বাড়ছে শিশুশ্রম
দেশে ৪৩ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কাজ করছে ১০ লাখ শিশু
শরিফুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম। বয়স ১৪ ছুঁইছুঁই। গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার নওয়াপাড়ায়। এ বয়সে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার কথা তার। অথচ আরিফুল সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকে তামাক পাতা সংগ্রহের কাজে। মাঠ থেকে তামাক সংগ্রহ করে সেগুলো শুকানো ও সংরক্ষণের কাজ করে সে। বিনিময়ে দৈনিক মজুরি পায় পাঁচশ থেকে ছয়শ টাকা। সেই টাকা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়াতেই যেন সব আনন্দ তার।
শুধু আরিফুল ইসলাম নয়, তার মতো শত শত শিশুর শৈশব এখন তামাকের মাঠে বন্দি। অল্প বয়সে নিজেদের তামাক সংরক্ষণের কাজে জড়িত করায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে আরিফুলের মতো আরও অনেক শিশুশ্রমিক।
ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা। রাজধানীর মিরপুর ৬০ ফুট এলাকায় থামে একটি লেগুনা। লেগুনার পাদানি থেকে নেমেই ‘মিরপুর নামেন’ বলে উচ্চস্বরে হাঁক দেয় এক শিশু, পরক্ষণেই ‘ওই রেডিও রেডিও’ কণ্ঠ ভেসে আসে। জীবনের এ এক কঠিন বাস্তবতা। অপরিচ্ছন্ন পোশাকে মলিনতা গ্রাস করলেও মুখমণ্ডলের কোমলতা জানান দেয় এখনো শৈশব পেরোয়নি তার। নাম জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলে জসিম।
লেগুনায় হেলপারের কাজ কখন থেকে শুরু করেছ, জানতে চাইলে ১০ বছর বয়সী জসিম জানায়, সকাল সাড়ে ৬টা থেকে কাজ শুরু হয়েছে, চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত। মাঝে সকাল, দুপুর আর রাতের খাবারের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ মিনিট করে বিশ্রাম মেলে। দিন শেষে এসব শিশুকে দৈনিক মজুরি হিসেবে তিন থেকে সর্বোচ্চ চারশ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। অবশ্য তিন বেলা খাবারের খরচ লেগুনার চালকই দেন।
জসিম দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবাকে হারায়। সঙ্গে সঙ্গে তার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায়। তার মা একজন পোশাকশ্রমিক। মা-ছেলে মিলে থাকে ৬০ ফিট এলাকায়। কাজ শেষে মায়ের হাতে তিনশ টাকা তুলে দিয়েই পৃথিবীর সব তৃপ্তি খুঁজে পায় জসিম। তার মতো এমন আরও বহু শিশু শ্রমিকের জীবনের চাকা ঘুরছে এভাবেই।
সকাল সাড়ে ৬টা থেকে কাজ শুরু হয়েছে, চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত। মাঝে সকাল, দুপুর আর রাতের খাবারের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ মিনিট করে বিশ্রাম মেলে। দিন শেষে এসব শিশুকে দৈনিক মজুরি হিসেবে তিন থেকে সর্বোচ্চ চারশ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। তিন বেলা খাবারের খরচ অবশ্য লেগুনার চালকই দেন।- শিশুশ্রমিক জসিম
সরেজমিনে দেখা যায়, লেগুনায় যারা হেলপারের কাজ করে তাদের অধিকাংশই জসিমের মতো শিশু। লেগুনার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। একটু এদিন-ওদিক হলেই পা ফসকে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। হয়তো থেমে যেতে পারে জীবনের চাকা। তারপরও প্রতিদিন নিয়ম করে কাজে বের হতে হয় এই শিশুদের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, বর্তমানে (২০২২) দেশে মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন হয়েছে। অথচ ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন। এসব শিশুর মধ্যে বর্তমানে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কাজ করছে। এরমধ্যে পাঁচটি খাতে ৩৮ হাজার আটজন শিশু কাজ করছে। যার ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশই ছেলে। সবচেয়ে বেশি কাজ করছে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে।
শিশুশ্রম নিয়ে বিবিএসের করা এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) প্রকাশিত ওই জরিপে বিবিএস বলছে, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩টি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব খাতের তালিকা থেকে পাঁচটি খাত নির্বাচন করে বিবিএস।
এগুলো হলো- ১. মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ২. চামড়ার তৈরি পাদুকা শিল্প, ৩. লোহা ও ইস্পাত ঢালাই, ৪. মোটর যানবাহন মেরামত বা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ এবং ৫. স্থানীয় টেইলারিং ও পোশাক খাত।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট অফিসার মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসন খান জাগো নিউজকে বলেন, সম্প্রতি পরিচালিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মোট সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন। তাদের মধ্যে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশু কর্মে নিয়োজিত, ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন শিশুশ্রমে। বর্তমানে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য।
