তারের জঞ্জাল আর কতকাল?
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দূষণ-দখল, লক্কড়-ঝক্কড় গণপরিবহনে এমনিতেই যেন ‘শ্রীহীন’ রাজধানী শহর ঢাকা। এর মধ্যে শহরজুড়ে তারের জঞ্জালে হচ্ছে দৃশ্যদূষণ। ঘটছে দুর্ঘটনা। চলতে-ফিরতে মাথার ওপর ঝুলে থাকা এসব তার চোখকে স্বস্তি দেয় না। বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার পরও নির্বিকার দুই সিটি করপোরেশন।
নাগরিকদের অভিযোগ, একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক নগরী গড়ার ক্ষেত্রে ঝুলন্ত তার ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। নগরীজুড়ে যখন আধুনিকতা আর উন্নয়নের ছোঁয়া সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলতে থাকা এসব তার বড়ই দৃষ্টিকটু। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব তার অপসারণে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
২০২০ সালের পর ‘বন্ধ’ অভিযান
২০২০ সালে এসব অবৈধ তার অপসারণে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু তাদের সেই উদ্যোগ সেখানেই থমকে আছে। এখন বিষয়টি নিয়ে যেন কারও কোনো মাথাব্যথাই নেই।
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি সূত্র জানায়, ডিশের অবৈধ ক্যাবল লাইন, ইন্টারনেট লাইন, টেলিফোনের লাইন অপসারণ তাদের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযানের অংশ। বিভিন্ন সময় তারা এ অভিযান চালান। এরই মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডি ও গুলশান অ্যাভিনিউর সব তার মাটির নিচে নেওয়া হয়েছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার সব তার মাটির নিচ দিয়ে নিতে চাই। এজন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে ডিএসসিসিতে আবেদন করেছি। কিন্তু তারা এখনো অনুমতি দেয়নি।- আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া
যদিও সরেজমিনে ধানমন্ডি ও গুলশান অ্যাভিনিউ ঘুরে তাদের দাবির পুরোপুরি সত্যতা মেলেনি। অনেক স্থানে ফের তারের জঞ্জাল দেখা গেছে।
ফেসবুকে সরব সাবেক মন্ত্রী
গত ৭ জুলাই সড়ক ও ফুটপাতের ওপর ঝুলে থাকা তারের জঞ্জালের একটি ছবি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে প্রকাশ করেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। পোস্টে তারের জঞ্জাল থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে কবে- এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। মোস্তাফা জব্বার লেখেন, ‘এই তারের জঞ্জাল থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে কবে? এনটিটিএনদের লাইসেন্সই দেওয়া হয়েছে যাতে তারা তারগুলোকে ভূগর্ভস্থ করে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরেও তারা কোনো কাজ করেনি।’
তারের জঞ্জাল বিষয়ে ডিএসসিসির উদ্যোগ ও বক্তব্য
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মে মাসে ডিএসসিসিতে শেখ ফজলে নূর তাপস ও ডিএনসিসিতে আতিকুল ইসলাম মেয়র হিসেবে যোগ দেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর ওই বছরের ৫ আগস্ট থেকে ধারাবাহিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে শান্তিনগর, ধানমন্ডি, সিটি কলেজ, নগর ভবনের চারপাশ, ওয়ারী, মুগদা এলাকার সব ইন্টারনেট ও ডিশ লাইনের তার অপসারণ করে ডিএসসিসি।
আরও পড়ুন
- দৃশ্যদূষণে শ্রীহীন রাজধানী
- রাজধানীতে ‘তারের জট’, বিদ্যুৎ-ব্রডব্যান্ডকে সমন্বয়ের দাবি
- প্রকল্পে ধীরগতি, ঢাকায় বিদ্যুতের তারের জঞ্জাল নিরসন কতদূর?
অভিযানের পর প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানায় দেশের ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। তখন ক্যাবল অপারেটরদের চাপের মুখে ঢাকায় ঝুলে থাকা তারের জঞ্জাল কেটে ফেলার অভিযান স্থগিত করে ডিএসসিসি। দুপক্ষের এক সমঝোতা বৈঠকের পর পাইলট প্রকল্প হিসেবে ধানমন্ডির ঝুলন্ত তার মাটির নিচে সরিয়ে নিতে রাজি হন ক্যাবল অপারেটররা। সে অনুযায়ী প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় করে পুরো ধানমন্ডি এলাকার তার মাটির নিচে নিয়ে যান আইএসপিএবিসহ অন্য কেবল অপারেটররা।
তবে সরেজমিনে ধানমন্ডি ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন সড়কে ইন্টারনেট, ক্যাবল লাইন ও টেলিফোনের তার ঝুলছে। এর মধ্যে সাত মসজিদ রোড ও মিরপুর রোডে তারের সংখ্যা বেশি। ধানমন্ডি এলাকাটি ডিএসসিসির ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন।
এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম বাবলা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের চাপে দুই বছর আগে সব তার মাটির নিচে নিয়ে গেছেন ক্যাবল অপারেটরেরা। এতে আগের চেয়ে সড়ক ও ফুটপাতে তারের জঞ্জাল কমেছে। তবে ধানমন্ডির বাইরে ওয়ার্ডের পূর্ব রায়ের বাজার, আফসার উদ্দিন রোড, শেরেবাংলা রোড, মিতালি রোড এলাকায় আগের চেয়ে বেশি তার ঝুলছে। এতে মহল্লার পরিবেশ আগের চেয়ে বেশি নোংরা হচ্ছে।’
আমার জানামতে চলতি বছরের শুরুতে আইএসপিএবির পক্ষ থেকে কোনো আবেদন জমা হয়নি। তবে সড়ক ও ফুটপাতের ওপর ঝুলতে থাকা অবৈধ তার অপসারণে ডিএসসিসি বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করেছে।- ডিএসসিসির মুখপাত্র আবু নাছের
জানতে চাইলে আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের নির্দেশে আমরা ধানমন্ডিতে শতভাগ ইন্টারনেট লাইন মাটির নিচে নিয়ে গেছি। এটা আমাদের পাইলট প্রকল্প ছিল। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে আমরা উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। এখন আমরা পুরো ঢাকা শহরে ইন্টারনেট লাইন মাটির নিচে নিয়ে যেতে প্রস্তুত।’
নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, ‘এ কাজটি করার আগে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এবার আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার সব তার মাটির নিচ দিয়ে নিতে চাই। এজন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে ডিএসসিসিতে আবেদন করেছি। কিন্তু তারা এখনো অনুমতি দেয়নি।’
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন ডিএসসিসির মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২০ সালেই আইএসপিএবিসহ অন্য ক্যাবল প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরো ঢাকা শহরে ঝুলে থাকা তার অপসারণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা যথাসময়ে করেনি। আমার জানামতে চলতি বছরের শুরুতে আইএসপিএবির পক্ষ থেকে কোনো আবেদন জমা হয়নি। তবে সড়ক ও ফুটপাতের ওপর ঝুলতে থাকা অবৈধ তার অপসারণে ডিএসসিসি বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করেছে। আগামী দিনগুলোতে করপোরেশনের এ কাজ অব্যাহত থাকবে।’
তারের জঞ্জাল বিষয়ে ডিএনসিসির উদ্যোগ ও বক্তব্য
ডিএনসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে সড়কে ঝুলে থাকা তার অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল ডিএনসিসি। কিন্তু ওই সময় ডিএসসিসির উচ্ছেদের প্রতিবাদে আইএসপিএবির প্রতিবাদ দেখে কিছুটা সময় নেয় ডিএনসিসি। তখন পরিকল্পিতভাবে ঝুলন্ত তার মাটির নিচে স্থানান্তরের লক্ষ্যে নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) ও ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করে উত্তর সিটি।
তাদের ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঝুলন্ত তার সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। সম্প্রতি বাড্ডা, গুলশান, বনানী, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে তারের জঞ্জাল দেখা যায়।
বনানীর ৮ নম্বর রোডের বাসিন্দা আক্তার হোসেন বলেন, ‘ঢাকার প্রায় সব রাস্তার পাশেই মাথার ওপর এখন ক্যাবল লাইন, ইন্টারনেট সার্ভিস, টেলিফোন লাইন আর বিদ্যুতের লাইনের তারের জঞ্জাল। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা এসব তার ছিঁড়ে বিভিন্ন সময়ে সমস্যা তৈরি হয়। এসব তার মাঝে-মধ্যে অগ্নিকাণ্ডেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সিটি করপোরেশন। আমরা আর কতকাল এগুলো দেখবো।’
ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২০ সালের আগস্টের পর থেকে গুলশান, বনানীসহ নগরের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ তার অপসারণে অভিযান পরিচালনা করেছে ডিএনসিসি। এই অভিযান অব্যাহত আছে। যখনই কোনো এলাকায় সড়কবাতি বা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে তার বেশি ঝুলতে দেখা যায়, তা কেটে ফেলা হয়।’
এমএমএ/এএসএ/এমএমএআর/এএসএম