ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

আবদুল্লাহ আল মিরাজ | প্রকাশিত: ০৭:১১ পিএম, ০৪ জুলাই ২০২৪
  • ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়
  • গত ৪৪ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি
  • ২০৩০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস
  • ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস

চলতি বছরের এপ্রিলে দেশের ইতিহাসে ৫২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা একই থাকলে ২০৩০ সালে তা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।

‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিটওয়েভস ইন বাংলাদেশ: হিস্টোরিক্যাল ট্রেন্ডস, প্রেজেন্ট চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ফিউচার প্রোজেকশন্স’ শীর্ষক এক গবেষণায় এমনটা উঠে এসেছে। গবেষণাটি করেছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)।

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

‘মানুষ ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কাজের কারণে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং তাপপ্রবাহ বাড়ছে। আর এ কারণে পৃথিবী দ্রুত শীতল সময়কাল থেকে উষ্ণতায় পতিত হচ্ছে।’- ড. শাহরিয়ার হোসেন, সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, এসডো

গবেষণায় বাংলাদেশের আগের গবেষণা বিশ্লেষণ করেছে এসডো। গবেষণার জন্য ১৯৭২ সাল থেকে তাপপ্রবাহের রেকর্ড সংগ্রহ করে তারা। সেই সময় তাপমাত্রা ছিল প্রায় ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

গবেষণায় বাংলাদেশে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা উঠে আসে। ২০০০ সালের শুরু থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার তাপমাত্রা ৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে। আগের তথ্যানুসারে, ১৯৯৪, ২০০৪, ২০১৪ ও ২০২৪ সালে দেশে চরম তাপপ্রবাহ বিরাজ করে। এ প্রবণতা অনুসারে গবেষকরা জানান, এই ধরনের তীব্র তাপপ্রবাহ প্রায় প্রতি দশকে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সেই হিসেবে ২০৩৪ সালের দিকে আরেকটি চরম তাপপ্রবাহ ঘটতে পারে। যার তাপমাত্রা বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো বেশি হতে পারে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই গড় তাপমাত্রা আরো দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াবে, আর ২০৫০ সালের মধ্যে তা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে।

এসডো জানায়, জলবায়ু বিষয়ে যদিও সঠিক ধারণা করা যায় না, এর পরিবর্তনও অনুমান করা যায় না। তবু এই অনুমান আমাদের ভবিষ্যতে তাপপ্রবাহ রোধে এবং এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রস্তুতির জন্য ধারণা দিতে পারে।

গবেষকরা বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে চারটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেন। এগুলো হলো: বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ুর পরিবর্তন, জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পকারখানা থেকে কার্বন নির্গমন বৃদ্ধি, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং এল নিনো ইভেন্টের মতো মহাসাগরীয় প্রভাব।

‘স্বাস্থ্য, কৃষি ও জীবিকা নির্বাহের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে তাপপ্রবাহ। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে উচ্চ তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’ সিদ্দীকা সুলতানা, নির্বাহী পরিচালক, এসডো

এসব কারণ দেশের তাপপ্রবাহকে আরো বাড়িয়ে তুলছে বলে জানিয়েছেন এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন। তিনি বলেন, মানুষ ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কাজের কারণে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এ কারণে পৃথিবী দ্রুত শীতল সময়কাল থেকে উষ্ণতায় পতিত হচ্ছে।

প্রতি লাখে মৃত্যু হতে পারে ৩০ জনের

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। এটিই এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত হওয়া দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর প্রায় ৫২ বছরের মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। তীব্র গরমে এই বছর ১৫ জন মৃত্যুবরণ করে বলে এসডো জানিয়েছে। ২০২৩ সালে তাপপ্রবাহের কারণে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়।

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ২০৩০ সালে তাপপ্রবাহ আরও বাড়বে এবং বয়স্কদের মধ্যে তাপজনিত কারণে ২০৮০ সালের মধ্যে প্রতি এক লাখে ৩০ জনের মৃত্যু হতে পারে।

তীব্র তাপপ্রবাহে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

এসডোর গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ তাপপ্রবাহের কারণে অনেকেই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন কিন্তু এ সমস্যা মোকাবিলার বিষয়ে তাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত। যেমন: ২০২১ সালের তাপপ্রবাহে ২১ হাজার হেক্টরের বেশি ধান নষ্ট হয়েছে।

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

এসডো রাজধানীর লালমাটিয়ার ৫০ জন হকারের ওপর কেস স্টাডি করে। এতে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ হকার ফল ও শাক-সবজি বিক্রি করেন। তাপপ্রবাহের কারণে তারা স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে রয়েছে মেজাজ খিটখিটে থাকা, মাথা ব্যথা, পানিশূন্যতা ও রোদে পোড়া। এ সমস্যাগুলো তাদের আগের স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর প্রভাব ফেলে। হাঁপানি ও ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়, যা পরে আরো সমস্যার সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন
গরমে শরীরে কোন পুষ্টি বেশি জরুরি? কোন খাবারে মিলবে?
এই গরমে ভাইরাস জ্বর হলে দ্রুত যা করবেন
গরমে শরীর ঠান্ডা রাখবে যেসব পানীয়

তাপপ্রবাহের কারণে হকারদের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ৭৭ শতাংশ হকার জানিয়েছেন, তীব্র গরমে ক্রেতার সংখ্যা কমে যায়। বেচাবিক্রি কম হয় এবং পণ্য নষ্ট হয়ে যায়।

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে পরিবেশে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বেড়ে যায়। ফলে বাড়ে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগ। এছাড়া তাপপ্রবাহের ফলে চাপ, হিট স্ট্রোক, পানিশূন্যতা, র‌্যাশ, ইনসোমনিয়ার মতো রোগ বেড়ে যায়। এছাড়া তাপপ্রভাবের কারণে সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পায়, যেমন ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, রোটা ভাইরাস ইত্যাদি।

গবেষণায় দেখা গেছে, তাপপ্রবাদাহের দুদিন পর কলেরার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। তাপপ্রবাহের ফলে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব বাড়ে, যা ডায়রিয়া রোগসৃষ্টির প্রধান কারণ। ঢাকায় তাপপ্রবাহের ফলে বাড়ে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, বিশেষ করে মশাবাহিত রোগ ও ডায়রিয়া।

তাবপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে ২০৩০-এর দশকে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ এবং ২০৫০-এর দশকে ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

‘তাপপ্রবাহ কমাতে সবুজায়ন করতে হবে। শহরাঞ্চলে সবুজায়ন অনেক কমে গেছে। গাছপালা বৃদ্ধি করতে হবে। ঢাকায় ইট-পাথরের কারণে পানির রিসাইকেলিং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।’- ড. মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, ‘স্বাস্থ্য, কৃষি ও জীবিকা নির্বাহের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে তাপপ্রবাহ। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে উচ্চ তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’

কৃষি, পরিবেশ ও আর্থসামাজিক খাতে প্রভাব

এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘তাপপ্রবাহ পরিবেশ, কৃষিখাত ও শহরাঞ্চলের ওপর প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহে এ বছর ২০ শতাংশ কৃষি উৎপাদন কমেছে। ফলে কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে তাপপ্রবাহ ফসল উৎপাদনে প্রভাব ফেলে, পানির প্রাপ্যতা কমায়। এছাড়া এতে পশুপালনও প্রভাবিত হয়। পানির অভাব সৃষ্টি করে।’

সবুজায়ন ও জলাশয় বৃদ্ধি করতে হবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাপপ্রবাহ কমাতে সবুজায়ন করতে হবে। শহরাঞ্চলে সবুজায়ন অনেক কমে গেছে। গাছপালা বৃদ্ধি করতে হবে। ঢাকায় ইট-পাথরের কারণে পানির রিসাইকেলিং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।’

ড. এনায়েত বলেন, ‘আমাদের চারদিকে অনেক জলাশয়, খাল-বিল আছে, তা বর্তমানে খারাপ অবস্থায় পতিত হয়েছে। জলাশয় তাপ শোষণ করে। তাপপ্রবাহ কমাতে জলাশয়গুলো নতুন করে জীবন দেওয়া প্রয়োজন।’

২০৩৪ সালে আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের আশঙ্কা

এ ব্যাপারে ড. শাহরিয়ার বলেন, ‘দেখা যায় গ্রামের তুলনায় শহরে তাপমাত্রা বেশি। এর কারণ শহরে গাছ-পালা, সবুজায়ন নেই। এছাড়া শহরে কাচযুক্ত ভবন তৈরি হচ্ছে। এসব কাচের কারণে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে। এসব ভবন গুল্মলতা বা এ ধরনের গাছ দিয়ে ঢেকে দিলে তাপমাত্রা শোষণ হবে। ঢাকায় গাছ লাগানোকে আবশ্যিক করতে হবে। জায়গা না থাকলেও ছোট গাছ, ছাদে গাছ লাগানো এবং সবুজায়ন বাড়াতে হবে।’

এএএম/এমএমএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন