ঈদযাত্রায় ঢাকা বিভাগে মৃত্যু বেশি, সবচেয়ে কম সিলেটে
ঈদুল আজহার আগে-পরে ১৩ দিনে (১১ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত) সারাদেশে ২৫১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৪৩ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ৩২ ও শিশু ৪৪ জন। ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকা বিভাগে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে কম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সিলেট বিভাগে।
এই ১৩ দিনে ১২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১০৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৯.৬৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৫১.৩৯ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৪৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৮.৭০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ২৮ জন, অর্থাৎ ১০.৬৮ শতাংশ।
- আরও পড়ুন
- বরগুনায় সেতু ভেঙে মাইক্রো-অটোরিকশা খালে, নিহত ৯
- সব হারিয়ে ছোট্ট সাবরিনকে বুকে জড়িয়ে বেঁচে আছেন বাবা সোহেল
- সাইনবোর্ডে দায় সারে এলজিইডি
এসময়ে ৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ৩ জন আহত হয়েছেন। ১৬টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ৮ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সোমবার (২৪ জুন) এক বার্তায় এ তথ্য তুলে ধরেছে। ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়াও ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ১৩.৩১ শতাংশ এবং দুর্ঘটনায় ৯৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকার মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১০৪ জন (৩৯.৬৯%), বাস যাত্রী ১১ জন (৪.১৯%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ১৫ জন (৫.৭২%), প্রাইভেটকার- মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ২৪ জন (৯.১৬%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান- লেগুনা-টেম্পু) ৪৫ জন (১৭.১৭%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-ভটভটি-পাওয়ারটিলার) ৯ জন (৩.৪৩%) এবং বাইসাইকেল আরোহী ৫ জন (১.৯০%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯৭টি (৩৮.৬৪%) জাতীয় মহাসড়কে, ৯১টি (৩৬.২৫%) আঞ্চলিক সড়কে, ২৮টি (১১.১৫%) গ্রামীণ সড়কে, ৩২টি (১২.৭৪%) শহরের সড়কে এবং ৩টি (১.১৯%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন
দুর্ঘটনাগুলোর ৬৪টি (২৫.৪৯%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১০৩টি (৪১.০৩%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৪৯টি (১৯.৫২%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ২৭টি (১০.৭৫%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৮টি (৩.১৮%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৩৩টি। যার মধ্যে বাস ৭১, ট্রাক ৫২, কাভার্ডভ্যান ১০, পিকআপ ১৩, ট্রাক্টর ৮, ড্রামট্রাক ৯, ট্রলি ৩, কার্গো ট্রাক ২, ট্যাঙ্ক লরি ২, মাইক্রোবাস ১৬, প্রাইভেটকার ১৮, অ্যাম্বুলেন্স ২, জীপ ৩, মোটরসাইকেল ১৩৮, থ্রি-হুইলার ১০৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪৩ (নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-ঢালাই মেশিন গাড়ি-পাওয়ারটিলার), বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ১৯ এবং অজ্ঞাত গাড়ি ১৮টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোরে ৬.৩৭%, সকালে ২৩.১০%, দুপুরে ২৭.৪৯%, বিকালে ১৭.১৩%, সন্ধ্যায় ৫.৫৭% এবং রাতে ২০.৩১% দুর্ঘটনা ঘটেছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০.৯০%, মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২৭.২৭% এবং অন্য যানবাহন দ্বারা মোটরসাইকেলে চাপা বা ধাক্কায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩১.৮১%। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৮.৩৫ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর, ৪৭.৭৬ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর এবং ২৩.৮৮ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৬০ বছর।
দুর্ঘটনার বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান
দুর্ঘটনার বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে ২৮.৬৮ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ২৫.৫৭ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৫.১৩ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ১২.৯৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭.৯২ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ১৪.৮৮ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১১.১৫ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ১৩.৩৫ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৯.১৬ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ১৩.৭৪ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৩.১৮ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ২.৬৭ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৬.৭৭ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৯.৯২ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৭.৯৬ শতাংশ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ৬.৮৭ শতাংশ।
- আরও পড়ুন
- অতিরিক্ত গতিতে চলায় ১০ যানবাহনকে জরিমানা
- বরিশালে দু’জনকে পিষে মারলো বেপরোয়া গতির ট্রাক
- বাগেরহাটে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত, মা আহত
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৭২টি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ৮টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি ১৬ জন নিহত হয়েছে। তবে শরীয়তপুর, রাঙ্গামাটি, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম এই ৫টি জেলায় স্বল্প মাত্রার কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ১৮টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছে।
ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনা
গত বছরের ঈদুল আজহার তুলনায় এবছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ১৩.৩১ শতাংশ। ঈদযাত্রায় রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছেন এবং প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ আন্তঃজেলায় যাতায়াত করেছেন। উত্তর বঙ্গগামী সড়কের চন্দ্রা ও টাঙ্গাইলে যানজট হয়েছে। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও যানজট হয়েছে, তবে অসহনীয় মাত্রায় হয়নি।
অনেক পরিবহন মালিক যাত্রীদের থেকে বেশি ভাড়া আদায় করেছেন। বিআরটিএ এই ভাড়া নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ট্রেনে কিছুটা শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। টিকিট কালোবাজারিও হয়েছে। নৌপথে স্বস্তি থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
ঈদের ফিরতি যাত্রায় বাসে, লঞ্চে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ঈদ উদযাপনকালে যেসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেনি, শুধু আহত হয়েছে- সেসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই গণমাধ্যমে আসেনি। ফলে দুর্ঘটনায় আহতের প্রকৃত চিত্র জানা যায়নি।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ
১.ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
গত ৬ বছরের ঈদুল আজহায় সড়ক দুর্ঘটনার তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ঈদের আগে-পরে ১২ দিনে ১৪৬ টি দুর্ঘটনায় ১৯৭ জন নিহত এবং ৬২৯ জন আহত; ২০২০ সালে ১৪ দিনে ১৮৭টি দুর্ঘটনায় ২২৯ জন নিহত ও ৩১৮ জন আহত; ২০২১ সালে ১১ দিনে ১৫৮টি দুর্ঘটনায় ২০৭ জন নিহত ও ৩৮৯ জন আহত; ২০২২ সালে ১২ দিনে ২৭৪টি দুর্ঘটনায় ৩১১ জন নিহত ও ১১৯৭ জন (কমপক্ষে) আহত; ২০২৩ সালে ১৫ দিনে ৩০৩টি দুর্ঘটনায় ৩২৪ জন নিহত ও ৬৩১ জন (কমপক্ষে) আহত এবং ২০২৪ সালে ১৩ দিনে ২৫১টি দুর্ঘটনায় ২৬২ জন নিহত ও ৫৪৩ জন আহত হয়েছেন।
এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস