আমিরাতে ৫৭ বাংলাদেশির সাজা, মুক্তির উপায় কী?
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কয়েকটি সড়কে বিক্ষোভ করায় ৫৭ বাংলাদেশি শ্রমিককে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে দেশটির আদালত। দণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিকদের জন্য এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। সরকার যেন প্রবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে বা তারা যেন সাধারণ ক্ষমা পান, সেই উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে গত ২৫ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘যে দেশে বসবাস করবে সে দেশের আইন সম্পর্কে কর্মীদের সচেতন হওয়া উচিত। যারা আইন ভঙ্গ করবে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে, তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’
আরব আমিরাতে দণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশের নাগরিকদের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশটির আইন ভঙ্গ করায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। এখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। এটি তাদের রাষ্ট্রীয় বিষয়।
‘যে দেশে বসবাস করবে সে দেশের আইন সম্পর্কে কর্মীদের সচেতন হওয়া উচিত। যারা আইন ভঙ্গ করবে, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে, তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’-শফিকুর রহমান চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়
১৯ জুলাই আরব আমিরাতে যা ঘটেছে
গত ২৩ জুলাই বিবিসির অনলাইনে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, আসামিরা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি রাস্তায় জড়ো হয়ে বড় আকারের মিছিল বের করে। সেদিন দেশটির পুলিশ তাদের সতর্ক করলেও বিক্ষোভকারীরা থামেনি। এ কারণে তাদের আটক করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, টিকটক টুইটারে পোস্ট করা প্রতিবাদের ছয়টি ভিডিও তারা যাচাই করেছে। ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় আবুধাবি, আজমান, আল সাতওয়া ও ডাউনটাউন দুবাইয়ে প্রবাসীরা শান্তিপূর্ণ স্লোগান দিচ্ছেন এবং রাস্তায় নেমে মিছিল করেছেন।
- আরও পড়ুন
আমিরাতে শ্রমিক নেওয়া বন্ধের খবর সঠিক নয়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী - বছরে দুই হাজার দক্ষ কর্মী নেবে আরব আমিরাত: প্রতিমন্ত্রী
- চাকরি নিশ্চিত হয়ে বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে আমিরাত
- কুয়েতে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে
তারা বলছেন, প্রতিবাদকারীরা কেউই হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত ছিলেন না বা তাদের দেওয়া স্লোগানে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য ভাষা ব্যবহার করেননি।
আরব আমিরাতের আইনে যা বলা আছে
সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও সভা-সমাবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। দেশটির দণ্ডবিধি, ২০২১ এর ২১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে, যে সমস্ত ব্যক্তি দাঙ্গা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে মিছিল, মিটিং বা প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিবে, চেষ্টা করবে, অথবা উসকানি দেবে তাদেরকে এই আইন অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেবে আদালত।
‘যে কোনো বাংলাদেশি প্রবাসে বিপদে পড়লে তারা কিন্তু আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে। সেক্ষেত্রে আমাদের সরকার যেন আদালতে তাদের সহায়তা করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বা তারা যেন সাধারণ ক্ষমা পান।’ শরিফুল হাসান, সহযোগী পরিচালক, ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম
আরব আমিরাতের সাইবার অপরাধ আইনের ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, উপরে উল্লেখিত অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পরিকল্পনা, সংঘটন, উসকানি দিলে সেগুলো অপরাধ বলে গণ্য হবে।
যে শাস্তি পেয়েছেন বাংলাদেশিরা
গত ২০ জুলাই আরব আমিরাতের অ্যাটর্নি জেনারেল হাম্মাদ আলী শামসী যে বাংলাদেশিরা সেখানে দাঙ্গা করেছে এবং অন্যদের উসকানি দিয়েছে সে ঘটনার তদন্ত আহ্বান করেন। পরদিন আদালত তাদের বিচার করে এবং সাজা ঘোষণা করে।
আমিরাতের সরকারি বার্তা সংস্থা ডব্লিউএএমের বরাত দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে, ১৯ জুলাই বিক্ষোভ চলাকালে জড়ো হওয়া ও দাঙ্গায় উসকানির দায়ে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। কারাদণ্ড শেষে সবাইকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আদেশও দিয়েছেন আদালত।
আপিল ও সাধারণ ক্ষমার ব্যবস্থা করা
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে কোনো বাংলাদেশি প্রবাসে বিপদে পড়লে তারা কিন্তু আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে। সেক্ষেত্রে আমাদের সরকার যেন আদালতে তাদের সহায়তা করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বা তারা যেন সাধারণ ক্ষমা পান। পাশাপাশি অভিবাসন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এ ব্যাপারে সোচ্চার হয় তাহলে শ্রমিকরা আইনি সহায়তা পেতে পারে।’
‘এখন কিন্তু পৃথিবী বদলাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের বিক্ষোভ মিছিল বা যে কোনো আন্দোলনের বিষয়ে তাদের আইন-কানুন নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ কিন্তু রয়েছে।’
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রমিকদের তালিকা পেলে আমরা সহায়তা করতে পারতাম। প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইন-কানুন আছে, সেখানে প্রতিটি নাগরিক ও বিদেশিদের সেই আইন মেনেই চলতে হয়। যারা গ্রেফতার হয়েছে, সাধারণ ক্ষমার ব্যবস্থার জন্য আমাদের দেশে তাদের দূতাবাসে চিঠি দেয় বা আইনিভাবে সহায়তা করে তাহলে হয়তো আরব আমিরাত সরকার বিবেচনা করতে পারে।’
‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই ধরনের যত সংগঠন আছে তাদের মাধ্যমে আমরা দুবাই সরকারের কাছে আপিল করতে চাচ্ছি। আমরা এ প্রক্রিয়া শুরু করলে সরকারও হয়তো আগাবে।’- তাসনিম সিদ্দিকী, চেয়ারম্যান, রামরু
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়টি শুনে আমরা খুবই মর্মাহত যে ১০-১২ বছর করে একেকজন শ্রমিককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মাইগ্রেশন নিয়ে কাজ করা আমাদের ২৩টি সংগঠন আছে। শিগগির আমাদের মিটিং আছে, সেখানে আমরা একটা পথ বের করব। আমরা একটা স্মারকলিপি তৈরি করব, যেখানে উল্লেখ করব, তারা আন্দোলন করে ফেলেছে, বিষয়টা বুঝে তারা করেনি। পুনর্বিবেচনার জন্য আমরা তাদের দূতাবাসে আপিল করব। শিগগির তাদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করব, তারা যেন আমাদের এই প্রবাসীদের একটু অন্য চোখে দেখে।’
‘আরেকটি বিষয় হলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের যত সংগঠন আছে তাদের মাধ্যমে আমরা দুবাই সরকারের কাছে আপিল করতে চাচ্ছি। আমরা এ প্রক্রিয়া শুরু করলে সরকারও হয়তো আগাবে’ বলে মনে করেন তাসনিম সিদ্দিকী।
তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের সরকারও কিছু করতে পারে। প্রতিটি আইনি ব্যবস্থায় শুনানির অধিকার রয়েছে। এই যে রায়গুলো হয়েছে সেখানে প্রপার শুনানি হয়েছে কি না? তাই শ্রমিকদের অবস্থা বিবেচনা করে আবার আপিলের মাধ্যমে শুনানি করে এ রায়কে পুনর্বিবেচনা করার জোর দাবি জানাতে হবে।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ সংকট মোকাবিলায় দুবাইতে আমাদের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে মানবিক দিক বিবেচনা করে তদন্ত করা বা আপিলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমাদের দূতাবাসের উচিত গ্রেফতার শ্রমিকদের কাছে যাওয়া, তাদের অন্তত আশ্বস্ত করা, খোঁজ নেওয়া।
- আরও পড়ুন
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কাজ করবেন না - ওমানে প্রবাসী কর্মী নিয়োগ কঠিন হলো
- টাকা গেছে বহু হাতে, ফেরত দিচ্ছে না কেউ
এছাড়া শ্রমিকরা ওই দেশের আইন-কানুন জানে কি না? সেখানে পাবলিকলি বিক্ষোভ-মিছিল ও প্রতিবাদ করা যায় কি না? আমরা জানি যে মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণত সংঘটিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করা, প্রতিবাদ করা যায় না। এটা আমাদের দেশের কর্মীরা জানে না। কিন্তু এসব আইন যারা জানে না, কেন জানে না? এই দায়টা কিন্তু আমাদের সরকারের। যদি জেনেও থাকে, তাহলে কেন বিক্ষোভ মিছিল করলো সেটাও তদন্ত করা উচিত।’
‘দুবাই গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার। ভালো রেমিট্যান্সও আসে। ভবিষ্যতে যেন এরকম পরিস্থিতি না হয় সে ব্যাপারে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি কর্মীরা যে দেশে যাবে তাদের সে দেশের আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।’- আসিফ মুনির, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ
আসিফ মুনির বলেন, ‘আমাদের প্রবাসী কল্যাণ বা বিএমইটি প্রি-ডিপার্চারে কর্মীদের যে ব্রিফিং করে, সেখানে সে দেশের আইন নিয়ে শ্রমিকদের কতটা স্পষ্ট করে, কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে সেই দেশের আইন শেখায় বা মান্য করার কথা বলে; এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’
‘আরেকটি বিষয় হলো নতুন কর্মীরা যাওয়ার আগে তাদের যে ওই দেশের ভাষা বা আইন নিয়ে সচেতন করা দরকার সেটুকু আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন দিতে পারছে না। কর্মীদের বিমানে ওঠার আধা ঘণ্টা আগে যে গৎবাঁধা ব্রিফিং দেওয়া হয়, এগুলো কর্মীদের মাথায় থাকে না। কর্মীরা ওই দেশে কী করতে পারবে, কী পারবে না এটা অবশ্যই কর্মীদের অবগত করে পাঠাতে হবে। এসব নিয়ম তো সরকার জানে। আমি মনে করি, রিক্রুটিং এজেন্সি, বিএমইটি, মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রভাব কর্মীদের মাঝে পড়ে।’ বলছিলেন আসিফ মুনির।
এদিকে সম্প্রতি প্রবাসী আয় ও রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক দিয়ে এ বছর শীর্ষ স্থানে হয়ে উঠে এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরব আমিরাত থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৪৫৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছর থেকে ১৫৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে ৩০৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার দেশে পাঠান প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে বাংলাদেশের কর্মীদের। এর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার আরব আমিরাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৭ শতাংশের বেশি কর্মীর। ১৯৭৬ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত দেশটিতে গেছেন ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯১ বাংলাদেশি কর্মী।
শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও সাজাকে কেন্দ্র করে শ্রমবাজার যেন নষ্ট না হয় সেদিকে মনোযোগ দিতে বলেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। আসিফ মুনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুবাই গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার। ভালো রেমিট্যান্সও আসে। ভবিষ্যতে যেন এরকম পরিস্থিতি না হয় সে ব্যাপারে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি কর্মীরা যে দেশে যাবে তাদের সে দেশের আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।’
আরএএস/এমএমএআর/জেআইএম