বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন অভিযানে ধীরগতি, সংকট অর্থ-জনবলের
দেশে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ দমনে অভিযানের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। বিপরীতে দিন দিনই প্রতিকূল হয়ে উঠছে বন্যপ্রাণীর টিকে থাকার পরিবেশ। এতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যাও কমছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, আর্থিক ও জনবল সংকটে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ও সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত ইউনিটটি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বন অধিদপ্তরের অধীন। ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে অভিযানের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। চলতি বছর অভিযানের সংখ্যা আরও কমবে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় অর্ধেকে নামার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মার্কিন অভ্যন্তরীণ ও বাণিজ্য বিভাগ এবং ইউএসএআইডির সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তুত করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত বন্যপ্রাণী পাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন ‘এলিমিনেট, নিউট্রালাইজ অ্যান্ড ডিসরাপ্ট’-এর (ইএনডি) তথ্যানুসারে, বিশ্বের যে ২৮টি দেশকে বন্যপ্রাণী পাচার পণ্য কিংবা তাদের থেকে তৈরি পণ্যের প্রধান উৎস এবং বড় ভোক্তা বলে বিবেচনা করা হয়, বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর একটি। এছাড়া বন্যপ্রাণী পাচার পণ্য বা তাদের থেকে তৈরি পণ্যের অন্যতম প্রধান ট্রানজিট পয়েন্টও বাংলাদেশ।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে বন্যপ্রাণী পাচারের সময় তা ধরা পড়তে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে এ ইউনিটটি। এর কারণ আর্থিক ও জনবল সংকট।
আরও পড়ুন
২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের অধীনে এ ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২ থেকে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইউনিটটি তিন হাজার ২৫৯টি অভিযান পরিচালনা করে ৪৬ হাজারের বেশি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছে। এ ইউনিটের অধীনে বন্যপ্রাণী ফরেনসিক ল্যাব রয়েছে। অথচ ইউনিটের লোকবল মাত্র ১২ জন। আর্থিক ও জনবল সংকটের পাশাপাশি রয়েছে উদ্ধার সরঞ্জামের অভাবও।
বিশ্বের যে ২৮টি দেশকে বন্যপ্রাণী পাচার পণ্য কিংবা তাদের থেকে তৈরি পণ্যের প্রধান উৎস এবং বড় ভোক্তা বলে বিবেচনা করা হয়, বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর একটি। এছাড়া বন্যপ্রাণী পাচার পণ্য বা তাদের থেকে তৈরি পণ্যের অন্যতম প্রধান ট্রানজিট পয়েন্টও বাংলাদেশ।- ইএনডি
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এক জরিপ অনুযায়ী, নানা সংকটে উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী মিলে গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী চিরতরে হারিয়ে গেছে। ঝুঁকির কাছাকাছি রয়েছে আরও ৯০ প্রজাতির প্রাণী।
অভিযানের সংখ্যা ক্রমেই কমার কারণ জানতে চাইলে বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অভিযানের সঙ্গে জনবলের সম্পর্ক রয়েছে, আর্থিক একটা সম্পর্কও আছে। আমরা মেইন স্ট্রিমে নেই, সরাসরি সরকার থেকে বাজেট পাই না। তাই ইচ্ছে ও প্রয়োজন থাকলেও অনেক সময় অভিযান চালানো যায় না। প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পেলে আমরা অভিযান পরিচালনা করি।’
তবে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা ব্যাপক অভিযান চালিয়েছি। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছি। ওয়ার্কশপ ও সেমিনার হয়েছে। ব্যাপক ফিল্ডস অ্যাক্টিভিটিজ হয়েছে। আমরা মনে করি, মানুষ অনেকটাই সচেতন হয়েছে। জনসচেতনতা বাড়লে বন্যপ্রাণী অপরাধও কিন্তু অনেকটাই কমে যায়।’
রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন নাটক, সিনেমা ও মোবাইল ফোন কোম্পানির বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। এটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। এখন কোনো টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা নাটক সিনেমায় বন্যপ্রাণী নিয়ে কোনো বিষয় থাকলে, তারা আগে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে। জানতে চায়, এটা দেখানো অপরাধ কি না। এখন নাটক-সিনেমায় বন্যপ্রাণী নিয়ে কোনো দৃশ্য থাকলে তারা ডিসক্লেমার দিয়ে থাকে।’
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট কীভাবে অভিযান পরিচালনা করে- জানতে চাইলে সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ইনফর্মার আছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য, এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেও আমরা তথ্য নিয়ে অভিযান পরিচালনা করি। এর পাশাপাশি র্যাব, পিবিআই, জেলা প্রশাসন ও পুলিশসহ যখন যাদের প্রয়োজন হয় তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করি। বন্যপ্রাণী আইন মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলভুক্ত। জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে।’
নানা সংকটে উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী মিলে গত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী চিরতরে হারিয়ে গেছে। ঝুঁকির কাছাকাছি রয়েছে আরও ৯০ প্রজাতির প্রাণী।- আইইউসিএন
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের ২০১২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের (২০২৪) এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ২০২২ সালে মোট ৬১০টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে আর ২০২৩ সালে অভিযানের সংখ্যা ছিল ৩১৬টি। অন্যদিকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে অভিযান পরিচালিত হয়েছে মাত্র ২৬টি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালে অভিযানের সংখ্যা একশোও পেরোবে না।
আরও পড়ুন
২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ওই বছর ৬১০টি অভিযানে তিন হাজার ২৪১টি পাখি, ২২৩টি স্তন্যপায়ী, ৯৩০টি সরীসৃপ ও ১৫০টি উভচর প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এর পরের বছর ২০২৩ সালে ৩১৬টি অভিযানে দুই হাজার ৫৯৩টি পাখি, ১৫২টি স্তন্যপায়ী, ৬৪০টি সরীসৃপ ও ৫টি উভচর প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে।
ট্রফি হিসেবে ২০২২ সালে ৮ মণ সাত কেজি শাপলা পাতা মাছ এবং ২০২৩ সালে ৫ মণ হাঙ্গর ও শাপলা পাতা মাছ এবং ১০০ কেজি ময়ূরের পালক উদ্ধার করা হয়েছে।
চলতি বছরের চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ২৬টি অভিযানে ১৫৩টি পাখি, ৪টি স্তন্যপায়ী, ৩টি সরীসৃপ ও ৪টি উভচর প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিট।
২০২২ সালে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থাকায় ১৭টি মামলা হয়েছে, গ্রেফতার অপরাধীর সংখ্যা ৩৪ জন। ২০২৩ সালে ১০টি মামলায় ১৩ জনকে ধরা হয়েছে। চলতি বছরের চার মাসে কোনো মামলা হয়নি। তবে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট অভিযান হয়েছে তিন হাজার ২৬৯টি। এসব অভিযানে ৩৪ হাজার ৬৫০টি পাখি, এক হাজার ১৩৪টি স্তন্যপায়ী, ১০ হাজার ৫২২টি সরীসৃপ এবং ৪১৯টি উভচর প্রাণী জব্দ বা উদ্ধার করা হয়েছে। এসময়ে ট্রফি উদ্ধার করা হয়েছে এক হাজার ৩৯৯টি। একই সময়ে ৪১১টি মামলায় ২৯৯ জনকে গ্রেফতার করা হয় বলেও জানিয়েছে বন অধিদপ্তর।
ট্রফি হচ্ছে তফসিলভুক্ত বন্যপ্রাণীর কোনো অংশ, যেমন- মাংস, চামড়া, হাড়, পালক ইত্যাদি। ট্রফি দুই ধরনের- সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ। প্রক্রিয়াবিহীন কোনো মাংস বা প্রাণীর কোনো অংশ হলে সেটি অসম্পূর্ণ ট্রফি। আর প্রক্রিয়াজাত করা কোনো অংশ হলে সেটিকে বলা হয় সম্পূর্ণ ট্রফি।
২০১২ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট অভিযান তিন হাজার ২৬৯টি। এসব অভিযানে ৩৪ হাজার ৬৫০টি পাখি, এক হাজার ১৩৪টি স্তন্যপায়ী, ১০ হাজার ৫২২টি সরীসৃপ এবং ৪১৯টি উভচর প্রাণী জব্দ বা উদ্ধার করা হয়েছে। এসময়ে ট্রফি উদ্ধার করা হয়েছে ১৩৯৯টি।- বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট
হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে ১৪১, ২০১৩ সালে ১৩৭, ২০১৪ সালে ২৪০, ২০১৫ সালে ২৫৯, ২০১৬ সালে ১৮৫, ২০১৭ সালে ১১২, ২০১৮ সালে ২৪৭, ২০১৯ সালের ১২৯, ২০২০ সালে ৪৬০ এবং ২০২১ সালে ৪০৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
আরও পড়ুন
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ২০১২ সালে ৪৬টি মামলায় ৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৪৬টি মামলায় ২৮ জন, ২০১৪ সালের ৪৭টি মামলায় ৩০ জন, ২০১৫ সালে ৫০টি মামলায় ২৮ জন, ২০১৬ সালে ৬৩টি মামলায় ৩৪ জন, ২০১৭ সালে চারটি মামলায় ৫ জন, ২০১৮ সালে ২৯টি মামলায় ১৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৭টি মামলায় ২৫ জন, ২০২০ সালে ২৮টি মামলায় ২৬ জন এবং ২০২১ সালে ২৫টি মামলায় ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য
ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ একটি জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ দেশ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে এক হাজার ১৬৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি উভচর, ১৬৭টি সরীসৃপ, ৫৬৬টি পাখি ও ১৩৮টি স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৫৩ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ রয়েছে। অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে ১৪১টি ক্রাইস্টাসিয়ান ও ৩০৫টি প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাছাড়া মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীসহ মোট ১ হাজার ৬১৯টি প্রজাতি রয়েছে।
বাংলাদেশের বন, অভ্যন্তরীণ জলাভূমি এবং বঙ্গোপসাগরে রয়েছে বিপুল জীববৈচিত্র্যের সমাহার। রয়েছে কতিপয় বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব। উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে ৪৭০ প্রজাতির ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া, এক হাজার ৯৮৮ প্রজাতির শৈবাল, ২৭৫ প্রজাতির ছত্রাক, ২৪৮ মস জাতীয় উদ্ভিদ, ১৯৫ প্রজাতির ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ, ৭ প্রজাতির নগ্নবীজী এবং ৩ হাজার ৬১১ প্রজাতির গুপ্তবীজী (২ হাজার ৬৩৩ প্রজাতির দ্বি-বীজপত্রী এবং ৯৮৮ প্রজাতির একবীজপত্রী) উদ্ভিদ রয়েছে বলে জানিয়েছে বন অধিদপ্তর।
আরএমএম/এমকেআর/এমএস