সাপখেকো প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে বেড়েছে রাসেলস ভাইপার
প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বিষধর চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া সাপ। গত কয়েক বছর বিশেষ করে চলতি বছর তা আতঙ্ক ছড়িয়েছে এর ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার নামে। এক সময় দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে এর দেখা মিললেও এখন পর্যন্ত এটি ছড়িয়েছে ৩২ জেলায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপখেকো প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে দেশে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারের বিচরণ বেড়েছে। বিচরণ বাড়ায় এই সাপের দংশনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়ছে। তবে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে অ্যান্টিভেনম (সাপে দংশনের রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য ব্যবহৃত) ইনজেকশন দেওয়ার পর সুস্থ হচ্ছেন বেশির ভাগ রোগী। ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা ও ঝাড়ফুঁক করে সময়ক্ষেপণ করায় এবং সময় মতো অ্যান্টিভেনম না দেওয়ায় মারা যাচ্ছেন কেউ কেউ।
এদিকে দেশের ৬৪ জেলায়ই রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক ছড়িয়েছে। রাসেলস ভাইপার নিয়ে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন পাতা। সাধারণ নির্বিষ সাপ মেরেও বলা হচ্ছে রাসেলস ভাইপার। গত ২১ ও ২২ জুন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় রাসেলস ভাইপার মনে করে দুটি অজগর পিটিয়ে মেরে ফেলে স্থানীয়রা ।
গত ২২ জুন সন্ধ্যার দিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া ইউনিয়নের লালচামার এলাকায় রাসেলস ভাইপার সাপ মনে করে একটি অজগর সাপের বাচ্চা পিটিয়ে মারে এলাকাবাসী। ২৩ জুন রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে রাসেলস ভাইপার সন্দেহে মারা হয় দুটি সাপ।
এছাড়া ফেসবুকে ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় ভাইরাল হওয়া কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, নির্বিষ সাপ মেরে রাসেলস ভাইপার বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। রাসেলস ভাইপারসহ অন্যান্য বিষধর ও নির্বিষ সাপ মেরে ফেলায় বাস্তুসংস্থানে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
- আরও পড়ুন
- রাসেলস ভাইপারের দংশনে মৃত্যুর চেয়ে সুস্থতার হার বেশি
- রাসেলস ভাইপার: সব হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ
- কথা রাখলো আ’লীগ, রাসেলস ভাইপার ধরে পুরস্কার পাচ্ছেন সেই তিনজন
সাপ দেখলেই আতঙ্কে ফোন
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক জাগো নিউজকে বলেন, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রাসেলস ভাইপার সাপ আতঙ্কে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পাঁচটি হটলাইনের প্রতিটিতে ঘণ্টায় গড়ে ৫০টি করে কল আসছে। কোথাও কোনো সাপ দেখলেই আতঙ্কে কল করছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে আবার সাপ মেরে কল করে পুরস্কারের টাকাও চাচ্ছেন এই দপ্তরের কাছে। ফোনে জনগণের দেওয়া তথ্য যাচাই করে দেখা যাচ্ছে হত্যার শিকার ৮০ শতাংশ সাপই নির্বিষ।
সর্প দংশন বিশেষজ্ঞ টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ সাপের দংশন ও এর চিকিৎসা নিয়ে বই লিখেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, গোখরা সাপের কামড়ের পর চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারের কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিনদিন পরে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
- আরও পড়ুন
- উপকূলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রাসেলস ভাইপার
- প্রতিদিন হত্যার শিকার সাপের ৮০ শতাংশই নির্বিষ: বন বিভাগ
প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপ
বাংলাদেশে সাধারণত সাপের উপদ্রব বাড়ে বর্ষাকালে। এছাড়া বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চলের নিচু দেশ হওয়ায় বর্ষাকালে বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে আবাসস্থলে পানি ঢুকে যাওয়ায় লোকালয়ে বা উঁচু এলাকায় আশ্রয় নেয় বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ কীটপতঙ্গ। বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপ আছে এবং এই সাপের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ নির্বিষ। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিষধর সাপগুলো মূলত এলাপিডি পরিবারভুক্ত। এছাড়া কিছু ভাইপারিডি এবং সামুদ্রিক হাইড্রোফিডি পরিবারভুক্ত সাপও দেখা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অসীম মল্লিক বলেন, মানুষের মাঝে রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে নিরীহ ঘরগিন্নি সাপ। এই সাপকে অনেকে রাসেলস ভাইপারের বাচ্চা মনে করছে। গ্রামের মানুষ এই সাপ না চিনে রাসেলস ভাইপার পাওয়া গেছে বলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