শিশুশ্রম বলতে এমন কাজকে বোঝায়, যা শিশুদের শৈশব, শিক্ষা এবং মানসিক বা শারীরিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত করে। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বলতে এমন কাজ বোঝায়, যা শিশুদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে। এটি একটি বড় স্বস্তির বিষয় যে, ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে কাজ করা শিশুদের সংখ্যা ২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপের তুলনায় কমেছে। এটি হ্রাস পাওয়ায় আশা করা যায় শিশুশ্রমে জড়িত শিশুদের সামগ্রিক সংখ্যাও অদূর ভবিষ্যতে কমে যাবে- বলছে বিবিএস।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ৩৮ হাজার আটজন শিশু উল্লিখত খাতগুলোতে কাজ করছে। যাদের বয়স ৫-১৭ বছরের মধ্যে। ৪০ হাজার ৫২৫টি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে এসব শিশু। ঝুঁকিপূর্ণ খাতে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ ছেলে এবং ২ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে।
এ পাঁচটি খাতে শ্রমজীবী মোট শিশুর সংখ্যা যথাক্রমে শুঁটকি মাছ উৎপাদনে ৮৯৮ জন, চামড়ার পাদুকা তৈরিতে পাঁচ হাজার ২৮১ জন, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার ম্যাকানিকের কাজে চার হাজার ৯৯ জন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ২৪ হাজার ৯২৩ জন এবং অনানুষ্ঠানিক ও স্থানীয় টেইলারিং বা পোশাক খাতে দুই হাজার ৮০৫ জন। এসব খাতে কর্মরত শিশুর ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ পল্লি এবং ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ শহর এলাকায় বসবাস করে।
বর্তমানে (২০২২) দেশে মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন হয়েছে। অথচ ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন। এসব শিশুর মধ্যে বর্তমানে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।- বিবিএসের জরিপ
এ জরিপের মাধ্যমে একজন শ্রমজীবী শিশু কী ধরনের বিপজ্জনক কাজ করতে পারে, তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। আনুমানিক ১৯ দশমিক ১ শতাংশ ছেলে এবং ৭ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে শিশু ভারী বোঝা বহন ও মালামাল টানার কাজ করে। অধিক ওপরে বা ফ্লোর থেকে উচ্চতায় উঠে কাজ করে প্রায় ৮ দশমিক ১ শতাংশ ছেলে এবং দশমিক ৩ শতাংশ মেয়ে শিশু।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় বিবিএস বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্যাটার্নে এ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০২৩ সালের ৩ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। এ জরিপটি নির্বাচিত পাঁচটি খাতে নিয়োজিত শিশুদের কাজের প্রকৃতি ও তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরে।
জরিপ প্রতিবেদনটি এ খাতসমূহের শ্রমজীবী শিশুদের জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন পারিবারিক বৈশিষ্ট্য, আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য এবং কর্মসংস্থান সম্পর্কিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরে।
বিবিএস আরও জানায়, দেশে এখন শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর। এ সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন। ১০ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৬ হাজার ৫৫৮ জন। বর্তমানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন শিশু। ২০১৩ সালের জরিপে ছিল ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। এক্ষেত্রে শিশুশ্রমিক বেড়েছে ৭৭ হাজার ২০৩ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল চাইল্ড লেভার সার্ভে ২০২২ এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন। ১০ বছর আগের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার ১৯৫ জন। এক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিক কমেছে দুই লাখ ১১ হাজার ৯৮৩ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ এর ফলাফলে দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫ জন বা ৩৯ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন। তাদের মধ্যে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। শিশুশ্রমে যুক্ত শিশুর সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে যুক্ত এক লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন।
২০১৩ সালের শিশুশ্রম জরিপে দেখা গেছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৪ জন। তাদের মধ্যে যথাক্রমে শ্রমজীবী শিশু ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন আর শিশুশ্রমে যুক্ত ছিল ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে যুক্ত ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার ১৯৫ জন।
প্রতিবেদনে আর ও বলা হয়, ২০১৩ এবং ২০২২ এর ফলাফলের তুলনা করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শ্রমজীবী শিশু এবং শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা সামান্য বেড়েছে। গত ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় এ বৃদ্ধি খুবই অল্প। তবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশে দুই কোটি ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭ জন ছেলে শিশু আর এক কোটি ৯২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭৫ জন মেয়ে শিশু। কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। যার মধ্যে ২৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪ জন ছেলে শিশু এবং ৮ লাখ ২ হাজার ৮৮৩ জন মেয়ে শিশু। শিশুশ্রমে নিয়োজিত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জনের মধ্যে ছেলে ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৫৪ এবং মেয়ের সংখ্যা ৪ লাখ ১ হাজার ৯৪৩ জন। একই ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জনের মধ্যে ছেলে ৮ লাখ ৯৫ হাজার ১৯৫ এবং মেয়ে এক লাখ ৭৩ হাজার ১৭ জন।
৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ৩ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫২ জনের বসবাস। শহরাঞ্চলে বাস করে ৯৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৫৩ জন। গ্রাম ও শহরে কর্মরত শিশুদের সংখ্যা যথাক্রমে ২৭ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ এবং ৮ লাখ ১১ হাজার ৫২৭ জন। একই ভাবে গ্রামীণ এলাকায় শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৪ আর শহরাঞ্চলে ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩৬ জন। গ্রামে ও শহরে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে জড়িত শিশু রয়েছে যথাক্রমে ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬৯৩ এবং ২ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৯ জন।
অর্থনৈতিক খাতগুলো বিবেচনা করে দেখা যায়, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট শিশুর মধ্যে ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৫৫৯ জন শিশু কৃষিতে কাজ করে। ১১ লাখ ৯১ হাজার ৮০৬ জন শিশু শিল্প খাতে কাজ করে। ১২ লাখ ৭০ হাজার ৪৩১ জন শিশু সেবা খাতে নিয়োজিত।
বিবিএস জানায়, বর্তমানে দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫ জন। অত্যধিক শিশুশ্রমিকের এ সংখ্যা ভবিষ্যতে শিশুশ্রম বন্ধ করার ক্ষেত্রে একটি বিশাল বাধা হিসেবে কাজ করবে। সংজ্ঞা অনুসারে যারা শিশুশ্রমিক নয়, কিন্তু এখনো শ্রমজীবী শিশুদের সঙ্গে সহাবস্থান করে তাদের আধিক্য নির্দেশ করে যে, বিদ্যমান আইনে শিশুশ্রমকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার ব্যাপ্তি বিস্তৃত করার সুযোগ রয়েছে।
এ কারণে ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী শ্রমিক এবং এ বয়সের জন্য অনুমোদিত হালকা শ্রেণির কাজে শ্রমজীবী শিশুদের মোট সংখ্যা শিশুশ্রমের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের মোট সংখ্যাকে প্রভাবিত করতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে সম্পৃক্ত কিশোর-কিশোরীদের যে কোনো ধরনের বিপজ্জনক কাজ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের যথাযথ হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, বলছে বিবিএস।
চট্টগ্রাম বিভাগে শিশুশ্রমিক সবচেয়ে বেশি
দেশের আটটি বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শ্রমজীবী শিশু ও শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। চট্টগ্রাম বিভাগে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সর্বাধিক এবং বরিশাল বিভাগে সর্বনিম্ন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে শিশুশ্রমের ঘনত্ব বেড়েছে।
আবার শহর এবং গ্রামের তুলনামূলক অবস্থান বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, গ্রামীণ এলাকায় শিশু সংখ্যার ঘনত্ব, শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা এবং শিশুশ্রমের হার শহরের তুলনায় বেশি। এ তথ্যগুলো শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্তৃক পুনর্বাসন কৌশল প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শিক্ষায় মোট ব্যয়ের ৭১ শতাংশই ব্যয় করতে হয় পরিবারকে। অনেকে এটি বহন করতে পারেন না। এছাড়া নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। অনেকের কাছে লেখাপড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। শিক্ষার হার বাড়লে শিশুশ্রম কমবে। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ।- রাশেদা কে চৌধুরী
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুরা যদি শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় তবে তাদের শিশুশ্রমে প্রবেশের প্রবণতা হ্রাস পাবে। প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, বর্তমানে মোট শিশু সংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্কুলে যাচ্ছে। স্কুলে অনুপস্থিতির পেছনে কিছু কারণ হচ্ছে শিক্ষার ব্যয় বহনে অপারগতা এবং শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারা। এছাড়া সামাজিক কারণে মেয়ে শিশুশ্রমিকরা পরিবারের কাছ থেকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি না পেয়ে গৃহস্থালি কাজে অধিক পরিমাণে নিয়োজিত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু শ্রমজীবী শিশু, শিশুশ্রমিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। যারা এখনো শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নতুন করে শিশুদের কাজে প্রবেশ রোধ করতে হবে বলে মনে করে বিবিএস।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, শিশু শ্রমিক তথা শ্রমজীবী শিশুরা চরম দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ অধিকাংশ শিশু শ্রমিক নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করে এবং তারা বিভিন্ন ধরনের আর্থসামাজিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। কাজেই দারিদ্র্য শিশুশ্রমে জড়িত হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। বরং বঞ্চনার আরও কিছু কারণ রয়েছে। গ্রামে কৃষি, বনজ বা মৎস্য শিকার হলো শ্রমজীবী শিশু এবং শিশুশ্রমের জন্য অগ্রণী খাত। অন্যদিকে শহরে এ খাত হচ্ছে উৎপাদন খাত। এছাড়া পাইকারি, খুচরা, নির্মাণ ও পরিবহন খাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুশ্রমিক পাওয়া যায় এবং এ শিশুদের একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত হিসেবে বিবেচিত হয়।
শ্রমজীবী শিশু এবং শিশু শ্রমিকরা বেতনভোগী, যা কি না প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে। এ থেকে আরও ধারণা পাওয়া যায় যে, আত্মকর্মসংস্থানের চেয়ে বাজারভিত্তিক সুবিধা লাভের সুযোগ বেতনের বিনিময়ে কাজের ক্ষেত্রে বেশি। শ্রমজীবী শিশুদের কাজে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাজারভিত্তিক সুযোগের লাগাম টেনে ধরার জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি সাত কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। তার মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। তবে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ কোটি ৬৯ লাখ। দেশে গত পাঁচ বছরে বেকারের সংখ্যা কমে ২৬ লাখ ৩০ হাজারে নেমেছে, যেটি ২০১৬ সালের হিসাবে ছিল ২৭ লাখ। এসব ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ পায় না। তাদের মধ্যে বেকার পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার আর বেকার নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার।
বিবিএসের মতে, বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগও পায় না। বেকারত্বের এ হিসাব আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী। আইএলও মনে করে, সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২ সালে বেকারত্বের হার কমেছে। আগে যেখানে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, এখন তা কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাত কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। গত পাঁচ বছরে ৯৯ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক বেড়েছে। জরিপে বলা হচ্ছে, শ্রমশক্তির বাইরে মোট জনশক্তি চার কোটি ৬৯ লাখ। ২০১৬ সালের তুলনায় এ সংখ্যা ১৪ লাখ বেড়েছে।
দেশে বর্তমানে গড় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আগে ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তাদের মধ্যে পুরুষ ৩ দশমিক ৫৬ এবং নারী ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তাছাড়া, দেশে এখন ৭ কোটি ৭ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে কৃষিখাতে সবচেয়ে বেশি ৩ কোটি ২২ লাখ।
বিবিএস জরিপে উঠে এসেছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এরমধ্যে গ্রামে ৫০ দশমিক ৮৯ ও শহরে ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ নারী শ্রমশক্তি।
শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, কৃষিখাতে ৩২ দশমিক ২, শিল্পে ১২ দশমিক ০৫ ও সেবাখাতে ২৬ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী কাজে নিয়োজিত। জরিপে দেখা গেছে, কৃষি ও সেবাখাতে শ্রমশক্তি বেড়েছে।
শিশুশ্রম প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণ শিশুশ্রম বেড়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কমেছে। ওভারঅল শিশুশ্রম দুটি কারণে বেড়েছে। তার একটি হলো রুটি-রুজির চিন্তায় শিশুদের বাইরে কাজ করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমছে। বাজেটে শিক্ষাখাতে সবসময়ই বরাদ্দ কম।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক শাখা ইউনেসকো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, শিক্ষায় মোট ব্যয়ের ৭১ শতাংশই ব্যয় করতে হয় পরিবারকে। অনেকে এটি বহন করতে পারেন না। এছাড়া নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। অনেকের কাছে লেখাপড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। শিক্ষার হার বাড়লে শিশুশ্রম কমবে। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ।
এমওএস/এমকেআর/জেআইএম