মেয়ের পরকীয়ার জেরে খুন হন সাবেক এমপির স্ত্রী, ১৩ বছর পর রহস্য ভেদ
দীর্ঘদিন সম্পর্কের জেরে মাঝেমধ্যেই সাভারের প্রয়াত সংসদ সদস্য ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সামসুদ্দোহা খান মজলিশের বাড়িতে যাতায়াত করতেন ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়। একপর্যায়ে সামসুদ্দোহা খানের বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপির সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়ান সুবল। ঘটনা জানাজানি হলে ওই বাড়িতে তার যাতায়াত বন্ধ করে দেন সামসুদ্দোহার স্ত্রী সেলিমা খান মজলিশ।
এরপরও সুবল ও শামীমার মধ্যে গোপনে যোগাযোগ চলতে থাকে। বিষয়টি সেলিমা খান জানার পর মুখ বন্ধ করতে নিজের মাকে ছুরিকাঘাত করেন শামীমা খান। পরে সুবলের সহায়তায় সেলিমার মাথায় ইলেকট্রিক শক দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়।
১৩ বছর আগের এ খুনের ঘটনায় করা মামলায় পুনঃতদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানিয়েছে, নিহতের বড় মেয়ে শামীমা খান পপি ও গ্রেফতার সুবল কুমার রায়ের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এছাড়া সেলিমা খান হত্যার নেপথ্যে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের বিষয়টিও ছিল।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তারা হলেন- সুবল কুমার রায়, শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপি ও সামসুদ্দোহা খানের গৃহকর্মী আরতি সরকার। সাভার থানাধীন ভাগলপুর ও পাকিজা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ১৩ বছর পর সেলিমার মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই।
আরও পড়ুন
- একটি পরকীয়া ১০টি খুনের সমান অপরাধ: হাইকোর্ট
- পরকীয়ার জেরে স্বামীকে হত্যা, স্ত্রীর যাবজ্জীবন
- বিয়ের কয়েকদিন পর পরকীয়ায় আসক্ত, বাধা দেওয়ায় স্ত্রীকে খুন
মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ জুন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে নিজ বাসার দ্বিতীয় তলায় গলায় এবং পেটের নিচের অংশে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিলেন সেলিমা খান মজলিশ। পরে পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারদিন পর ১৮ জুন সেলিমা খান মারা যান।
ছবিতে বাঁ দিক থেকে সুবল, পপি ও গৃহকর্মী আরতি সরকার
এ ঘটনায় ওই বছরের ১৫ জুন নিহতের ভাই মো. শাফিউর রহমান খান ওরফে শাফি বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। পরবর্তীকালে থানা পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তভার অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়।
সিআইডির তদন্ত
২০১১ সালের ২৪ জুন থেকে ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ বছর ৩ মাস ২৪ দিন মামলাটি তদন্ত করেন সিআইডির তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবু বকর সিদ্দিক। তদন্তকালে তিনি খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মামলার আসামি হিসেবে মো. আবু সুফিয়ান ওরফে রানা নামের একজনকে গ্রেফতার করেন। এছাড়া আবুল কালাম আজাদ ও হরিপদ সরকার নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তদন্ত শেষে ঘটনার দায় থেকে গ্রেফতার তিনজনের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি।
যে কারণে মামলার পুনঃতদন্ত
সিআইডি প্রতিবেদন দাখিলের পর বাদীপক্ষ মামলাটি পিবিআইয়ের সহায়তায় পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেও ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে বাদীপক্ষ বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনে। পরে পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. সালাহ উদ্দিন ‘মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে’ মর্মে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আদালত মামলার পুনঃতদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
পিবিআইয়ের তদন্ত
পিবিআইয়ের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মামলাটির তদন্তভার দেন এসআই সালেহ ইমরানের ওপর। তিনি তদন্তভার নিয়েই মামলার কার্যক্রম শুরু করেন। ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী তদন্তভার পিবিআইয়ের এসআই ইমরান আহমেদের কাছে অর্পণ করা হয়।
যেভাবে তদন্ত শুরু করে পিবিআই
বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে নির্দেশনা আসে। পিবিআই খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করে। তদন্তকালে ভুক্তভোগী সেলিমার বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিশের পাশাপাশি অন্য দুই মেয়েকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। খোঁজ করা হয়, ওই বাসায় কারা যাতায়াত করতো। তখনই পিবিআই জানতে পারে, একজন ইলেকট্রিশিয়ান মাঝে মাঝে সামসুদ্দোহা খান মজলিশের বাসায় যাওয়া-আসা করতো। কিন্তু বহুদিন ওই বাসায় তার যাতায়াত নেই। তিনি ৩০ বছর ধরে সাভার থানা এলাকায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। একই সঙ্গে পাশেই তার বড় একটি মুদি দোকানও রয়েছে।
আরও পড়ুন
- প্রেমিকার ঘরে এসে চাচাতো ভাইকে পেয়ে খুন
- পরকীয়ার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় গলা কেটে হত্যা
- প্রেমিকার শিশুসন্তানকে ট্রেনে ফেলে অপহরণের গল্প সাজান প্রেমিক
কিন্তু তদন্তকালে জানা যায়, নিহতের রুমের ইলেকট্রনিক সুইচ বোর্ড ভাঙা এবং দুটি ইলেকট্রনিক তার বের করে রাখা হয়েছে। এরপর ইলেকট্রিশিয়ান সুবলকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন পিবিআইপ্রধান
তদন্তে পিবিআই জানতে পারে, সাবেক সংসদ সদস্য সামসুদ্দোহা খান মজলিশ ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়কে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন। এ কারণে ১৯৯৮ সাল থেকে সুবল মাঝেমধ্যে ওই বাসায় যাতায়াত করতেন এবং বাসার ইলেকট্রিকের কাজ করে দিতেন।
পিবিআইপ্রধান বলেন, সুবল কুমার রায়কে গ্রেফতারের পর আদালতের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, সেলিমা খান মজলিশের বড় মেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে ওই বাসার নিচতলায় থাকতেন। সেখানেই নিয়মিত যাতায়াতের একপর্যায়ে শামীমার স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন সুবল। ২০০১ সালে শামীমা ও সুবল পরকীয়া সম্পর্কে জড়ান। ২০০৫ সালে বিষয়টি জানাজানি হলে মারধর এবং অপমানের একপর্যায়ে সুবল ওই বাসা থেকে চলে যান। সুবলকে ওই বাসায় যেতে নিষেধ করা হয়। ২০০৮ সালে সুবল বিয়ে করেন। তবে ২০১১ সাল থেকে তিনি আবার সেই বাসায় যাতায়াত শুরু করেন।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দিন ভোরে ফজরের নামাজের সময় সেলিমা খান মজলিশ বাসার ছাদে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে দেখতে পান সুবল চুপিচুপি তার বাড়ির দিকে আসছেন। তা দেখে চিৎকার করতে করতে নিচে নামছিলেন সেলিমা। তখন চিৎকার থামাতে সুবল ও শামীমা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে যান।
এরপরই শামীমা তার মাকে জাপটে ধরেন এবং হাতের কাছে থাকা ফল কাটার একটি চাকু দিয়ে মায়ের গলার দুই পাশে তিনটি পোচ দেন। কিন্তু শামীমা দেখেন তার মা মারা যাননি। তখন সুবল ইলেকট্রিক বোর্ড ভেঙে সেখান থেকে দুটি তার বের করে সেলিমার মাথায় শক দেন এবং তার মৃত্যু নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। তারা ভেবেছিলেন, সেলিমার মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু তখনো তিনি জীবিত ছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পিবিআই বলছে, এ বিষয়টি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসেনি।
টিটি/এমকেআর/এমএস