ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

রাস্তায় বেরোতেই হঠাৎ কী যেন এসে পেটে লাগে, হাত দিয়ে দেখি রক্ত

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ১০:৫০ এএম, ২৯ জুলাই ২০২৪

পরিবারের সঙ্গে শরীয়তপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন জালকুড়ি এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন সিফাত (১৮)। গত ১৯ জুলাই জুমার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে জালকুড়ি মেইন রোডে উঠতেই গুলিবিদ্ধ হন। পেটের ডান পাশে গুলি লাগে তার। তখনই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। পরে স্বজনদের একজন তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

সিফাত এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ব্লকের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। রোববার (২৮ জুলাই) সেখানে গিয়ে কথা হয় সিফাতের মা সুমা আক্তারের সঙ্গে।

নামাজ পড়ে রাস্তায় বের হইছিলাম। হঠাৎ কী যেন এসে দ্রুত পেটে লাগলো। হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। এরপর আর হাঁটতে পারিনি।- গুলিবিদ্ধ সিফাত

ছেলের এ অবস্থার বর্ণনা করে সুমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ঢাকায় থাকি না। শরীয়তপুর থেকে কদিনের জন্য জালকুড়িতে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম। আমার ছেলে লেখাপড়া ছেড়েছে দুই বছর। ১৯ জুলাই জালকুড়ির একটি মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে রাস্তায় ওঠতেই সে গুলিবিদ্ধ হয়। হঠাৎ কীভাবে কী হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। এরপর থেকে গত কয়েকদিন ধরে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আছি।

‘ওর বাবা অসুস্থ, কোনো কাজ করতে পারেন না। এলাকায় ফেরি বা নৌকায় করে কাঁচের জিনিসপত্র বিক্রির আয়ে কোনো রকম সংসার চলে। ছেলের জন্য হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধ দেয়, বেশিরভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কেনা লাগে। হঠাৎ এমন বিপদে খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।’

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা সিফাত এখন কথাবার্তা বলতে পারছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, নামাজ পড়ে রাস্তায় বের হইছিলাম। হঠাৎ কী যেন এসে দ্রুত পেটে লাগলো। হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। এরপর আর হাঁটতে পারিনি।

সরেজমিনে রোববার দেখা যায়, ঢামেক হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে ২৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যান্ডেজ করা। অনেকেই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কেউ কেউ ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। কারও পেটে, কারও বুকে, কারও হাতে গুলি লেগেছে। কারও কারও শরীরে তিনটি চারটি গুলিও লেগেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে কথা হলে শোনা যায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনা।

গত ১৮ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা খোরশেদ আলম। পেশায় তিনি দৈনিক মুক্তখবর পত্রিকার সাংবাদিক। গত ১০ দিন ধরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। খোরশেদ আলমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি ঈশারায় পাশে থাকা স্ত্রী নুরুন নাহার আক্তারকে দেখিয়ে দেন।

বিকেলে আসরের নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হন। এরপর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে একজন কল করে জানান উনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাসপাতালে এনে দেখি পেটে আর কোমরে তিনটি ও হাতে একটিসহ মোট চারটি গুলি লেগেছে।- গুলিবিদ্ধ খোরশেদের স্ত্রী নুরুন নাহার

নুরুন নাহার আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, উনি (খোরশেদ) শুক্রবার বিকেলে আসরের নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হন। এরপর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে একজন কল করে জানান উনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাসপাতালে এনে দেখি পেটে আর কোমরে তিনটি ও হাতে একটিসহ মোট চারটি গুলি লেগেছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নুরুন নাহার বলেন, এমন অবস্থা উনার অগ্ন্যাশয় কেটে বাদ দিয়েছেন চিকিৎসক। এখন পায়খানার ব্যাগ লাগিয়ে চলতে হবে। অবস্থার উন্নতি হলে হয়তো অপারেশন করা যাবে। তবুও সেটির নিশ্চয়তা নেই। দুই সন্তানকে বাসায় আমার মায়ের কাছে রেখে এসেছি। কতটা খারাপ অবস্থায় আছি বলার ভাষা নেই।

পাশের বেডেই গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা কাজি আবু হানিফ। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। গুলশান ১ নম্বরে তার একটি ছোট মোবাইল ফোনের দোকান রয়েছে।

রাস্তায় বেরোতেই হঠাৎ কী যেন এসে পেটে লাগে, হাত দিয়ে দেখি রক্ত

শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর আবু হানিফ খুব নিচু স্বরে কথা বলেছিলেন। পাশে থাকা স্ত্রী আবিদা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, (আবু হানিফ) শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে বের হয়েছিলেন। ক্যামব্রিয়ান স্কুলের গলির মাথা দিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে পেটের বাম দিকে। কোথা থেকে হঠাৎ এই গুলি এলো কিছু বুঝে উঠতে পারেননি উনি।

আবু হানিফের স্ত্রী আরও বলেন, খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার স্বামী কোনো আন্দোলন বা ঝামেলায় কখনো জড়াননি। ছোট্ট একটি দোকানের মাধ্যমে আমাদের পরিবার চলে। তিন ছেলেমেয়ের দুজন পড়ালেখা করছে। ওদের বাসায় রেখে হাসপাতালে পড়ে আছি। উনি অসুস্থ অবস্থায় আমাদের কথা ভেবে ভেবে আরও অস্থির হয়ে উঠছেন। এমন পরিস্থিতির শিকার হবো কখনো ভাবিনি।

আমার স্বামী কোনো আন্দোলন বা ঝামেলায় কখনো জড়াননি। ছোট্ট একটি দোকানের মাধ্যমে আমাদের পরিবার চলে। তিন ছেলেমেয়ের দুজন পড়ালেখা করছে। ওদের বাসায় রেখে হাসপাতালে পড়ে আছি।- আবু হানিফের স্ত্রী আবিদা সুলতানা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত দুইশোর মতো রোগী বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ঢামেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ১০১ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়াও কোটা আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে আহত রোগী রয়েছেন চক্ষু বিভাগ, বার্ন ইউনিট ও আইসিইউতেও।

বার্ন ইউনিট ভবনের চারতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় চোখে পড়ে গুলিবিদ্ধ সন্তান জুলফিকার আলীর (চিকিৎসাধীন) সঙ্গে বসে আছেন উত্তরার বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন ও তার বড় ছেলে জোবায়ের হোসেন। আহত জুলফিকার স্থানীয় আজমপুর নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখা গেছে।

জোবায়ের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে আমার ভাই অজ্ঞান অবস্থায় আছে। জ্ঞান ফিরলেও আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। আমরা খুব দুশ্চিন্তায় আছি।

জুলফিকারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমার ভাই পড়ালেখার পাশাপাশি একটি জিলাপির দোকানে সময় দিতো। ১৮ জুলাই বেলা ১১টায় দোকানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। এরপর আর বাসায় ফেরেনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সে আন্দোলনে গেছে। কিন্তু বিকেল গড়ালেও ঘরে না ফেরায় আমরা উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতাল, তুরাগ থানা, উত্তরা পূর্ব থানায় যোগাযোগ করতে থাকি। কিন্তু কোথাও হদিস পাচ্ছিলাম না। এমনকি ওইদিন ঢাকা মেডিকেলেও তার সন্ধান মেলেনি।

‘আমরা এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম। ছয়দিনের মাথায় ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউ থেকে একজন ডাক্তার আমাদের ফোন করে জানান, জুলফিকার ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। পরে আমরা হাসপাতালে আসি।’

রাস্তায় বেরোতেই হঠাৎ কী যেন এসে পেটে লাগে, হাত দিয়ে দেখি রক্ত

পাশে থাকা জুলফিকারের বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, আমার এই ছোট ছেলে গুলিবিদ্ধ হইছে। কে গুলি করছে জানি না। ছরা গুলি লেগে ওর চোখেরও ক্ষতি হইছে। আমি উত্তরা আবাসিক এলাকায় দোরোয়ানের কাজ করি। এ কয়দিনে ছেলের চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন আর পারছি না। ছেলের চিকিৎসা কতদিন চলবে, এই ক্ষত কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে, কবে স্কুলে যেতে পারবে, আমরা কিছুই জানি না।

বার্ন ইউনিটের এই ভবনে আইসিইউয়ের সামনে কথা হয় যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকার বাসিন্দা শহিদ আলমের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের ময়লার ভ্যানগাড়ি চালায়। শুক্রবার পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে মারধরের শিকার হয়। অনেক খুঁজেও সেদিন তাকে পাইনি। দুদিন পর ঢামেক হাসপাতালে এসে তার সন্ধান পাই। ওর থুতনি ভেঙে গেছে। কে মারছে? কীভাবে কী হলো কিছুই জানি না। সুস্থ হওয়ার পর ওর কাছ থেকে হয়তো শুনতে পারবো কে বা কারা তাকে মেরেছিল। আমার ছেলের একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। এখন কীভাবে ওদের সংসার চলবে বুঝতে পারছি না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত একজন নার্স জাগো নিউজকে জানান, এখানে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। আহতদের যে অবস্থা সুস্থ হতে অনেকটা সময় লাগবে।

জানা গেছে, কোটা আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন প্রায় ১১০০ মানুষ। তাদের মধ্যে ইট-পাটকেলে আহতরা চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। গুলিবিদ্ধদের অনেকে এখনো চিকিৎসাধীন।

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রোববার (২৮ জুলাই) গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা মেডিকেলে প্রায় ১২৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। প্রয়োজনীয় সব সেবা দেওয়া হচ্ছে। অনেকে সুস্থ হয়ে এরই মধ্যে বাসায় ফিরছেন।

আরএএস/এমকেআর/জিকেএস