- আরও পড়ুন
- রাসেলস ভাইপার থেকে কীভাবে সতর্ক থাকবেন, জানালো পরিবেশ মন্ত্রণালয়
- কথা রাখলো আ’লীগ, রাসেলস ভাইপার ধরে পুরস্কার পাচ্ছেন সেই তিনজন
মূলত বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তনে দেশে সাপের বংশবৃদ্ধি ঘটছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাণিকুলে সাপখেকো প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে পড়ায় সাপের বিস্তৃতি বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি প্যাঁচা প্রতিদিন একটি করে সাপ অথবা ইঁদুর খায়। একটি এলাকায় যদি ২০টি প্যাঁচা থাকে সেগুলো প্রতিদিন ২০টি সাপ বা ২০টি ইঁদুর খেতো। একসময় বন-জঙ্গলে বা গ্রামগঞ্জে প্রচুর প্যাঁচা দেখা যেতো। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব কমে যাওয়ায় সাপ বা ইঁদুর খাওয়া কমেছে। এতে সাপ খুব নির্বিঘ্নে বাচ্চা দিচ্ছে এবং সেসব সাপ খাদ্যে পরিণত না হয়ে আরও বংশবৃদ্ধি করছে।
সাপখেকো বেজি, গুইসাপ, প্যাঁচা, ঈগল, চিল, বাজপাখি, বনবিড়ালের মতো প্রাণীর অস্তিত্ব কমে যাওয়াকে রাসেলস ভাইপারের বিচরণস্থল বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মনে করেন অসীম মল্লিক। তিনি বলেন, দেশে আগে অনেক চরাঞ্চল ছিল। সাপ বা বন্যপ্রাণীর ভয়ে সাধারণ মানুষ সেখানে যেতো না। এসব জায়গায় সাপ, বেজি, গুঁইসাপ, প্যাঁচা, ঈগল, চিল, বাজপাখি, বনবিড়ালের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ফসলি জমির আওতা বেড়েছে। ফলে এসব প্রাণী অস্তিত্বহীনতায় পড়েছে। ফসলি জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ ও বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় প্রাণীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব প্রাণীর খাবারের তালিকায় ছিল সাপ। এসব প্রাণী না থাকায় সাপ যে বংশবৃদ্ধি করেছে তার বেশিরভাগই বেঁচে ছিল। এরপর বন্যার সময় রাসেলস ভাইপার কচুরিপানায় ভর করে বা জোয়ারের সঙ্গে বিভিন্ন প্লাবিত জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
অলস প্রকৃতির সাপ
সর্প দংশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, চন্দ্রবোড়া খুবই অলস প্রকৃতির সাপ। এরা চলাচলের জন্য কচুরিপানায় ভর করে। এরা মানুষ দেখলে তেড়ে আসে না বা পালিয়েও যায় না। এমনকি কামড় দিয়েও পালিয়ে যায় না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাপ দেখে থাকেন এবং চিকিৎসক দ্রুত সঠিক অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারেন। এ কারণেও এটি অন্য বিষধর সাপের চেয়ে কম আতঙ্কের।
- আরও পড়ুন
- নদীবেষ্টিত নোয়াখালীতে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক
- আ’লীগের পুরস্কার পেতে জীবন্ত রাসেলস ভাইপার নিয়ে হাজির কৃষক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, মানুষ নিজ হাতে মেরে সাপের বংশবৃদ্ধি রোধ করতে পারবে না। সাপের বংশবৃদ্ধি রোধে সাপখেকো চিল, প্যাঁচা, শিয়াল, বনবিড়াল, বানর, গুইসাপ, বেজি ইত্যাদিসহ আরও বেশকিছু প্রাণী রক্ষার জন্য প্রচার চালাতে হবে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই সাপের বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ হবে।
রাসেলস ভাইপার দেশে সবসময়ই ছিল
রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই ছিল এবং আছে বলে জানিয়েছেন প্রাণীবিদরা। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সাপ’ বইয়ে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ মো. আলী রেজা খান বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপ রাজশাহী বিভাগে সর্বাধিক পাওয়া যায়। তবে ২০১৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় সাপে কাটা এক রোগী মৃত সাপ নিয়েই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে আসেন। এ সাপ রাসেলস ভাইপার হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
রাসেলস ভাইপারের দেখা মিলেছে যেসব জেলায়
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার জানিয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশের ৩২টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের দেখা মিলেছে। প্রতিষ্ঠানের তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে এই সাপের বিস্তৃতি বাড়ছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। ২০১৮ সালে এই সাপ থাকা জেলার সংখ্যা বেড়ে হয় ১১টি। ২০২৩ সালে ২৩টি জেলায় এই সাপ নথিভুক্ত করেন ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকরা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ৩২টি জেলায় এই সাপের দেখা মিলেছে। তবে এই চিত্র রাতারাতি হয়ে ওঠেনি। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই চিত্রে আসতে ১১ বছর সময় লেগেছে।
যেসব জেলায় রাসেলস ভাইপারের দেখা মিলেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা।
এএএম/ইএ/এমএমএআর/জিকেএস