ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘এভারেস্ট জয়ের আগমুহূর্তে পড়ে থাকা মরদেহ ভয় ধরিয়েছিল’

আবু আজাদ | প্রকাশিত: ১০:৪৩ এএম, ০৪ জুন ২০২৪

‘এভারেস্টের চূড়ায় এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ছিলাম। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছি জীবনটা আসলেই সুন্দর। পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান ছুঁয়ে নামার সময় যখন হিমালয় ব্যালকনির ওপরে উন্মুক্ত গিরিশিরায় পৌঁছালাম, তখন শুরু হয় ঝড়। প্রতিক্ষণে বাড়ছিল ঝড়ের তীব্রতা। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি পাহাড়ের গা থেকে আমাদের উপড়ে ফেলবে হিমালয়ের বাতাস।

দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা অসহায়ের মতো প্রকৃতি রুদ্ররোষের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে বসেছিলাম। এছাড়া উপায় ছিল না। মনের কোণে জমতে থাকে শঙ্কা। অক্ষত ফিরতে পারবো তো? এ যেন মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখা।’

jagonews24লোৎসের চূড়ায় বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে কয়েকশ তরুণকে সামনে নিয়ে এভাবেই এভারেস্টের চূড়ায় জীবনের সুখস্মৃতি ও কঠিন মুহূর্তটুকু স্মরণ করেন সদ্য এভারেস্ট ও লোৎসেজয়ী বাবর আলী। রোববার (২ জুন) সন্ধ্যায় তার সংগঠন ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’ এভারেস্ট ও লোৎসে জয়ের গল্পের আসর বসিয়েছিল সেখানে। এসময় জাগো নিউজের সঙ্গেও একান্তে কথা বলেন বাবর।

বাবর জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান থেকে পৃথিবীকে দেখার অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। এক ঘণ্টা ১০ মিনিটে আমি চারপাশ বারবার ঘুরে ঘুরে দেখেছি। চূড়ায় ওঠার পর নেপালের অংশে গ্রামের দৃশ্যগুলো দেখা যায়। তবে তিব্বতের সাইটটা অসম্ভব সুন্দর। তখন আমার দেশের কথা বারবার মনে পড়েছে। পরিবারের কথা মনে পড়েছে। বারবার মনে হচ্ছিল, আরও একটু দেখি, আর হয়তো কখনো আসা হবে না।’

লোৎসে থেকে নামার পথে দেখা এভারেস্ট। ছবি/সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সলোৎসে থেকে নামার পথে দেখা এভারেস্ট। ছবি/সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

অক্সিজেন ছাড়াই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে

পর্বত আরোহীরা অক্সিজেন নিয়ে এভারেস্টে ওঠেন। সে ব্যবস্থা বাবর আলীরও ছিল। কিন্তু তিনি জানান, এভারেস্টের চূড়ায় উঠেও প্রায় পুরোটা সময় অক্সিজেন মাস্ক না পরেই ছিলেন তিনি।

বাবর বলেন, ‘নেপালের সময় ৮টা ১০ মিনিটে আমি এভারেস্টের চূড়ায় উঠি। পরে প্রায় অলমোস্ট ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট চূড়ায় ছিলাম। সেখানে আমি অক্সিজেন ছাড়াই ছিলাম। অনেকে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট অভিযানে যান। আমিও সেই চেষ্টা করে দেখেছি, এটা কতটা কঠিন। ক্যাম্প ৪-এ অক্সিজেন ছাড়াই থেকেছি। পরবর্তীসময়ে অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।’

এভারেস্ট জয়ের পথে ক্যাম্প-৩ থেকে দেখা হিমালয়। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সএভারেস্ট জয়ের পথে ক্যাম্প-৩ থেকে দেখা হিমালয়। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

মৃত্যুর দুয়ারে আড়াই ঘণ্টা

দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ যেমন বিপদসংকুল, তেমনি নামাটাও। গত ১৯ মে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন বাবর আলী। এর দুদিন পরই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি জয় করেন চতুর্থ সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে। দুই শীর্ষ ছোঁয়ার এ অভিযানের পরতে পরতে ছিল বিপদ আর মৃত্যুঝুঁকি। সেই গল্প করতে গিয়ে বাবর আলী বলেন-

আরও পড়ুন

এভারেস্ট জয়ের পথে ক্যাম্প-৩ থেকে দেখা হিমালয়। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সঅভিযাত্রীদের এমন প্রতিকূল পরিবেশেই থাকতে হয়। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান ছুঁয়ে নামতে শুরু করেছি। এক ভারতীয় ক্লাইম্বারের দড়ির সাহায্যে নিচে নামতে অসুবিধা হচ্ছিল দেখে তাকে সাহায্য করতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে শুরু হয় ঝড়। ওই গিরিশিরায় আশ্রয় নেওয়ার মতো তেমন কোনো পাথরের আড়াল ছিল না। পর্বতে তুষারঝড়ের সময় এটাকে বলা যায় সবচেয়ে নাজুক অবস্থান। বাতাসের তীব্রতা বাড়ে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে উড়ো তুষারকণা। মন বলছিল আরোহণের সময় দেখা মঙ্গোলীয় পর্বতারোহীর মতো পরিণতি হবে না তো? পাশে বসে সেই আশঙ্কাই করছিলেন শেরপা বন্ধু বীরবাহাদুর তামাংও।’দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা পর থেমেছিল সেই তুষারঝড়। এরই মধ্যে হাতের আঙুলগুলো অসাড় হতে শুরু করেছিল। আর যদি এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরি হতো, তবে আমাদের দুজনের যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। এ কারণে ক্যাম্প ৪-এ পৌঁছাতে আমাদের দেরি হয়।- বলেন বাবর আলী।

অভিযাত্রীদের এমন প্রতিকূল পরিবেশেই থাকতে হয়। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সঅভিযাত্রীদের এমন প্রতিকূল পরিবেশেই থাকতে হয়। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

এভারেস্ট জয়ের আগমুহূর্তে ভয় ধরায় পড়ে থাকা মরদেহ

বাবর আলী বলেন, ‘এভারেস্টের বরফের নিচে অনেক মরদেহ দেখেছি। প্রথমে মরদেহ দেখে ভয় লাগেনি। কিন্তু এভারেস্ট জয়ের আগমুহূর্তে মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে ভয় ধরেছিল মনে। আমি যেদিন সামিট করেছি তার চারদিন আগে দুজন মঙ্গোলিয়ান মারা গেছেন। তাদের মরদেহগুলোও সেখানে ছিল।’

এভারেস্ট অভিযানে বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সএভারেস্ট অভিযানে বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

মন বলছিল, দুদিন আগেও এই পর্বতে জীবিত ঘুরে বেড়ানো মঙ্গোলীয় পর্বতারোহীর মতো পরিণতি হবে না তো! মাত্র চারদিন আগেই এই বাতাসে নিজের শেষ তপ্ত নিশ্বাস ফেলেছেন ওরা। আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রোটেশন শেষ করে এসে ফাইনাল সামিট করার আগের সময়টা। এ সময়টা আমার কাটছিল না। কখন ওপরে যাবো। উত্তেজনায় টগবগ করছিলাম। কিন্তু আমি শক্ত ছিলাম যে আবহাওয়াকে ডাইভার্ট করে কিছু করা যাবে না।- বলেন বাবর আলী।

যে পথ মুগ্ধতা ছড়ায়

গত ১ এপ্রিল এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানের জন্য বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশে রওয়ানা হন। ১৯ মে এভারেস্ট জয় করা এবং পরে ফিরে আসার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রোমাঞ্চ ও মুগ্ধতায় পুরিপূর্ণ।

এভারেস্ট অভিযানে বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সএভারেস্ট অভিযানে বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

বাবর আলী বলেন, ‘আমি যেদিন এভারেস্ট জয় করি তার পরে রাতে ছিল বুদ্ধপূর্ণিমা। লোৎসের পথ বেয়ে ওঠার সময় পূর্ণিমার আলোয় বরফখণ্ডগুলো চকচক করছিল। চারদিকে সোনালি আভা তৈরি হয়েছিল। চূড়ায় ওঠার পর এভারেস্টের দিকেও একবার তাকাই। ১০ মিনিটের মতো লোৎসের চূড়ায় ছিলাম। ওই সময়টা জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হিসেবে থেকে যাবে।’

‘এভারেস্টে চড়ার পথে প্রকৃতি আমাদের নানান শিক্ষা দেয়। আমরা স্বাভাবিকভাবে বনসাই করতে কত কাঠখড় পোড়াই। হিমালয়ে জুনিপার বৃক্ষ আপনাতেই বনসাইয়ে রূপ নেয়। মূলত অতি উচ্চতায় তাপ ধরে রাখতে গাছটি নিজের আয়তন কমিয়ে ফেলে।’

এভারেস্ট অভিযানে বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সএভারেস্ট অভিযানে বাবর আলী। ছবি/ সৌজন্যে: ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স

‘হিমালয়ে যাওয়ার পথে যে লেকগুলো দেখা যায়, সেসবের সৌন্দর্য বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। গাঢ় নীল আর পান্নার মতো ওইসব লেকের পানির রং। দেখলেই মনে হবে এক চুমুক খেয়ে দেখি।– বলছিলেন বাবর আলী।

বাবর বলেন, ‘এভারেস্ট অভিযানের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো স্পন্সর। আমার প্রায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এত টাকা খরচ করে আমাদের মতো পর্বতারোহীদের পক্ষে অভিযানে যাওয়া এভারেস্ট জয়ের মতোই কষ্টকর। শুধু টাকার অভাবে আমাকে অনেক সুবিধা না নিয়েই এভারেস্টে যেতে হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার আবেদন থাকবে আগামীতে যেন এ ধরনের ব্যক্তির অভিযানে আমাদের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসেন।’

এএজেড/এএসএ/জিকেএস