নেশা-জুয়ার টাকার জন্য অটোচালক রবিউলকে হত্যা, রহস্য উন্মোচন
মাদক ও অনলাইন জুয়ার টাকা জোগাড় করতে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়। সহজ-সরল ও ছিনতাইয়ে বাধার সম্মুখীন হতে হবে না এমন একজনকে নির্বাচন করে আসামিরা। পরে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় অটোরিকশাচালক রবিউল ইসলামকে। এরপর মরদেহ ধানক্ষেতে ফেলে অটোরিকশা নিয়ে চলে যায় ঘাতকরা।
এ হত্যায় সরাসরি জড়িত তিনজনসহ সাত আসামিকে গ্রেফতার ও রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বুধবার (৩ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডি পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান নরসিংদী জেলা পিবিআই পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) মো. এনায়েত হোসেন মান্নান।
গ্রেফতাররা হলেন- মো. নাহিদ শেখ (২২), মো. হুমায়ুন (৪০), মো. লিটন খান (৪৫), জুবায়ের হাসান অমি (১৯), শাজিদুল ইসলাম হাসিব (১৯), রাকিবুল (২০) ও জুয়েল (২০)।
ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, গত বছরের ২৯ অক্টোবর সকালে জানা যায়, নরসিংদীর শিবপুর থানা এলাকার সাতপাইকা পাকা রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে একটি অজ্ঞাতনামা কিশোরের মরদেহ পড়ে আছে। খবর পেয়ে নরসিংদী জেলার পিবিআই ও ক্রাইমসিন টিম ছায়া-তদন্ত শুরু করে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় নিহত কিশোরের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। এ ঘটনায় নিহত রবিউল ইসলামের মা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। গুরুত্ব বিবেচনায় মামলাটির তদন্তের ভার নেয় নরসিংদীর পিবিআই। তদন্তকালে ঘটনার সম্ভাব্য কারণ, ঘটনার প্রকৃতি এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সম্ভাব্য আসামিদের শনাক্ত করার বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
নিহত রবিউল ইসলাম অটোরিকশাচালক ছিলেন। আসামিরা তাকে হত্যা করে তার ভাড়া করা অটোরিকশাটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। রবিউল কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতো না। ঘটনাস্থল থেকে ছিনতাই করা অটোরিকশাটি নিয়ে যেতে পারে অনুমান করে সম্ভাব্য ও সন্দেহজনক কিছু অটো গ্যারেজের প্রতি নজরদারি বাড়ানো হয়।
নরসিংদী জেলা পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু না থাকায় শিবপুর অঞ্চলে যাদের চোরাই অটোবাইক/গাড়ি কেনা-বেচায় দুর্নাম রয়েছে এমন সন্দেহভাজন রাকিবুলকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রাকিবুল ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অটোরিকশাটি নাহিদের মাধ্যমে বিক্রিতে সহায়তা করেছে বলেও জানায়। কিন্তু হত্যার বিষয়ে কোনো কথা স্বীকার করেনি।
তিনি বলেন, রবিউলের দেওয়া তথ্যে নাহিদ শেখকে গ্রেফতার করা হয়। নাহিদ অটোরিকশাটি বিক্রির কথা স্বীকার করে এবং যে গ্যারেজে বেচাকেনা হয়েছিল তা শনাক্ত করা হয়। এছাড়া ওই সব এলাকায় একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসামি হুমায়ুনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি অটোচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তার দেওয়া তথ্যে অটোরিকশাটি মালিক লিটন খানের গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সুপার এনায়েত বলেন, অটোরিকশাটি যাতে কেউ চিনতে না পারে এজন্য রং ও কিছু পার্টস পরিবর্তন করা হয়। গ্যারেজ মালিক লিটন খান অটোরিকশাটি ৩০ হাজার টাকায় কেনার বিষয়টি স্বীকার করেন। পরে নাহিদকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসময় যারা নাহিদের কাছে ছিনতাই হওয়া অটোরিকশাটি নিয়ে আসছিল তাদের নাম জানা যায়।
পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, হত্যার সঙ্গে জড়িতরা ঘটনার পরে গা-ঢাকা দেয়। মামলার ঘটনা তদন্তে তদন্তকারী একাধিক চৌকস টিম নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভৈরব, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান করে। অভিযানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
হত্যাকারী দুজনসহ গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়, রং ও মডেল পরিবর্তন ও সংরক্ষণে পাঁচজন আসামি নিজেদের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্যে রবিউল হত্যাকাণ্ড ও অটোরিকশা ছিনতাইয়ে প্রত্যেক্ষভাবে জড়িত অমি, নিহাল, হাসিব একই সঙ্গে চলাফেরা করতো। তারা নিয়মিত মাদকসেবন করতো ও অনলাইনে জুয়া খেলতো।
নরসিংদী জেলা পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, একপর্যায়ে আসামিরা মাদক ও জুয়ার টাকা সংগ্রহের জন্য অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। তারা সহজ সরল অটোচালক রবিউলকে চিনতো এবং তাকে হত্যা করে অটোরিকশাটি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে।
ঘটনার দিন বিকেল অনুমানিক ২টার দিকে আসামি অমি, নিহাল, হাসিব শিবপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে রবিউলকে পেয়ে তার অটোরিকশা নিয়ে বিকেল ৪টার দিকে শাজিদুল ইসলাম হাসিবের বাড়ির সামনে থাকতে বলে। আসামি অমি ও নিহাল বিকেল ৪টার আগেই আসামি হাসিরের বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়।
অটোরিকশাচালক রবিউল বিকেল ৪টার দিকে আসামি হাসিবের বাড়ির সামনে গেলে আসামিরা অটোরিকশা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে এবং আড্ডা দেয়। একপর্যায়ে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার দুলালপুর ইউনিয়নের সাতপাইকা গ্রামের ঘটনাস্থলে পৌঁছে অনুমানিক ১০ থেকে ১৫ মিনিট আড্ডা দেয় তারা।
আড্ডা শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা বলে আসামিদের দুজন পেছনে এবং একজন সামনের আসনে চালক রবিউল ইসলামের পাশে বসে। পরে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, গোপনে নিয়ে আসা চাপাতি বের করে হাসিব ও নেহাল রবিউলের হাত-পা জাপটে ধরে। এ সময় অমি চাপাতি দিয়ে বেপরোয়াভাবে গলায় আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই রবিউলের মৃত্যু হয়। পরে মরদেহ ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে থাকা ধানক্ষেতে ফেলে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
পরবর্তীতে আসামি রাকিব, নাহিদ, জুয়েল ও হুমায়ুন অটোরিকশাটির রং ও মডেল পরিবর্তনের পর বিক্রি করে। লিটন মিয়া ৩০ হাজার টাকায় গাড়িটি কিনে নেয়।
পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, গ্রেফতার অমির স্বীকারোক্তিমতে আসামি নাহিদের চাচাতো ভাই বিশালের বাড়ি থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতিটি উদ্ধার করা হয়। পলাতক আসামি নেহালকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
টিটি/এমএএইচ/এএসএম