ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

এলডিডিপি

সামান্য সহায়তায় বড় সফলতা

নাজমুল হুসাইন | প্রকাশিত: ১১:৩৫ এএম, ২০ মে ২০২৪

আফরোজার স্বামী ফরমান আলী বেসরকারি এনজিওর বড় কর্মকর্তা ছিলেন। বাতজ্বরে হাঁটতে অপারগ হওয়ায় বেশিদিন চাকরি চালিয়ে যেতে পারেননি। দুই সন্তান ঢাকার নামকরা স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তো। পুরো পরিবারের পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, ঢাকায় টিকতে হলে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতেই হবে। না হলে ফিরতে হবে গ্রামে। আফরোজা সুলতানার এ অনিশ্চয়তার গল্প ২০১২ সালের।

আফরোজা জাগো নিউজকে বলেন, সে সময় সংসার টিকিয়ে রাখতে জীবন সংগ্রামে নেমেছিলাম। প্রতিজ্ঞা ছিল, মেয়ে হলেও বাকি জীবন পরিবার সামলিয়ে নেবো। প্রথম দুই বছর নানা কাজকর্ম করে ২০১৪ সালে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের চিন্তা এলো। তখন ভাড়া বাসার থাকার ঘরেই দই-মিষ্টি বানানো শুরু করি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের আমরা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) তখন মিষ্টি কারখানার শ্রমিক। ওই সময় সারা সপ্তাহে ২০-৩০ লিটার দুধ কিনে সেটা দিয়ে দুগ্ধজাত পণ্য বানাতাম। সেটা বিক্রি করেই টেনেটুনে চলতো সংসার।

আফরোজা সুলতানার ওই উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক নাম এখন ‘ফৌজিয়া হেলদি ফুড প্রোডাক্টস’। এক দশক বাদে ছোট প্রতিষ্ঠান হলেও সুনামে তারা বেশ এগিয়ে। ইউনিমার্ট, হোলসেল ক্লাব, আগোরা, স্বপ্নসহ বেশকিছু নামকরা সুপারশপে দুগ্ধজাত পণ্য সরবরাহ করে তার প্রতিষ্ঠান। এছাড়া পণ্য দেন পিকেএসএফ, ইউএনডিপি, আইডিবি, একমি ভবনের ক্যান্টিনসহ আরও অনেক প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে।

দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, এলডিডিপির সামান্য সহায়তায় বড় সফলতা

দই-মিষ্টির সঙ্গে এখন বোরহানি, মাঠা, মোজারেলা চিজ, তফুর মতো নতুন নতুন পণ্য এনে দুগ্ধজাত খাবারে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছেন। পণ্য সবার কাছে আরও সহজে পৌঁছে দিতে অনলাইন ডেলিভারি শুরু করেছেন। এখন প্রতি মাসে বিক্রি করছেন কমবেশি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার পণ্য।

নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আফরোজা উইমেন এন্টারপ্রেনার বাংলাদেশের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তবে তার স্বপ্ন ছিল বড়, দরকার ছিল বড় একটা বিনিয়োগের। সে সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)। গত বছর এ উদ্যোক্তাকে প্রকল্প থেকে ‘ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ম্যাচিং গ্রান্টের (প্রণোদনা) আওতায় যন্ত্রপাতি সরবরাহ’ কর্মসূচিতে অর্থায়ন করা হয়েছে।

এরপর মোহাম্মদপুরের হাউজিং সোসাইটিতে আফরোজার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, এখন তার কারখানা পুরোপুরি আধুনিক। ঝকঝকে-তকতকে। কারণ এখন আগের মতো সনাতন পদ্ধতিতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো কার্যক্রম হচ্ছে না সেখানে। সবই হচ্ছে আধুনিক মেশিনে। দই তৈরি হচ্ছে ইনকিউবিউটরে। হ্যাভি ডিউটি ব্লেন্ডারে তৈরি হচ্ছে দুধের মিশ্রণ, বোরহানি, লাবাং।

মোজারেলা চিজ বা তফুর জন্য দুধ থেকে ক্রিম আলাদা হচ্ছে ক্রিম সেপারেশন মেশিনে। সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনে ব্যবহার হচ্ছে চিলিং মেশিন ও বিশাল বিশাল ফ্রিজ। আর পণ্য ডেলিভারির আগে প্যাকিংও করা হচ্ছে মেশিনে। সবচেয়ে বড় বিষয় ছোট এ প্রতিষ্ঠানেও আরেকটি ছোটখাট ল্যাব হচ্ছে। এলডিডিপির সরকারি অর্থায়নে কেনা হয়েছে ল্যাবের যন্ত্রও।

আফরোজা জাগো নিউজকে বলেন, ম্যাচিং গ্রান্টের আওতায় সরকার আমার পুরো বিনিয়োগের অর্ধেক টাকা দিয়েছে। এতে ব্যবসায় নতুন উদ্যম পেয়েছি। ছোট কারখানা থেকে এখন বড় কারখানা নিয়েছি। ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ সহায়তা পাওয়া কঠিন। তবে এ প্রকল্প থেকে আমি সহজে পেয়েছি। এটি সরকারের একটি ভিন্ন ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

ভিন্ন ধরনের আরেক গল্প কুমিল্লার লাঙ্গলকোর্টের সাইফুল ইসলামের। আফরোজার মতো জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার জন্য দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী হননি তিনি। নিজের খামারের উৎপাদিত দুধের নায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য এ পথে এসেছেন। ২০২১ সালে সাইফুল ইসলাম পাটোয়ারী অ্যাগ্রো ফার্ম করেছিলেন। দুই বছর বাদে তার ফার্মের ৭০টি গাভী প্রায় প্রতিদিন ২০০ লিটার দুধ দিতো। তবে লাঙ্গলকোর্ট-চৌদ্দগ্রাম মিলে প্রতিদিন এত দুধ বিক্রি করতে দারুণ বেগ পেতে হতো তাকে। অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পেতেন না, দুধ নষ্ট হতো।

সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দুধ বিক্রি নিশ্চিত না করতে পারায় কখনো দুধ বিক্রির টাকায় খামারে লাভ হয়নি। তখন চিন্তা করেছি, নিজেই এসব দুধ প্রক্রিয়াজাত করবো। শুরুতে প্যাকেটজাত তরল দুধ ও ঘি করার জন্য কারখানার কাজ শুরু করি গত বছর। এর মধ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এলডিডিপির সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরে আবেদন করে স্বয়ংক্রিয় মিষ্টি বানানোর মেশিন, দই তৈরির ইনকিউবিউটর ও দুধ পাস্তুরিত করার মেশিনসহ প্যাকেজিং মেশিন, চিলার ট্যাংক, মিল্ক অ্যানালাইজার ও ক্রিম সেপারেটর মেশিন কেনার জন্য সহায়তা পেয়েছি।

সাইফুল বলেন, এখন স্বপ্ন অনেক বড়। ছয়মাস হলো এসব দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে ছেড়েছি। নিজে এলাকায় পাঁচটি বিক্রয়কেন্দ্র হয়েছে। প্রায় ৩০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে কারখানায়। প্রতিদিন নিজের খামারের ২০০ লিটার দুধ থেকে পণ্য তৈরি হচ্ছে, যেগুলো নিজস্ব ওইসব বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি হয়। নিজের পণ্যের শতভাগ ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে। লাভবানও হচ্ছি ভালো।

যেভাবে এসব যন্ত্রপাতি পাচ্ছেন
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৬১ জেলায় এলডিডিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। যার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশকে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। এটি প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এর একটি অংশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ম্যাচিং গ্রান্টের আওতায় যন্ত্রপাতি সরবরাহ কর্মসূচি রয়েছে। সারাদেশে এ কার্যক্রমে পর্যায়ক্রমে ৪৬৫ জন ক্ষুদ্র খামারি/উদ্যোক্তাকে প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ করে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সহায়তা করা হবে।

এসব উদ্যোক্তার মধ্যে ৩০০ জনকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের আওতায় আনা হবে, যাদের মাধ্যমে দুধ পাস্তুরিত করা এবং সুগন্ধি দুধ, ঘি, দধি ইত্যাদি তৈরি করে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা হবে। অবশিষ্ট ১৬৫ জন উদ্যোক্তা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করে মিষ্টিজাত খাদ্যপণ্য তৈরি জন্য সহায়তা পাচ্ছেন। ম্যাচিং গ্রান্ট ম্যানুয়াল অনুসরণ করে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৯২ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা যায়।

প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক শাহ্ আলম বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, এখনো এ কার্যক্রম পুরোদমে চলমান। কিছুটা সামর্থ্য রয়েছে এমন খামারি বা উদ্যোক্তারা চাইলেই এ সহায়তা পেতে পারেন। তবে সমপরিমাণ অর্থ তাদের বিনিয়োগের সক্ষমতা থাকতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের খামার থেকে শুরু করে পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত নানা ধরনের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য এ সহায়তা করা হয়।

কত টাকা পাচ্ছেন, কীভাবে পাচ্ছেন
কোনো প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হলে প্রস্তাবিত বাজেটের সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বা অনধিক সাড়ে ১২ হাজার টাকা প্রকল্প থেকে অনুদান দেওয়া হয়। বাকি ৬০ শতাংশ অর্থ আবেদনকারীকে বহন করতে হবে।

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নতমানের দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ। এ লক্ষ্যে বড় দুগ্ধ খামার ও মিষ্টি তৈরি কারখানায় ছোট আকারের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণের ইউনিট স্থাপনে ইচ্ছুক দুগ্ধ ব্যবসা পরিচালনাকারী বা পরিচালনায় আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অনুদান দেওয়া হয়। পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলা ছাড়াও দেশের ৬১টি জেলায় এমন ছোট আকারের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ ইউনিট স্থাপন বা সম্প্রসারণে এ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, এলডিডিপির সামান্য সহায়তায় বড় সফলতা

আবেদনকারীদের বেশ কিছু যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আবেদনকারীর ব্যবসা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ–সংক্রান্ত হতে হবে। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণে ন্যূনতম এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বৈধ ট্রেড লাইসেন্স ও টিআইএন সনদ দাখিল করতে হবে। আবেদনকারীকে বেসরকারি উদ্যোক্তা হতে হবে। তবে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এবং স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আবেদন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয় এ কর্মসূচিতে।

এ প্রকল্পে সহায়তা নিয়েছেন রাজশাহীর বোয়ালিয়ার নাবা মিল্ক প্রসেসিংয়ের স্বত্বাধিকারী মামুনুর রশিদ। তিনিও পাস্তুরিত দুধ ও বেশকিছু দুগ্ধজাত পণ্য বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছেন। তিনি বলেন, এ কার্যক্রমের ফলে শুধু আমি একা উপকৃত হচ্ছি না, এ এলাকার অনেক খামারির দুধ নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করছি। সবাই মিলে উপকৃত হচ্ছি।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, ছোট ছোট খামারিদের যদি যন্ত্রপাতি সহায়তা নিশ্চিত করা যায়, তবে তারা নিজেরা পণ্যের শতভাগ ভ্যালু অ্যাড করতে পারবেন। তাদের নিজের খামারে উৎপাদিত দুধের মূল্য নিশ্চিত হবে। এরপর বাড়তি পণ্য তৈরি করে আয় করতে পারবেন। এটি ভালো উদ্যোগ।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিভাগ এবং ইন্ট্রিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, খামারিদের ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট ছাড়া দুগ্ধ শিল্পে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের খামারভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা খুবই কার্যকর। এতে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধানে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।

এলডিডিপি প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশের ডেইরি সেক্টরের উন্নয়নে ক্লাস্টার নেটওয়ার্কিংয়ে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। যাতে দেশের প্রান্তিক খামারিরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য, নিজেরাই নিজেদের উন্নয়ন, খামার থেকে শুরু করে ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত যা যা করা প্রয়োজন তার সবই নিজে করতে পারে।

তিনি বলেন, খামারিদের উন্নত ও গুণগতমানের পণ্য, প্রাণিখাদ্য উৎপাদনের জন্য সহায়ক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে পণ্যে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের জন্যও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদনের জন্য সব ধরনের সহায়তা এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি।

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম