এখনো তৈরি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ
প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে কিছু ওষুধ কোম্পানি এখনো ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির দশম বৈঠকে উত্থাপিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, এসব ফ্যাক্টরির বাইরে তালা দেয়া থাকলেও ভেতরে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। যা খেয়ে রোগী ভাল হয়ে যাবার বদলে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়ছে।
এর আগে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করার দায়ে ২০টি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। আর ২৯টি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু দুবছরেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরো ২৭টি কোম্পানি।
বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি দেশের ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এই প্রতিবেদন তৈরি করে। তারা ২০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা ছাড়াও ১৪টি কোম্পানির সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল এবং ২২টি কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশও করেছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করতে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবম ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ তদন্ত দলের বাকি সদস্যরা হলেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাহাবুদ্দিন কবীর চৌধুরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনুয়ারুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী।
বিশেষজ্ঞ দল গত দেড় বছরে ৮৪টি ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করে। এর মধ্যে নতুন ১৫টি এবং পুরনো ৬৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নবম জাতীয় সংসদ গঠিত হলে একই ধরনের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এই বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটি।
জানা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ আরো ১৭টি কোম্পানির কারখানা স্থানান্তরসহ অন্যান্য কাজ চলমান থাকায় সেগুলো পরিদর্শন করতে পারেনি তৎকালীন সংসদীয় পরিদর্শন টিম। সংসদীয় কমিটি সে সময় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
বরং এর মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালু রাখে। বাকিগুলো নানা কৌশলে অব্যাহত রেখেছে তাদের উৎপাদন ও বিপণন। এ অবস্থায় সংসদীয় কমিটির উদ্যোগে বিশেষজ্ঞ দল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তব চিত্র পর্যালোচনা করতে দ্বিতীয় দফা উদ্যোগ নেয়। তারা নতুন-পুরনো মিলিয়ে ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনের তথ্যে ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের ওষুধেও ভেজাল মিলেছে বলে জানা যায়। টেকনো ড্রাগসসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে ক্যান্সারের এই ভেজাল ওষুধ। কোনো কোনো ফ্যাক্টরি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। কিন্তু ভেতরে তাদের নিজস্ব ওষুধ ছাড়াও অন্য কোম্পানির ওষুধ তৈরি করছেন।
এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ধরনের ওষুধ।
প্রতিবেদনে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় যে ২০টি কোম্পানির উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো হল : এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রিমো কেমিক্যাল, রিদ ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।
এই ২০টি কোম্পানির মধ্যে ১৮টিই এর আগেও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। এর ফলে ওষুধ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে কোম্পানিগুলো।
এছাড়াও নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করা ১৪টি কোম্পানি হচ্ছে আদ-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যাল, আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রাইস্ট্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যাল, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যাল, এমএসটি ফার্মা, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, পনিক্স কেমিক্যাল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড। এই কোম্পানিগুলোও এর আগের তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা ২২টি কোম্পানি হচ্ছে আমিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, অ্যাজটেক ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ডিসেন্ট ফার্মা, ড. টিআইএমস ল্যাবরেটরিজ, গ্লোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যাল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যাল, মাকস ড্রাগস, মেডিম্যাট ল্যাবরেটরিজ, মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যাল, মাইস্টিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, অর্গানিক হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যাল, সীমা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল এবং হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।
কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম-এর সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, আ.ফ.ম রুহুল হক, মো. ইউনুস আলী সরকার এবং সেলিনা বেগম অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।
এইচএস/এসএইচএস/আরআইপি