সড়কে বিটুমিন গলা নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা
গত কয়েক দশকের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দেশে। যশোরে গত ৩০ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেটিই এখন পর্যন্ত দেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
টানা তীব্র তাপপ্রবাহ সইতে পারেনি দেশের সড়কগুলোও। অতিরিক্ত গরমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়কের বিটুমিন গলে যায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে সড়ক নির্মাণে ব্যবহার করা বিটুমিনের মান নিয়ে। বলা হচ্ছে, সড়ক নির্মাণের সময় নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে কি না সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রার সঙ্গে বাংলাদেশের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশের সড়ক তৈরিতে নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে। সামনে আবার তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দিলে সড়কের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে সড়ক তৈরিতে বর্তমানে যে ধরনের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি তীব্র গরম সহ্য করার উপযোগী নয়। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও নিম্নমানের নির্মাণকাজই গরমে সড়কের এমন ক্ষতির কারণ। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সড়ক তৈরিতে প্রচলিত বিটুমিনের পরিবর্তে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন (পিএমবি) ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় নতুন সড়ক তৈরির ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে বিটুমিনের বিকল্প হিসেবে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের দিকে।
প্রশ্ন উঠছে সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত বিটুমিনের মান নিয়ে
বিটুমিন গলে যাওয়ার খবরে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি, গিয়ে দেখি গলেনি। এরকম বড় কোনো ইস্যু নেই। খুবই অল্প দু-একটা জায়গায় হয়েছে। তবে এটি নিম্নমানের কাজের কারণে হয়েছে কি না তা দেখা হবে।- প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান
দেশে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতায় ২২ হাজার ৪৪৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার জেলা সড়ক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫ ও ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় জেলা শহরের বিভিন্ন সড়কে রাস্তার পিচ গলে যায়। ওই দুদিন সেসব এলাকায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এরপর ২৫ এপ্রিল শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের ১৫টি স্থানে বিটুমিন গলে যায়। যানবাহনের চালকরা জানান, তখন ওই সড়ক দিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে টায়ারের সঙ্গে বিটুমিন লেগে যাচ্ছিল। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-কালীগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়ক, যশোর-নড়াইল মহাসড়ক ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বিটুমিন গলে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
নিম্নমানের কাজের কারণে সড়কে বিটুমিন গলছে, বলছে দুদক
সওজ সূত্র জানায়, দেশের সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এই মানের পিচ গলে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) উৎপাদিত পিচের গলনাঙ্ক ৫২ থেকে ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পলিমার মডিফাইড বিটুমিনের (পিএমবি) গলনাঙ্ক ৮০ ডিগ্রির বেশি।
আমাদের ঠিকাদারদের একটি খারাপ কালচার আছে, সড়ক তৈরির সময় বেশি বিটুমিন ব্যবহারের চেষ্টা করা। বেশিও দেওয়া যাবে না কমও দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট পরিমাণে বিটুমিন দিতে হবে। ঠিকাদাররা ফাঁকফোঁকর খুঁজবেই।-অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার করার ফলে চলমান তাপপ্রবাহেও এসব সড়কে বিটুমিন গলছে না। তবে কোথাও কোথাও বিটুমিন কিছুটা গলার খবর পাওয়া গিয়েছে। এসব স্থানের বিটুমিন গলার কারণ অনুসন্ধান করছে সওজ।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, দেশের অল্প কয়েকটি জায়গায় এরকম হয়েছে। এমনও হয়েছে বিটুমিন গলে যাওয়ার খবরে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি, গিয়ে দেখি গলেনি। এরকম বড় কোনো ইস্যু নেই। খুবই অল্প দু-একটা জায়গায় হয়েছে। তবে এটি নিম্নমানের কাজের কারণে হয়েছে কি না তা দেখা হবে। অনেক সময় মেনটেনেন্স বা মেরামতের কাজ করতে গিয়ে টুকটাক দু-এক জায়গায় এমন হতে পারে।
তার ভাষ্য, বিটুমিন গলার একটা নির্দিষ্ট টেম্পারেচার আছে। এটা গলনাঙ্কের অনেক দূরে। ১২০ ডিগ্রির উপরে।
‘যদি কোথাও নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হয় আমরা ব্যবস্থা নেবো। শুধু বিটুমিন কেন, নিম্নমানের যে কোনো সামগ্রী আমরা টেস্ট প্রটোকল মেনটেইন করে ব্যবহার করি। নিম্নমানের হলে সেটা আমরা ব্যবহার করি না। যদি হয় তবে দেখা যাবে আমরা সাময়িক রিপেয়ার করতে গিয়েছি, সেখানে হয়তো দু-একটা জায়গায় হতে পারে’- বলেন প্রকৌশলী মইনুল হাসান।
