ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

শেখ হাসিনার পতনের পর গুলি

ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

আবদুল্লাহ আল মিরাজ | প্রকাশিত: ১১:১৩ এএম, ১৩ আগস্ট ২০২৪

বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছিল। প্রাণে বাঁচলেও ক্ষত নিয়ে এখনো হাসপাতালের শয্যায় ভাঙারি ব্যবসায়ী জহিরুল সিকদার। ঘরে স্ত্রী, সন্তান রয়েছে। ক্ষত সারলেও ভারী কাজ করতে পারবেন না। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ জহিরুলের, কীভাবে চলবে জীবন-সংসার।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট রাত ১১ টার দিকে বাসায় ফিরছিলেন বংশালের ভাঙারি ব্যবসায়ী জহিরুল সিকদার। এ সময় পাশ দিয়ে বিজয় মিছিল যাচ্ছিল। হঠাৎ জহিরুলের বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগে ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। লোকজন ধরাধরি করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে। সেখান থেকে শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালে পাঠানো হয়। আবার সেখান থেকে মহাখালীতে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। এরপর থেকেই পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের ৩ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন জহিরুল সিকদার।

ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

জহিরুলের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘একটা ছয় বছরের ছেলে আছে। আমার স্বামীর যে অবস্থা হয়েছে, বলার ভাষা নাই। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সুস্থ হলেও জীবনে কোনো ভারী কাজ করতে পারবে না। সারা জীবনের জন্য এই আঘাত টেনে নিতে হবে।’

একটা ৬ বছরের ছেলে আছে। আমার স্বামীর যে অবস্থা হয়েছে, বলার ভাষা নাই। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সুস্থ হলেও জীবনে কোনো ভারী কাজ করতে পারবে না। সারা জীবনের জন্য এই আঘাত টেনে নিতে হবে।-গুলিবিদ্ধ জহিরুলের স্ত্রী

শুধু জহিরুল নন, বুলেটের আঘাতে বুক-পিঠ ও ফুসফুসের ক্ষত নিয়ে আরও অনেকে এসেছেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন রোগীরা। এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন তারা। তবে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি কেউ। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধও কিনতে হয়েছে নিজেদের খরচে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ রুমে বেশিরভাগ আহত রোগী বিশেষভাবে ভর্তি আছেন। অনেকের আঘাত এতটাই নাজুক যে আর কখনো পরিপুর্ণ সুস্থ্য হওয়া বা জীবনে ভারী কোনো কাজই করতে পারবেন না। বুক-পিঠ ও ফুসফুসে গুলির ক্ষতজনিত আঘাত নিয়ে এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি আছে ১২ জন রোগী। এদের মধ্যে পাঁচজনকে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের ১, ৩, ৫, ৮ ও ৯ নম্বর শয্যায় ভর্তি থাকতে দেখা যায়। এছাড়া পাঁচজনকে রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিট (আরসিইউ) অর্থাৎ শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া একজন আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, গত ১৯ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত বুক-পিঠ ও ফুসফুসে আঘাত নিয়ে ৪০ জন রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে। তাদের সবারই সার্জারি প্রয়োজন ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক ছিল। চিকিৎসা নিতে আসা দুইজন মারা গেছেন এই হাসপাতালে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মেহেদী হাসান বলেন, চিকিৎসাধীন রোগীদের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। যাদের বেশিরভাগেরই মেজর অপারেশন করতে হয়েছে। কিছু রোগীর কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিতে হয়েছে। কিছু রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে।

ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের এক নম্বর শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল ১৭ বছর বয়সী মাকসুদুর রহমান মুন্না। তার ভাই মেহেরাজ মিথুন জানান, শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের খবরে ৫ আগস্ট বিকেলে তিনি ও মুন্না বংশাল থানার সামনে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। ওই সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে মুন্নাসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়। তাদের তিনজন বর্তমানে এই ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন।

বুকে গুলিবিদ্ধ বা ইনজুরি হলে অনেকের ফুসফুসের পর্দা বড় হয়ে যায়। রক্ত ও বাতাস জমে সমস্যা হয়। চিকিৎসা না হলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে টিউব দিয়ে বাতাসের মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখা হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে হয় খাদ্যনালী, রক্তনালী পর্যন্ত গুলির ক্ষত পৌঁছেছে এমন গুরুতর রোগীদের নিয়ে। এ ধরনের রোগীদের পূর্ণ সুস্থ হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়।-বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়রুল আনাম

মুন্নার মা রোজিনা ইয়াসমিন বলেন, গুলি লেগে ছেলের পিঠের বাঁ পাশের মেরুদণ্ড ভেদ করে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখান থেকে এখানে রেফার্ড করা হয়েছে। সিটি স্ক্যান ও এক্সরে রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক জানিয়েছেন, শরীরে বিদ্ধ গুলি তিন টুকরো হয়ে ভেতরে রয়ে গেছে। ক্ষতস্থানে এখনো ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে। ফুসফুসেও আঘাত লেগেছে। দীর্ঘদিন ভর্তি থাকতে হবে। শরীরের ভেতরে রক্তপাত বন্ধ হলে তবেই অস্ত্রোপচার করে গুলির টুকরোগুলো বের করা হবে। ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে কি না, হলেও কতদিন লাগবে তা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না তার।

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের ৫ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ ১৪ বছর বয়সী মো. ইয়াসিন। তারা বাবা ইলিয়াস হোসেন বলেন, ছেলে গত ৫ আগস্ট সাভারে বিজয় মিছিলে গিয়ে পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়। প্রথমে বেসরকারি এনাম মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানান, শরীরে লাগা বুলেট ফুসফুস পর্যন্ত চলে গেছে। পরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে রেফার্ড করলে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করে বুলেট বের করেন। ফুসফুসের উন্নত চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে পাঠানো হয়। সুস্থ হতে কতদিন লাগবে, কবে ছুটি দেবে চিকিৎসকরা কিছুই বলছেন না।

ভর্তি হওয়া রোগীদের বিষয়ে জানতে চাইলে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়রুল আনাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বুকে গুলিবিদ্ধ বা ইনজুরি হলে অনেকের ফুসফুসের পর্দা বড় হয়ে যায়। রক্ত ও বাতাস জমে সমস্যা হয়। চিকিৎসা না হলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে টিউব দিয়ে বাতাসের মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ঠিক রাখা হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় সংকটে পড়তে হয় খাদ্যনালী, রক্তনালী পর্যন্ত গুলির ক্ষত পৌঁছেছে এমন গুরুতর রোগীদের নিয়ে। এ ধরনের রোগীদের পূর্ণ সুস্থ হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়।’

ফুসফুসে ক্ষত, হাসপাতালে ধুঁকছেন আহতরা

শুরুর দিকে আহতদের চাপ সবচেয়ে বেশি ছিল জানিয়ে ডা. খায়রুল আনাম বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষায়িত ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় আহতদের। এর মধ্যে কয়েকজনকে আইসিইউতে নিলে কিছুটা সুস্থ হলে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত দুইজন মারা গেছে এখানে। আন্দোলনের সময় আশেপাশের ঘটনায় অনেক আহত চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। কারো হাত ভাঙা, কারো পায়ে হাতে গুলি লেগেছে এমন। তাদের আমরা দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অন্য হাসপাতাল যেমন ঢাকা মেডিকেল ও পঙ্গু হাসপাতালে পাঠাই।’

চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট নিয়ে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয় এখানে। তবে সিটি স্ক্যানের ফিল্মের জটিলতায় আপাতত বন্ধ রয়েছে। ওষুধ যা সরকারিভাবে আছে তাই ঠিকমতো দেওয়া হয়। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’

এএএম/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস