ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ডিএসসিসি

কামরাঙ্গীরচরে বাণিজ্যিক অঞ্চলের পরিকল্পনা, উচ্ছেদ আতঙ্ক

মুসা আহমেদ | প্রকাশিত: ০১:৪৯ পিএম, ১৫ জুলাই ২০২৪

ঢাকা মহানগর এলাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) কামরাঙ্গীরচরকে ধরা হয়েছে মিশ্র এলাকা হিসেবে। আবাসিক ভবনের পাশাপাশি এ এলাকায় রয়েছে শত শত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। তবে মিশ্র এ এলাকাকে ‘বিশ্বমানের’ বাণিজ্যিক অঞ্চল-সিবিডি হিসেবে গড়ে তুলতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে তৈরি করা হবে বিজনেস হাব, যা বাস্তবায়ন হলে কামরাঙ্গীরচর হবে নান্দনিক ও আধুনিক স্থাপত্যের উদাহরণ, এমনটাই দাবি ডিএসসিসির।

তবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে কামরাঙ্গীরচরের লাখো বাসিন্দা উচ্ছেদের শঙ্কায় রয়েছেন। ফলে পরিকল্পনা বাতিলে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। বাসিন্দাদের ভাষ্য, ঢাকা মহানগরের জন্য নেওয়া ড্যাপে কামরাঙ্গীরচর একটি মিশ্র এলাকা (আবাসিক)। এখন সেখানে একটি ৫০ তলা ভবন, পাঁচতারকা হোটেল, কনভেনশন হলসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে চায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে অন্তত পাঁচ লাখ বাসিন্দা উচ্ছেদ হবে।

২০২২ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেল ও কালুনগর খালের দুপাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ডিএসসিসি। তখন আদি চ্যানেল ও খালের দুপাড়ের সীমানা থেকে ১০ ফুট করে ২০ ফুট জায়গার মধ্যে যেসব স্থাপনা ছিল সব ভেঙে দিয়েছে দক্ষিণ সিটি। এতে অসংখ্য বৈধ জায়গার মালিকও উচ্ছেদের শিকার হন।

যদিও ভিন্ন কথা বলছেন ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কামরাঙ্গীরচরে বসবাসরত কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি। এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হতে তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের অনুরোধ করেছেন। মেয়রের এমন অনুরোধের পর কামরাঙ্গীরচরে অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় এক হাজার ৩০০ একর জমি নিয়ে কামরাঙ্গীরচর এলাকা গঠিত। ডিএসসিসি যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রায় ৪০০ একর জমি। এজন্য তারা সিএস ম্যাপ অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচরে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের পরিকল্পনা করছে। অথচ জমির মালিকানা হাত বদল হয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে হাজারো বহুতল ভবন। এ অবস্থায় দক্ষিণ সিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সাধারণ ভূমি মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ফলে ডিএসসিসিকে এ উদ্যোগ থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

কামরাঙ্গীরচরে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চলের নকশাকামরাঙ্গীরচরে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চলের নকশা

এসব বিষয়ে কথা হয় ডিএসসিসির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে। জাগো নিউজকে তারা জানান, কামরাঙ্গীরচরে বাণিজ্যিক অঞ্চল সিবিডি তৈরি করতে ডিএসসিসির মাত্র ৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। বাকি জায়গা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে জমি নেওয়া হবে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে সেখানে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনড় ডিএসসিসি মেয়র।

তবে গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে কামরাঙ্গীরচরে ডিএসসিসির অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ডিএসসিসি কামরাঙ্গীরচর নিয়ে বিরাট তুঘলকি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।’

‘কামরাঙ্গীরচরে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বাস। এখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হলে এত মানুষ কোথায় যাবে? তাই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। ডিএসসিসির এ উদ্যোগ বন্ধ করতে আমরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি।’- হাজি সোলায়মান মাদবর, সভাপতি, কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগ

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান পরামর্শ দেন সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছেরের সঙ্গে কথা বলার। পরে গত ৯ জুলাই আবু নাছের জাগো নিউজকে বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচর নিয়ে আগামী সপ্তাহে মিটিং আছে। তারপর সে বিষয়ে আমরা গণমাধ্যমকে জানাবো।’

কামরাঙ্গীরচরে অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে ধোঁয়াশা

গত বছরের ১১ অক্টোবর কামরাঙ্গীরচরের লোহার ব্রিজ থেকে নিজামবাগ বেড়িবাঁধ পর্যন্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট কামরুল সরণির নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ডিএসসিসি। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া এলাকা কামরাঙ্গীরচরে পাঁচতারকা হোটেল বানানো হবে। পরিকল্পিত আবাসন, কনভেনশন হল, ৫০ তলার নান্দনিক ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে করা হবে চার লেনের সড়ক। এভাবেই কামরাঙ্গীরচরকে একটি আধুনিক নগরীতে পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’

মূলত মেয়রের এমন বক্তব্যের পর থেকেই স্থানীয়দের মনে উচ্ছেদ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, ২০২২ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেল ও কালুনগর খালের দুপাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ডিএসসিসি। তখন আদি চ্যানেল ও খালের দুপাড়ের সীমানা থেকে ১০ ফুট করে ২০ ফুট জায়গার মধ্যে যেসব স্থাপনা ছিল সব ভেঙে দিয়েছে দক্ষিণ সিটি। এতে অসংখ্য বৈধ জায়গার মালিকও উচ্ছেদের শিকার হন। এবার সিএস ম্যাপ অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচরে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করছে ডিএসসিসি। ফলে আগের মতোই উচ্ছেদ আতঙ্কে গত বছরের অক্টোবর থেকেই মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করছেন স্থানীয়রা।

কামরাঙ্গীরচর একটি ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। এখন সেখানে বাণিজ্যিক অঞ্চল করা হলে স্থানীয় লোকজন কোথায় যাবে? আর যে লক্ষ্যে ড্যাপ করা হয়েছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া সিটি করপোরেশন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক নয়। ফলে নাগরিক সেবা নিয়েই তাদের ব্যস্ত থাকা জরুরি। - আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স

গত ৮ মার্চ রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘ড্যাপ-কামরাঙ্গীরচর, অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন এবং জনগণের ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক হয়। কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের ব্যানারে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দারা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল’ পরিকল্পনা ড্যাপের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কামরাঙ্গীরচরে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের এখতিয়ার সিটি করপোরেশনের নেই বলেও দাবি করেন তারা।

বৈঠকে বক্তারা জানান, ডিএসসিসির পরিকল্পনা বস্তবায়ন হলে কামরাঙ্গীরচরের ২০ লাখ বাসিন্দা উচ্ছেদের মুখোমুখি হতে পারেন। কামরাঙ্গীরচর ঢাকার ড্যাপ অধিভুক্ত। ড্যাপের বাইরে গিয়ে বাণিজ্যিক হাব করা হবে বেআইনি, যা ড্যাপের লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত করবে।

ওই গোলটেবিল বৈঠকের দুই মাস পর ৫ মে নগর ভবনে ‘কামরাঙ্গীরচরকে নান্দনিক, বাসযোগ্য ও বুদ্ধিদীপ্ত (স্মার্ট) এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা করে ডিএসসিসি। সভায় ডিএসসিসি মেয়র কামরাঙ্গীরচরে বাণিজ্যিক অঞ্চল করার বিষয়টি এড়িয়ে যান। শুধু ওই এলাকার কয়েকটি রাস্তা চওড়া করা হবে বলে নিজেদের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।

কিন্তু মেয়রের এমন আশ্বাসের পরও গত ২৪ মে কামরাঙ্গীরচরে হাসপাতাল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ করে ‘কামরাঙ্গীরচর জন্মভূমি রক্ষা কমিটি’। ওই সমাবেশে অংশ নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, ডিএসসিসির তিন কাউন্সিলরসহ প্রায় ১০ হাজার মানুষ।

জানতে চাইলে কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি সোলায়মান মাদবর জাগো নিউজকে বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচরে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বাস। এখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হলে এত মানুষ কোথায় যাবে? তাই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। ডিএসসিসির এ উদ্যোগ বন্ধ করতে আমরা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি বিষয়টা দেখবেন।’

জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দারা/ ছবি- সংগৃহীতজাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দারা/ ছবি- সংগৃহীত

ডিএসসিসির ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুল ইসলাম মাদবর বলেন, ‘আমার জানামতে ডিএসসিসি মেয়র কামরাঙ্গীরচরে বাণিজ্যিক অঞ্চল করবেন না। এ পরিকল্পনা থেকে তিনি সরে আসছেন। তিনি এখন বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল হাতিরঝিলের মতো রূপ দিতে প্রকল্পের কাজ করবেন। এছাড়া কামরাঙ্গীরচরে বেশ কয়েকটি রাস্তা করবেন। তারপরও কামরাঙ্গীরচর নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নিতে আগামী বোর্ডসভায় বিষয়টি মেয়রের কাছে জানতে চাইবো।’

ডিএসসিসির পরিকল্পনা

সম্প্রতি ‘ঢাকার নতুন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চলের সম্ভাবনা: কামরাঙ্গীরচর’ শীর্ষক এক খসড়া পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে ডিএসসিসিতে। খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী বিজনেস হাব তৈরিতে যা যা থাকতে পারে তার মধ্যে রয়েছে- একটি সুউচ্চ কনভেনশন সেন্টার, কনডোমিনিয়াম, হাই-অ্যান্ড অফিস বিল্ডিং (বিলাসবহুল ভবন), অডিটোরিয়াম, সেমিনার ভবন, হেরিটেজ মিউজিয়াম, রুফটপ ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ, আর্ট গ্যালারি, সবুজ ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন এবং স্ট্যান্ড, ওয়াটার ট্যাক্সি জেটি, ওয়াটার গার্ডেন, পুরান ঢাকার জাদুঘর, ড্রামা থিয়েটার এবং অ্যাম্ফিথিয়েটার।

প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশগত দিক, নদী অববাহিকায় ঘেরা কামরাঙ্গীরচর এলাকার বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা এবং বিদ্যমান আর্থিক কেন্দ্রগুলোর খুব কাছাকাছি থাকাকে এর শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। একইভাবে খসড়া পরিকল্পনায় কামরাঙ্গীরচরকে সিবিডি নির্মাণের উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ এলাকাটি তুলনামূলক কম উন্নত এবং নানামুখী যোগাযোগ সহজ।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির এ পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয় বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ড্যাপে কামরাঙ্গীরচর একটি ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। এখন সেখানে বাণিজ্যিক অঞ্চল করা হলে স্থানীয় লোকজন কোথায় যাবে? আর যে লক্ষ্যে ড্যাপ করা হয়েছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া সিটি করপোরেশন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক নয়। ফলে নাগরিক সেবা নিয়েই তাদের ব্যস্ত থাকা জরুরি।’

এমএমএ/কেএসআর/এমএমএআর/জিকেএস