ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দেবে কে?

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ০৮:২৭ এএম, ২৯ জুন ২০২৪

প্রাকৃতিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর মোকাবিলা করতে হয় প্রলয়ংকরী সব ঝড়-ঘূর্ণিঝড়-বন্যা। দুর্যোগে সুন্দরবন সব সময় পালন করে ত্রাতার ভূমিকা। তবে বন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রাণ হারায় অসংখ্য বন্যপ্রাণী। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তসংস্থান। দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা নিয়ে নেই কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ রিমালের প্রভাবে চারটি শূকরসহ সুন্দরবন থেকে ১৩৮টি বন্যপ্রাণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া জীবিত ১৮টি হরিণ ও একটি অজগর সাপ উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বনে অবমুক্ত করা হয়। উচ্চ জলোচ্ছ্বাসের কারণে জোয়ারে অনেক প্রাণী ভেসে যাওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বন বিভাগ বলছে, গত ১৭ বছরে সুন্দরবনে ১২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও এতসংখ্যক প্রাণীর প্রাণহানির ঘটনা আগে ঘটেনি। এর আগে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সুন্দরবনে ৪০টি হরিণ, একটি বাঘ ও একটি তিমির মরদেহ পাওয়া যায়। ২০০৯ সালে আইলার সময় তিনটি হরিণ ও একটি শূকর মারা যায়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দুর্যোগে সুন্দরবনের প্রাণী মৃত্যুর তেমন কোনো খতিয়ান নেই। ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর চারটি হরিণের মরদেহ পাওয়া যায়।

পুকুরগুলোর পাড় যদি উঁচু হতো তাহলে বন্যপ্রাণী এত ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। আমি মনে করি সরকারের গবেষণা সেল থাকা উচিত। যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে দুর্নীতি ছাড়া কাজ হলে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাণীর জন্য সহজ হবে।- বাপা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর আলম

উজান থেকে নামা ঢলে প্রায় প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়ছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম অঞ্চল। এসব অঞ্চলে কিছু বন আছে। বন্যার পানিতে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সঠিক তথ্য না থাকলেও সাপসহ বিভিন্ন সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী এবং পাখ-পাখালির অনেক ক্ষতি হয়। উদ্ভিদ বৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন দুর্যোগ বাড়ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। এছাড়াও সিলেট-চট্টগ্রামের বনাঞ্চলের বণ্যপ্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব প্রাণীর খাবারের উৎস থেকে শুরু করে বাসস্থান, প্রজনন সমস্যাসহ নানা ধরনের সংকট দেখা দিচ্ছে।

দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দেবে কে?

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষক পাভেল পার্থ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যখন দুর্যোগের প্রস্ততি নেই, তখন সেটা শুধু মানুষের জন্য, কোনো প্রাণীর জন্য নয়। দেশের গবাদি পশুর জন্যও নয়। যে সুন্দরবনের প্রাণীরা বা সুন্দরবন নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করে, তাদের জন্য আমরা কিছু করছি না।’

আরও পড়ুন

পাভেল পার্থ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়, অনাবৃষ্টি, খরা- এসব কারণে বন্যপ্রাণীর খাদ্য উৎস, তাদের বাসস্থান, বন্যপ্রাণীর প্রজননে নানা ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। এসব নিয়ে আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো গবেষণা নেই। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর মহাসেন, ফণী এবং বুলবুলের প্রভাবে সুন্দরবনে বণ্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কম হলেও সবশেষ রিমালের প্রভাব বন্যপ্রাণীর জন্য অনেক ভয়াবহ ছিল। বিশেষ করে হরিণ, শূকর, পাখি ও মৌমাছির চাক ভেসে গেছে। কতসংখ্যক পাখির ছানা, পাখির ডিম ভেসে গেছে তার হিসাব কিন্তু নেই।’

