই। তাদের ভালো ভালো জায়গায় প্লেস করুক। মানুষ যাতে ভালো সেবা পায়। গত কয়েক বছরে পোস্টিং দিয়ে টাকা-পয়সা নেওয়াটা খারাপ করে গেছে। পুলিশের যে ভালো কাজ করবে তাকে পুরস্কার দেবেন আর যে মন্দ কাজ করবে তাকে শাস্তি দেবেন। কনস্টেবল-দারোগাকে শাস্তি দিয়ে লাভ নেই। ওপর থেকে ধরতে হবে। দু-একটা ধরে দেখেন কাজ হবে।’
পোশাক-লোগো পরিবর্তন করে পুলিশের ভেতর পরিষ্কার করতে পারবেন? পারবেন না। আগে অনেকবার লোগো পরিবর্তন হয়েছে, পোশাক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কোনো পরিবর্তন হয়নি।- সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ
পুলিশের পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের বিষয়ে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদরদপ্তর। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (লজিস্টিকস) মোহাম্মদ আতাউল কিবরিয়াকে সভাপতি করে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- অতিরিক্ত ডিআইজি (ডেভেলপমেন্ট রেভিনিউ) ড. শোয়েব রিয়াজ আলম, অতিরিক্ত ডিআইজি (ওঅ্যান্ডএম) ফারুক আহমেদ, অতিরিক্ত ডিআইজি (এপিবিএন) মোহাম্মদ শিহাব কায়সার, পুলিশ সুপার (এপিবিএন) আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (লজিস্টিকস) মো. নুরুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নৌ পুলিশ) জুয়েল রানা, পুলিশ পরিদর্শক (সিআইডি) মো. জাহিদুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সান্টুর রহমান ও কনস্টেবল বরকত উল্লাহ।
এ কমিটি ইউনিফর্ম তৈরির কাপড়ের মান, ইউনিফর্মের ডিজাইন তথা যে কোনো টেকনিক্যাল বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সদস্যদের কমিটিতে কো-অপ্ট (অন্তর্ভুক্ত) করতে পারবেন বলেও নির্দেশনায় জানানো হয়েছে।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা-আক্রমণ ও হত্যার শিকার হন পুলিশ সদস্যরা। এরপর থেকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ভয় ও আতঙ্কে কাজে ফিরছিল না তারা। পরে কেউ কেউ থানায় ফিরলেও তারা সাদা পোশাকে ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ১১ দফা দাবি দেন পুলিশ সদস্যরা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাক ছিল খাকি রঙের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক আগেই তা বদলে গেছে। দু’বার পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের পোশাকের রঙে পরিবর্তন আনা হয়। মহানগর ও জেলা পর্যায়ে দুই রঙের পোশাক দেওয়া হয়। তবে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও ব্যাটালিয়নভেদে পোশাকের ভিন্নতাও রয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটলিয়নের (এসপিবিএন) পোশাক সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙের।
২০০৪ সালে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেওয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। র্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এসপিবিএনের পোশাকের জামার রং করা হয় ধূসর।
টিটি/এএসএ/এমএস