ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

নীতিমালা ছাড়া সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা নামলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে

তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , মুসা আহমেদ | প্রকাশিত: ১০:০২ পিএম, ২১ মে ২০২৪

• ১৫ মে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
• ১৯ মে চালকদের অবরোধ-ভাঙচুর
• ২০ মে ব্যাটারিচালিত রিকশা ফের চলার ঘোষণা

নীতিমালা ছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচলের বৈধতা দেওয়া হলে ঢাকা শহরে এ ধরনের যান দ্বিগুণ হবে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে সড়কে বিশৃঙ্খলা কিংবা দুর্ঘটনা। তাই ব্যাটারিচালিত যান বৈধতা দেওয়ার আগে নীতিমালা করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যন্ত্রের সাহায্যে চলে এমন যানবাহনের অনুমোদন দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ব্যাটারিচালিত রিকশাকে যানবাহনের মর্যাদা দেয়নি বিআরটিএ। এসব যানের কোনো নীতিমালা ও নিবন্ধন নেই। চালকদেরও নেই কোনো আইনি সুরক্ষা। আবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিধিমালায় ব্যাটারিচালিত যানের বিষয়ে কিছু বলা নেই। তাই এখন পর্যন্ত এসব যান অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা কোন সড়কে চলবে তার নীতিমালা করে দেওয়া উচিত। মূল সড়কে যেখানে বাস ও ভারী গাড়ি চলাচল করছে সেখানে কোনোভাবেই এসব অটোরিকশা চলতে দেওয়া উচিত নয়। এতে দুর্ঘটনা ঝুঁকি বাড়বে।’

ব্যাটারিচালিত রিকশা কোন সড়কে চলবে তার নীতিমালা করে দেওয়া উচিত। মূল সড়কে যেখানে বাস ও ভারী গাড়ি চলাচল করছে সেখানে কোনোভাবেই এসব অটোরিকশা চলতে দেওয়া উচিত নয়। এতে দুর্ঘটনা ঝুঁকি বাড়বে।- অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান

‘আমাদের ঢাকা শহরে মাত্র আড়াই শতাংশ সড়ক বাস চলাচলের জন্য উপযোগী। অন্য সড়কে বাস প্রবেশ করতে পারে না। শাখা সড়ক কিংবা অলিগলি যেখানে বাস প্রবেশ করতে পারে না সেসব সড়কে অটোরিকশা চলাচল করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত যান বা রিকশার কাঠামোগত কিছু দুর্বলতা আছে। তবে এটা যে আরও ইম্প্রুভ করার সুযোগ নেই তাতো নয়। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনা রোধে এর ব্রেকিং সিস্টেম, ফ্রন্টডোর, ব্যাকডোর থেকে শুরু করে সবকিছু উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। এ গাড়িগুলোর মূল সমস্যা ব্যাটারির সঙ্গে মোটর যুক্ত থাকে। অর্থাৎ, ব্রেক চাপলেও মোটর ঘুরতে থাকে। একটা ছোট্ট প্রযুক্তি রয়েছে, যা বসিয়ে দিলে ব্রেক করলে মোটরও বন্ধ হয়ে যাবে। তার মানে এ ধরনের যানবাহন নিরাপদ করার সুযোগ আছে।’

নীতিমালা ছাড়া সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা নামলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে

গত ১৫ মে ঢাকার বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর দায়িত্বে থাকা সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকায় ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি তিনি। কমিটিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র, সরকারের আটটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ঢাকার দুই মেয়র ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা নিয়ে বক্তব্য দেন। এরপরই তা বন্ধের সিদ্ধান্ত আসে।

আরও পড়ুন

সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের এমন সিদ্ধান্তের পর গত রোববার (১৯ মে) ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। প্রতিবাদে রাজধানীর মিরপুরে দিনভর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন চালকরা। ওইদিন তারা কালশী মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্স পুড়িয়ে দেন। ভাঙচুর করেন অন্তত ১০টি যানবাহন। পুলিশও কাঁদানেগ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। পরদিন সোমবার (২০ মে) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে ব্যাটারি-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ। তারা সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।

এর মধ্যেই গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতির ঘোষণা দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অনুমতি দিয়েছেন। এজন্য আমরা নতুন নীতিমালা নিয়ে আসছি।

ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রকৃত সংখ্যা কত তার সঠিক তথ্য বিআরটিএ’র কাছে নেই। বিআরটিএ সূত্র জানায়, সারাদেশে নিজেদের কার্যালয়ের মাধ্যমে পৌনে চার লাখের মতো নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার হিসাব বের করেছে তারা। তবে পুলিশ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ধারণা, ঢাকাসহ সারাদেশে এ ধরনের যান ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় এ সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের মতো হবে।

