নাবিক আইনুল হক
দেশে ফিরে মনে হচ্ছে আমার নতুন জন্ম হয়েছে
- বীভৎস দিনগুলো থেকে আলোর দিনে ফিরলাম
- বাবাকে দেখেই জাতীয় পতাকা নাড়ছিল ছোট্ট উনাইজা
- আল্লাহ আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, এর চেয়ে খুশির কী আছে
- পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি, এটা সরকারের সফলতা
‘অবশেষে দেশে ফিরলাম। মনে হচ্ছে আমার নতুন জন্ম হয়েছে। জিম্মি হওয়ার শুরুর দিনে ভয়াবহ অবস্থায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল, তারা আমাদের মেরে ফেলবে কি না। শুরুর দিকে আমরা ব্রিজে অবস্থান করতাম। সোমালিয়ান জলদস্যুরা সবসময় ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতো।’ দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে মাতৃভূমিতে স্বজনদের কাছে ফিরতে পেরে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি জানাচ্ছিলেন এমভি আবদুল্লাহর নাবিক আইনুল হক।
এদিন জাহাজ থেকে নেমেই আদরের দুই কন্যাকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে অশ্রুপাত করেন এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খান। তার মেজো মেয়ে ছোট্ট উনাইজা দূর থেকে বাবাকে দেখেই জাতীয় পতাকা নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। উনাইজা জানিয়েছে, বাবা ফেরায় সে আজ অনেক খুশি।
মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেল ৪টার পর চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের জেটি চত্বরে এমনই আনন্দ আর আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকার পর মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর স্বজনদের কাছে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের বাংলাদেশি ২৩ নাবিক। এদিন বন্দরে তাদের বরণ করতে ভিড় দেখা যায় পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের।
বিকেলে বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের জেটি চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, কারও মুখে হাসি, কারও চোখে জল। দুই মাস আগেও যে কান্না ছিল কষ্টের, আজ সে কান্না ফিরে এসেছে আনন্দ অশ্রু হয়ে। আপনজনদের ফিরে পেয়ে নাবিকরা যেমন আবেগাপ্লুত হন, তাদের স্বজনরাও খুশিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এসময় নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এমন দৃশ্যে বন্দরজুড়ে নামে বাঁধভাঙা আনন্দ।
বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ২৩ নাবিককে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে ভেড়ে বহনকারী লাইটার জাহাজ এমভি জাহান মণি-৩। ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদের নেতৃত্বে নাবিকরা যখন একে একে জেটিতে নামছিলেন, তখন সবার চোখেমুখে ছিল যুদ্ধজয়ের হাসি। যেন নীল সাগরে সম্মুখ সমরে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে দেশে ফিরেছেন তারা। এ যেন যুদ্ধজয়েরই হাসি।
চট্টগ্রাম বন্দরে নেমেই জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, সোমালিয়ার দস্যুদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আমরা ২৩ নাবিক দেশে পৌঁছেছি। আমরা সবাই সুস্থ ও অক্ষতভাবে পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি। এটি আমাদের সরকারের সফলতা।
‘সরকার কৌশলগতভাবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এতে আমাদের মুক্তি সহজ হয়েছে। আমরা দস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল বিদেশি নৌ-বাহিনী যেন ভায়োলেন্স না করে। যেন আমাদের কোনো নাবিকের প্রাণ শঙ্কায় না পড়ে। যেন জাহাজের কোনো ক্ষতি না হয়’- বলছিলেন ক্যাপ্টেন রশিদ।
আরও পড়ুন
- ২৩ নাবিকের ভয়ংকর ৩৩ দিন
- দেশের মাটিতে নোঙর করলো এমভি আবদুল্লাহ
- জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি ২৩ নাবিক মুক্ত
এদিন ২৩ নাবিকের ফেরার খবরে দুপুর থেকেই বন্দরে স্বজনদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এমভি আবদুল্লাহর ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জ্যোৎস্না বেগম দুপুর থেকে এনসিটি-১ বার্থে অপেক্ষা করছিলেন কলিজার টুকরো ছেলেকে বুকে ফিরে পেতে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে দুই মাস পর ছেলে ফিরে এসেছে মায়ের বুকে। ছেলের জন্য বাড়িতে পছন্দের খাবার রান্নাও করে এসেছেন তিনি।
জ্যোৎস্না বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আল্লাহ আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুকরিয়া জানাই। ছেলে আমার বুকে ফিরে এসেছে, এর চেয়ে খুশির আর কী আছে।
‘ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ লাগছে। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। বিগত দিনগুলো দুশ্চিন্তায় কেটেছে। আল্লাহর কাছে রোজা রেখে দোয়া করেছি। আল্লাহ দোয়া কবুল করেছেন’- বলেন জ্যোৎস্না বেগম।
বন্দরে নেমেই অভ্যর্থনার জটলা ডিঙিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন তানভীর। তখন মা-ছেলে দুজনই আনন্দে বারবার চোখ মোছেন। তানভীর আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, মাকে কিংবা নিজের দেশকে আবার ফিরে পাবো, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল। এখন মুক্ত হয়ে মায়ের কাছে ফিরতে পারার আনন্দটাই আলাদা।
দুপুর থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান করছিলেন এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই আবদুর নূর খান আসিফ। তিনি বলেন, আমাদের পরিবারের সবাই এ দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। এ দিনটি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। জাহাজসহ অন্য নাবিকদের সঙ্গে আমার ভাই জিম্মি হয়েছেন শুনেই পরিবারের সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আল্লাহ আমাদের সহায় হয়েছেন।
এমভি জাহান মণি-৩ জাহাজটি যখন ধীরে ধীরে জেটিতে ভিড়ছিল তখন দূর থেকে বাবাকে দেখেই হাতে থাকা জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল আতিকুল্লাহ খানের মেজো মেয়ে ছোট্ট উনাইজা। উনাইজা জাগো নিউজকে বলে, ‘বাবা ফিরে আসায় আমি খুবই খুশি হয়েছি।’
জাহাজ থেকে নেমে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আতিকুল্লাহ খান বলেন, বন্দিদশার দিনগুলো খুবই বীভৎস ছিল। সেই বীভৎস দিন থেকে আলোর দিনে ফিরেছি। সেই দুঃসহ সময়গুলোর কথা মনে করতে চাই না। ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। দুই সন্তানকে কাছে পেলাম। বাসায় আরেক সন্তান কান্না করছে। তার কাছে ফিরতে হবে দ্রুত।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে স্টুয়ার্ড পদে কর্মরত ছিলেন নুরু উদ্দিন। তার ফেরার খবরে দুপুর থেকে কোলের সন্তানকে নিয়ে বন্দরে অপেক্ষমাণ ছিলেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে দেশে ফিরছে, এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
জিম্মি হওয়া জাহাজটির নাবিক আলী হোসেনকে বন্দরে বরণ করতে আসেন তার শ্বশুর জামাল মাহমুদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মাত্র কিছুদিন আগে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর জাহাজে গিয়েই জলদস্যুদের কবলে পড়ে আলী হোসেন। এতে সবার মতো আমার মেয়েও পাগলপ্রায়। এখন মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না।
এর আগে বিকেল সোয়া ৪টায় বন্দরে ২৩ নাবিককে লালগালিচা ও ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এসময় নাবিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করতে অনলাইনে বন্দর জেটিতে যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আর আগে থেকে বন্দরে ২৩ নাবিকের পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও চট্টগ্রামের সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল, কেএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহানসহ বন্দর কর্তৃপক্ষ, নৌবাহিনী, পুলিশ ও কেএসআরএম গ্রুপের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন
- জাহাজে যেভাবে ঈদ কাটলো জিম্মি ২৩ নাবিকের
- ফুরোলো অপেক্ষা, পরিবারের কাছে ফিরলেন নাবিকরা
- ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত বাংলাদেশি জাহাজ: রয়টার্স
এর আগে জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন চুনাপাথর নিয়ে দেশে ফেরে জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। গতকাল সোমবার দুপুরে জাহাজটি দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে এবং কুতুবদিয়ায় নোঙর করে। মঙ্গলবার সেই জাহাজের নাবিকেরা ফেরেন চট্টগ্রাম বন্দরে।
গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় এমভি আবদুল্লাহ। ১২ মার্চ বাংলাদেশি ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। দেশটির উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে জাহাজটি জিম্মি করা হয়। এরপর জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে দরকষাকষির মাধ্যমে প্রায় ৩২ দিন পর গত ১৪ এপ্রিল জাহাজটি মুক্ত করে দেয় জলদস্যুরা। এরপরই সেটি সোমালিয়া উপকূল থেকে আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। টানা এক সপ্তাহের সমুদ্রযাত্রা শেষে ২১ এপ্রিল বিকেলে জাহাজটি আল হামরিয়াহ বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়।
জাহাজে থাকা কয়লা খালাস করে পরবর্তী সময়ে গত ৩০ এপ্রিল আরব আমিরাত থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন চুনাপাথর নিয়ে দেশের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ। ১৩ মে দুপুরে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে কুতুবদিয়ায় নোঙর করে।
উদ্ধার জাহাজের নাবিক ও ক্রুরা হলেন, জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিনি ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিসিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, আসিফুর রহমান, সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, নাজমুল হক, আইনুল হক, মো. শামসুদ্দিন, আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, শরিফুল ইসলাম, নুর উদ্দিন ও সালেহ আহমদ।
এমডিআইএইচ/এমকেআর/এমএস