বিজ্ঞাপন

সুন্দরবনে কিছু কিছু টিলা করেছে, এটার নাম টাইগার টিলা। এটা শুধু বাঘের জন্য করা। সুন্দরবনে বাঘ কয়টা? কিন্তু অন্য প্রাণীর জন্য কই? বন্যশূকর, হরিণ, সজারু এসব প্রাণীর জন্য কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? এগুলো হিসাব করে কিন্তু প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না।- ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের পরিচালক আদনান আজাদ

তিনি বলেন, ‘শুধু সুন্দরবন নয়, সিলেট-চট্টগ্রাম অঞ্চলেও কিন্তু সবুজ বনভূমি রয়েছে। এ অঞ্চলেও রয়েছে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢলের ফলে ওই অঞ্চলে কতসংখ্যক বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে তার খোঁজ কিন্তু রাখা হয়নি। সিলেট, চট্টগ্রাম, হাওরাঞ্চলসহ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যপ্রাণীর ভিন্ন ভিন্ন সংকট তৈরি হয়েছে।’

বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন বিভাগের পদক্ষেপ

তবে বন্যপ্রাণী রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের প্রতিটিতে তিনটি করে মোট ১২টি বাঘের কিল্লা নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও সুন্দরবনের মধ্যে মিঠাপানির আধার হিসেবে ১১৫টি পুকুর আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রাণীর জন্য ছোট আকারের পুকুর ৩৫টি। আর মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য ৮০টি পুকুর আছে। তবে কয়েকটি পুকুর ঘূর্ণিঝড় রিমালের জলোচ্ছ্বাসে লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে।

দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দেবে কে?

বিজ্ঞাপন

যা বলছেন পরিবেশবিদ ও প্রাণী-জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞরা

সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের সদস্য ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর আলম বলেন, ‘সুন্দরবন সুরক্ষায় এ পর্যন্ত অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে সবশেষ রিমালের তাণ্ডবে দেখা গেছে প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে হয়নি। যে পুকুরগুলো খনন হয়েছে, সেগুলো ফরেস্ট অফিসের কাছে। যেন ফরেস্ট অফিসের সুবিধা হয়। এসব প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে।’

‘পুকুরগুলোর পাড় যদি উঁচু হতো তাহলে বন্যপ্রাণী এত ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। আমি মনে করি সরকারের গবেষণা সেল থাকা উচিত। যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে দুর্নীতি ছাড়া কাজ হলে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাণীর জন্য সহজ হবে।’

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন ঘূর্ণিঝড়গুলোর তীব্রতা বাড়ছে। বিষয়গুলো সুন্দরবনকে অনেক বেশি আক্রমণ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণী বিপদের সম্মুখীন। আমরা চেষ্টা করেছি তাদের দুর্যোগে কীভাবে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করা যায়।- খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো

এক্ষেত্রে প্রাণী রক্ষায় পরামর্শ দিয়েছেন বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের পরিচালক আদনান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সব সময় দুর্বল। ওয়াইল্ড লাইফ সেক্টর আরও দুর্বল। একটা সময় বন বিভাগের প্রধান টার্গেট ছিল গাছ বাঁচালেই বন বাঁচবে। এখন তারা বুঝতে শুরু করেছেন বন বাঁচাতে হলে বন্যপ্রাণীও বাঁচাতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

‘প্রাণী আমাদের কী পরিমাণ উপকার করে সেটা দৈনন্দিন জীবনে দৃশ্যমান নয়। মানুষের প্রয়োজনেই বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবনে কিছু কিছু টিলা করেছে, এটার নাম টাইগার টিলা। এটা শুধু বাঘের জন্য করা। সুন্দরবনে বাঘ কয়টা? কিন্তু অন্য প্রাণীর জন্য কই? বন্যশূকর, হরিণ, সজারু এসব প্রাণীর জন্য কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? এগুলো হিসাব করে কিন্তু প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না।’

দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দেবে কে?

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী শাহরিয়ার সিজার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওয়াইল্ড লাইফে কিছু কিছু প্রাণী আছে যেগুলো হারাতে বসেছে। বিভিন্ন দুর্যোগে বনাঞ্চলে এই প্রাণীগুলো চরম ক্ষতির সম্মুখীন। মেছো কুমির থেকে শুরু করে কচ্ছপ প্রজাতির বড় কাইটা, কাছিম, হলুদ পাহাড়ি কাছিম অতিবিপন্ন। এছাড়াও সাম্বার হরিণ, বানর, হিমালয়ান ডোরা কাঠবিড়ালি ও কালো ভল্লুক বিপন্ন হচ্ছে। এদের যদি ১/২টা যদি মারা যায় তাহলে তাদের পপুলেশন হ্রাস পাবে। এসব প্রাণী সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়াটা খুবই জরুরি।’

বিজ্ঞাপন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় অবশ্যই বন্যপ্রাণী অন্তর্ভুক্ত করতে হবে জানিয়ে পাভেল পার্থ বলেন, ‘বন ও বন্যপ্রাণীকে অবশ্যই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রাখতে হবে। দুর্যোগের আগেও পরে কীভাবে নিরাপত্তা দেওয়া হবে সেটার পরিকল্পনা নিতে হবে। জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, জাতীয় বাজেটে প্রাণীদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পশু-পাখি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু টিলা নয়, সুন্দরবনের মধ্যে প্রাণীদের বসবাস অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে বিচরণ অঞ্চল করা দরকার।’

‘সুন্দরবনে পর্যাপ্ত মিঠাপানির ব্যবস্থা নিয়ে জলোচ্ছ্বাস হলে লোনা পানি অতিদ্রুত বের করার ব্যবস্থা করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু সুন্দরবন নয়, প্রতিটি বনের মধ্যে মিষ্টি পানির পুকুরের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে যাতে প্রাণীরা ভালো থাকে। এছাড়াও প্রাকৃতিক বনের ভেতরে দেশীয় গাছ ছাড়া কোনো আগ্রাসী গাছ লাগানো যাবে না, যেগুলো প্রাণীর ক্ষতি করে।’

দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দেবে কে?

বন্যপ্রাণী রক্ষার বিষয়ে বন কর্মকর্তারা যা বলছেন

বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন ঘূর্ণিঝড়গুলোর তীব্রতা বাড়ছে। স্থায়ীত্বও বাড়ছে। বিষয়গুলো সুন্দরবনকে অনেক বেশি আক্রমণ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণী বিপদের সম্মুখীন। আমরা চেষ্টা করেছি তাদের দুর্যোগে কীভাবে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করা যায়।’

এবছর বন বিভাগ ১২টি মাটির কিল্লা তৈরি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রিমাল পরবর্তীসময়ে আমরা দেখেছি সেখানে অনেক বন্যপ্রাণী আশ্রয় নিয়েছে। এক্ষেত্রে জায়গাটা সীমাবদ্ধ। তবে সুন্দরবনের কোস্টাল এরিয়ায় আমাদের কিছু মাটির কিল্লা বা ঢিবি প্রয়োজন। পুকুরগুলোর পাড়ের উচ্চতা বাড়ানোর জন্য এবার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাণীদের মিঠাপানির সংকট না হয়।’

দুর্যোগে বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা দেবে কে?

বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি ন্যাচারকে ন্যাচারের মতো থাকতে দিতে হবে। তাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানালে সেটা হবে ন্যাচারকে ইন্টারফেয়ার করা। যেহেতু আমরা জলবায়ু ঝুঁকিতে, তাই আমাদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি।’

‘আমরা সুন্দরবনে কিছু কিল্লা ও পুকুর বানিয়েছি। তবে আমি মনে করি, প্রাণীদের এসব আশ্রয়ে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। এখানে যারা বন্যপ্রাণী চুরি বা পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য সুযোগ হয়ে যায়, কারণ আশ্রয়ে গিয়ে তাদের প্রাণী শিকার করতে সুবিধা হয়। যেহেতু এখন ঝুঁকি বাড়ছে তাই আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’ যোগ করেন তিনি।

আরএএস/এএসএ/এএসএম

বিজ্ঞাপন