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে চরম তাপমাত্রার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এ প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকতে পারে। ফলে সড়ক টেকসই করতে এখন থেকেই পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হবে, এমনটিই মনে করছেন অনেকে।
দেশে চলমান তাপপ্রবাহে সড়কের বিটুমিন গলে যাওয়া বা সড়কের সার্বিক হালচাল ও করণীয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান।
ভবিষ্যৎ ভাবনায় কংক্রিটের সড়ক হতে পারে টেকসই কৌশল
তিনি বলেন, টানা সাতদিন যদি তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে তাহলে বিটুমিন সহনীয় পর্যায়ে থাকে। সাতদিন পরে বিটুমিনের নিজের ভেতরের তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। তখন বিটুমিন গলতে শুরু করে। আমাদের সড়কের কিছু কিছু জায়গায় বিটুমিন গলছে না, আবার কিছু কিছু জায়গায় গলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার যে, সড়ক নির্মাণের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করেছে কি না।
‘কংক্রিটের সড়ক তৈরি করলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মন খারাপ হবে। কারণ, সড়ক কংক্রিটের হলে বছর বছর মেরামত করতে হবে না। কয়েক বছর পর পর নতুন করে নির্মাণ করতে হবে না। তাতে তাদের কাজ কমে যাবে। কিন্তু লাভ হবে রাষ্ট্র ও জনগণের’
‘ঠিকাদাররা ফাঁকফোঁকর খুঁজবেই। এগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব বাস্তবায়নকারী সংস্থার। ঠিকাদাররা বেশি মুনাফা করতে গিয়ে অনেক সময় বিটুমিনের মানের ক্ষেত্রেও কম্প্রোমাইজ করেন।’
বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, সড়কে একসময় সফট গ্রেটেড বিটুমিন ব্যবহার করা হতো, এখন হার্ড গ্রেটেড বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ১০ বছর আগেই আমাদের পলিমার মডিফাইড বিটুমিন ব্যবহারে চলে যাওয়া উচিত ছিল।
‘ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পিএমবি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। ঢাকা-রংপুর হাইওয়েতে পিএমবি ব্যবহার হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার হবে। এটি সর্বত্র ব্যবহার করা না গেলে কিছু রাস্তা টিকে থাকবে কিছু রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে কিছুদিন পরপর রাস্তা সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রকে অর্থ খরচ করতে হবে। বারবার সড়ক মেরামতের ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সড়ক টেকসই করতে এখন থেকেই পরিকল্পনা প্রয়োজন
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে সড়ক নির্মাণ কৌশলে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান।
তিনি বলেন, বিটুমিনের রাস্তা যেমন প্রতি বছর মেনটেনেন্স করতে হয় কংক্রিটের রাস্তায় সেটি প্রয়োজন হয় না। সেক্ষেত্রে আমরা যদি ৩০ বছর মেয়াদি চিন্তা করি তাহলে বিটুমিনের রাস্তা থেকে ৫০ শতাংশ কম খরচে কংক্রিটের রাস্তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কংক্রিটের সড়ক দুর্ঘটনার হ্রাসেও বড় ভূমিকা রাখবে। তবে সড়কে ওভারলোডিংও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়া বিটুমিনের শত্রু পানি। মহাসড়কের পাশে ড্রেনেজ সিস্টেম মজবুত করতে হবে। যেন সড়কে পানি জমতে না পারে।
- আরও পড়ুন
তাপদাহে গলে যাচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক!
ড. হাদিউজ্জামান বলেন, কংক্রিটের সড়ক তৈরি করলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মন খারাপ হবে। কারণ, সড়ক কংক্রিটের হলে বছর বছর মেরামত করতে হবে না। কয়েক বছর পর পর নতুন করে নির্মাণ করতে হবে না। তাতে তাদের কাজ কমে যাবে। কিন্তু লাভ হবে রাষ্ট্র ও জনগণের। ফলে এখানে কম্প্রোমাইজ করার কোনো সুযোগ নেই।
সড়কে বিটুমিন ব্যবহারের বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ড. মো. শামসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মহাসড়কে যে ভারী যানবাহন চলাচল করে তার জন্য বিটুমিনাস পিগমেন্ট কখনোই টেকসই সমাধান দিতে পারবে না৷ আমরা মহাসড়কে দেখি টোল প্লাজায় কংক্রিটের পিগমেন্ট দেয়, জলাবদ্ধতার জায়গায় কংক্রিটের পিগমেন্ট দেয়৷ বিটুমিন সব চাপ নিতে পারো না বলেই এসব জায়গায় কংক্রিটের পিগমেন্ট দেওয়া হয়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত জলাবদ্ধতা হবে, আবার তাপমাত্রাও বাড়বে৷ এগুলো বিটুমিনের শত্রু৷ যে কারণে হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাস্তা বানালেও কিছুদিন পরই মেরামতের প্রয়োজন হয়৷
সড়ক অবকাঠামো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সমস্যা হলো আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং সিদ্ধান্তগুলো নন-ইঞ্জিনিয়ারিং পারসনরা দেন৷ মন্ত্রণালয়ে বসে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে কংক্রিটের রাস্তায় খরচ বেশি৷ কিন্তু বিটুমিনের রাস্তায় যে মেরামত খরচ কংক্রিটের রাস্তায় সেটি নেই৷ এটি হলো ফিট অ্যান্ড ফ্রি৷ রাস্তার যদি লাইফসাইকেল চিন্তা করি তাহলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের কথা চিন্তা করে অবশ্যই কংক্রিটের রাস্তায় যেতে হবে৷
এনএস/এমকেআর/জেআইএম