মহাখালী-বনানী এলাকায় চার বছর ধরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান জাবেদ হোসেন। মঙ্গলবার (২১ মে) মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটে তার সঙ্গে কথা হয়। আলাপকালে বলেন, ‘প্যাডেলচালিত রিকশা চালাতে অনেক কষ্ট। তাই গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ চালক রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়েছেন। এখন এ যানে তেমন কোনো কষ্ট ছাড়াই যাত্রী পরিবহন করা যায়। এতে আগের চেয়ে আয়ও বেশি হয়। তবে দ্রুতগতির কারণে অনেক সময় হুট কর ব্রেক চাপলে ব্যাটারিচালিত রিকশা উল্টে যায়। এই একটা সমস্যা ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই।’

নীতিমালা ছাড়া সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা নামলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে

রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি খালেকুজ্জামান রিপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২৩ সালে থ্রি হুইলার যানবাহনের জন্য একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছিল সরকার। সংশোধনীর জন্য সেটি আটকে আছে। এ নীতিমালা দ্রুত সময়ের গেজেট আকারে প্রকাশ করার দাবি জানাই।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রায় পাঁচ লাখ ব্যাটারিচালিত যান আছে। এর বাইরে সারাদেশে জেলা-উপজেলা শহরে ব্যাটারিচালিত যান আছে অসংখ্য। আমরা চাই ঢাকাসহ সারাদেশের সব ব্যাটারিচালিত যানকে বৈধতা দেওয়া হোক। পাশাপাশি আমাদের রোড পারমিট ও লাইসেন্স দেওয়ারও দাবি জানাই। মহাসড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত যান চলার জন্য আলাদা লেন করে দিতে হবে।’

ব্যাটারিচালিত যান নিবন্ধনের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিআরটিএ।- বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী

সিটি করপোরেশনের হিসাবে ঢাকা শহরে ১০ লাখ রিকশা এবং রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের হিসাবে আরও পাঁচ লাখ ব্যাটারিচালিত যান ঢাকায় আছে। এত পরিমাণ যানের চাপ ঢাকা শহর কীভাবে নেবে জানতে চাইলে খালেকুজ্জামান রিপন বলেন, থ্রি হুইলার নীতিমালাটি বাস্তবায়ন হলে সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসবে। নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হলে দেখা যাবে সব মিলে হয়তো সাত লাখ তালিকাভুক্ত হবে। মানুষের জীবন জীবিকার জন্য এটি সরকারকে করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। এর বড় একটি অংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য ঘটে। এজন্যই যানটি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে সরে আসা ঠিক হয়নি। এখন দেখা যাবে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে এসব অবৈধ যান সড়কে নামাবেন মালিকরা।

এখন পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত কোনো যানকে মূল সড়কে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিষয়ে আমরা আগের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছি। অর্থাৎ, কোনো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মূল সড়কে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। মহল্লার ভেতরে তারা যাত্রী পরিবহন করছে। তবে আনুষ্ঠানিক বৈধতা দেওয়া হলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো।’

ঢাকায় সিটি করপোরেশন নিবন্ধিত রিকশা ৮০ হাজার, চলে ১০ লাখ
বর্তমানে রাজধানীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নিবন্ধিত প্রায় ৮০ হাজার প্যাডেলচালিত রিকশা রয়েছে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে ডিএনসিসি থেকে নিবন্ধন নিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। বাকি প্রায় ৫০ হাজার ডিএসসিসি থেকে নিবন্ধিত। তবে দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ঢাকায় আরও প্রায় সাত লাখ প্যাডেলচালিত রিকশা রয়েছে। এর বাইরে ঢাকায় আরও কয়েক লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক ঝুঁকি নিয়ে যাত্রী পরিবহন করছে।

নীতিমালা ছাড়া সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা নামলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত সিটি করপোরেশন প্যাডেলচালিত রিকশার নিবন্ধন দেয়। নির্দিষ্ট ফি বাবদ নম্বর প্লেটও দেওয়া হয়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।’

এখন ব্যাটারিচালিত যান বিআরটিএ নিবন্ধন দেবে না সিটি করপোরেশন নিবন্ধন দেবে তা স্পষ্ট নয় বলে জানান বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী। তিনি বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত যান নিবন্ধনের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। নির্দেশনা পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বিআরটিএ।’

ব্যাটারিচালিত রিকশা শ্রমিকদের বিজয় সমাবেশ
সরকার ঢাকা শহরের সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি দেওয়ার একদিন পর মঙ্গলবার (২১ মে) সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘বিজয় সমাবেশ’ করেন চালকরা। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান তারা। এছাড়া যানবাহন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো একটি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার আওতায় আনার জন্য কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।

এমএমএ/টিটি/এএসএ/এএসএম