ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ঘর পেয়ে আপ্লুত উপকারভোগী

‘তোমাক জড়ায় ধরে আমি কান্দিত চাই মা’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৩:০৫ পিএম, ১১ জুন ২০২৪

‘আমার মা-বাপ নাই। আমি খুব দুঃখের মানুষ। অনেক কষ্ট করে জীবন কাটি লাগিছে। বয়স হইছে কাজ কাম করি পারি না। কি করি চলবো মা। আমি অনেক কষ্ট থেকে মানুষ। আমার কপালে দুঃখ। তোমার দেয়া ঘরে অনেক শান্তিতে আছি। তোমাক জড়ায় ধরে আমি কান্দিত চাই মা।’

মঙ্গলবার (১১ জুন) জমিসহ সেমিপাকা ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এসব কথা বলেন উপকারভোগীদের স্বামীহারা মোসা. সাহেরুন।

এদিন সারাদেশে ১৮ হাজার ৫৬৬ গৃহ ও ভূমিহীন পরিবারকে জমিসহ সেমিপাকা ঘর দেন। অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা, কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলা এবং ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সুবিধাভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় জীবনের সুখ-দুঃখের কথা জানান উপকারভোগীরা। অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন তারা।

ভোলা চর ফ্যাশন এলাকার চর কচ্ছপিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগী বিবি আয়েশা জানান, ২৪ বছর আগে তার স্বামী লিভার কানসারে মারা যান। সেই থেকে তার কষ্টের জীবন শুরু।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার একটি ভাঙা ঘর ছিল। আমার কিছু ছিল না যে একটা টিন আইনা সেই ঘর ঠিক করবো। আপনি ঘর দিছেন, বিদ্যুৎ দিছেন, পুকুর, টিউবওয়েল দিছেন। আমি ভাবি নাই এমন একটা ঘর পাবো। আপনারে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো প্রধানমন্ত্রী। আমার ভাষা জানা নেই।’

একই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাওয়া জাহাঙ্গীর মাঝি জানান তার কষ্টের গল্প। তিনি বলেন, ‘নিজের বলতে কিছু ছিল না আমার। কোনো রকমে একটি মাথা গোজার ঠাঁই ছিল আমার। কিন্তু ঝড়ে তা ভেঙে যায়। পলিথিন দিয়ে কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়েছিলাম। এখন এই ঘর আমার জন্য আশির্বাদ। নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া চাই, যেন দেশের জন্য ভালো কাজ করতে পারেন। আপনি আমাদের মা, দেশের মা। আপনার জন্য দোয়া চাই।’

কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ভাদী তলা পুর্ব দরগাহপাড়া আশ্রয়ণ গ্রামে ঘর পেয়েছেন হোসনে আরা। প্রতিবন্ধি হওয়ায় একসময়ে স্বামী তাকে ফেলে চলে যান। সেই থেকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু কোনো সহযাগিতা পাননি। অবশেষে আশ্রয়নের ঘর পেয়ে কষ্টের দিনের শেষ হছে তার।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হোসনে আরা বলেন, ‘আপনি প্রতিবন্ধী কার্ড দিয়েছেন। সংসার নামক জীবন খুব কষ্টের ছিলো। আপনার কাছ থেকে ঘর পেয়েছি। আপনার কাছে আমি ঋনী। আপনি হচ্ছেন যোগ্য নেতার যোগ্য কন্যা। আপনার হাতে দেশ থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন

এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকোরভোগী রবিউল আলম পেশায় জেলে। সারাদিন সাগরে মাছ ধরতেন। ঘর বলতে কোনো রকেম মাথা গোজার ঠাই। তাও পরের জমিতে। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়-বৃষ্টিতে টেনশনে থাকতেন স্ত্রী-সন্তানদের জন্য।

সেই কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো ঘর ছিলে না। চিন্তা হতো ঝড়-বৃষ্টিতে আমার পরিবার কি করবে? যখন মাছ ধরতাম তখন স্বপ্ন দেখতাম একটা বাড়ি করবো্, কিন্তু জমি ছিলো না। সেটিই আর করতে পারি নাই। আপনার উপহারে একটি ঘর পেয়েছি। জমি পেয়েছি। এখন আমার ছেলে মেয়ে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে পারে। তারা খুব খুশি। আমার স্ত্রী হাসমুরগী লালন-পালন করে। এখন যখন সাড়র পাড়ে যাই, আমার টেনশন হয় না।’

লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেরার মহিষামুড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘর পাওয়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা বাবু মিয়ার কষ্ট আরো নিদারুণ। মা-ছেলে একসাথে কাজ করতেন। কিন্তু দিন শেষে থাকার জায়গা ছিলো না। যে খাবার হোটেলে কাজ করতেন কখনো সেখানেই ঘুমাতেন, কখনো ব্রীজের পাশে ঘুমিয়েছেন। বিয়ের পরে মা, স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে মানুষের বাড়িতে থেকেছেন।

সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন ঘর ছিল না আমরা অনেক কষ্টে ছিলাম। মাথার ওপর ছাদ ছিল না। কতো কান্না করেছি। আমার মেয়ে বলতো, বাবা আমাদের কি ঘর হবে না। আমি বলতাম হবে মা, আল্লাহর কাছে দোয়া করো। আমার তো টিন কেনারও যোগ্যতা নাই। আজকে অনেক খুশি আছি।’

বাবু মিয়া বলেন, যখন মানুষের বাড়িতে ছিলাম, ওরা শাকসবজি চাষ করতো আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম। ভাবতাম আমার বাড়ি থাকলে তো আমিও চাষ করতে পারতাম। এখন আমি শাকসবজি চাষ করি। হাসমুরগী লালন করি। নিজের জমিতে গাছ লাগাই। কখনো চিন্তা করি নাই পাকা বাড়িতে থাকতে পারবো। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে খুশি হয়ে গান শোনান।

উপকারভোগীদের আরেকজন স্বামীহারা মোসা. সাহেরুন। ছেলের বউ মারা গেছেন। ছেলেও পাগল। ছেলে দুই সন্তানকে তাকেই দেখভালো করতে হয়। কোনো উপার্জন নেই। কষ্টের জীবনে নিজের থাকার জন্য কোনো ঘরও ছ না। এখন প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে জমিসহ ঘর পেয়েছেন।

ঘর পেয়ে নিজের খুশি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘তোমাক জড়ায় ধরে আমি কান্দিত চাই মা। আমার মা বাপ নাই। আমি খুব দুঃখের মানুষ। অনেক কষ্ট করে জীবন কাটি লাগিছে। বয়স হইছে কাজ কাম করি পারি না। কি করি চলবো মা। আমি অনেক কষ্ট থেকে মানুষ। আমার কপালে দু:খ। তোমার দেয়া ঘরে অনেক শান্তিতে আছি। ভাতা পাই।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পঞ্চম পর্বের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ হাজার ৫৬৬টি গৃহ ও ভূমিহীন পরিবারকে বাড়ি হস্তান্তরের পাশাপাশি ২৬ জেলার সব উপজেলাসহ আরও ৭০টি উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মানুষ মুক্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার লালমনিরহাটে ১ হাজার ২৮২টি, কক্সবাজারে ২৬১টি এবং ভোলা জেলায় ১ হাজার ২৩৪টি বাড়ি হস্তান্তর করেন। নতুন ভূমি ও গৃহহীন মুক্ত জেলা ও উপজেলা নিয়ে সারাদেশে জেলার মোট সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৮টি এবং উপজেলা হলো ৪৬৪টি।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৬৩ হাজার ৯৯৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ৫৩ হাজার ৩৩০টি, তৃতীয় ধাপে ৫৯ হাজার ১৩৩টি এবং চতুর্থ ধাপে ৩৯ হাজার ৩৬৫টি বাড়ি বিতরণ করেন।

প্রকল্পের আওতায় ভূমি ও গৃহহীন প্রতিটি পরিবারকে দুই দশমিক ৫ শতাংশ জমির মালিকানা দিয়ে একটি আধা-পাকা বাড়ি দেওয়া হচ্ছে, যা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই হবে। প্রতিটি বাড়িতে দুটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর, একটি টয়লেট এবং বারান্দা রয়েছে।

সারাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৮২ হাজার ৫৩ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আশ্রয়ণের পাশাপাশি অন্যান্য প্রকল্প মিলে ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৪ ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের প্রায় ৪৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

এসইউজে/এসএনআর/জিকেএস