ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘ট্রায়াল ট্রিপ’ পাস নিয়ে সাগরে ২৫ বছর মাছ শিকার

ইকবাল হোসেন | প্রকাশিত: ০৬:১৭ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

বঙ্গোপসাগরে কোনো জাহাজকে মাছ শিকার করতে হলে সরকারের নিবন্ধন নিতে হয়। দিতে হয় রাজস্ব। এর আগে ট্রায়াল ট্রিপ বা পরীক্ষামূলকভাবে মাছ শিকারের সুযোগ পায় জাহাজগুলো। এ সুযোগ নিয়ে ৩১টি বাণিজ্যিক জাহাজ তিন থেকে ২৫ বছর ধরে ট্রায়াল ট্রিপেই মাছ শিকার করছে। ফলে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর ও নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ট্রায়াল ট্রিপ’ পাস নিয়েই জাহাজগুলো সাগরে মাছ শিকারে যায়। প্রত্যেকটি জাহাজেরই ট্রায়াল ট্রিপের বিষয়ে আদালতের আদেশ রয়েছে।

সামুদ্রিক মৎস্যখাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশে ‘কতদিন ট্রায়াল দেওয়া যাবে’ তা উল্লেখ নেই। আইনি এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই বছরের পর বছর ট্রায়াল ট্রিপে চলছে এসব জাহাজ।

সূত্র জানায়, ‘এফভি স্যাটেলাইট-০১’ নামে জাহাজটি উচ্চ আদালত থেকে একটি রিট মামলার আদেশ নিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৬ জুন থেকে ট্রায়াল ট্রিপে সমুদ্রে মাছ শিকার করছে। একইভাবে তালিকায় সবশেষ সংযোজন ‘এফভি সুরমা’। থাইল্যান্ড থেকে আনা এ জাহাজটিও একটি রিট মামলার আদেশ নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ট্রায়ালের অনুমতি পায়। রিট মামলার আদেশ নিয়ে চলমান এ ট্রায়াল ট্রিপের তালিকায় আছে ৩১টি জাহাজ।

‘এফভি স্যাটেলাইট-০১’ এর মালিকানা প্রতিষ্ঠান স্যাটেলাইট ফিশিং লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর থেকে জাহাজটির সেইলিং পারমিশন চেয়েছিলাম। পরে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হই। হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকায় সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ট্রায়াল ট্রিপ পারমিশন নিয়ে এখনো চলছে।’

‘ট্রায়াল ট্রিপ’ পাস নিয়ে সাগরে ২৫ বছর মাছ শিকার

‘এফভি সুরমা’ জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল মদিনা ফিশ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোশাররফ হোসেন সাজু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এফভি সুরমার সেইলিং পারমিশন নিতে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তাদের কাছ থেকে অনুমতি না পেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। এখন অস্থায়ী পারমিশন নিয়ে জাহাজটি সাগরে যাচ্ছে। মামলাটিও উচ্চ আদালতে শুনানির জন্য রয়েছে। স্থায়ী আদেশ হলে হয়তো সুরাহা হবে।’

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ‘এফভি ফিশ হান্টার’ ২০০০ সালের ২ অক্টোবর, ‘এফভি বিসমিল্লাহ’ ২০০০ সালের ৪ অক্টোবর, ‘এফভি পাওয়ার সোর্স-১’ ২০০০ সালের ২৩ অক্টোবর, ‘এফভি স্টার-০১’ ২০০১ সালের ১৩ মার্চ, ‘এফভি মেরিন হারভেস্টার-২’ ২০০১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, ‘এফভি সালাম-০২’ ২০০১ সালের ৬ অক্টোবর, ‘এফভি ইউনিকো-১৫’ ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর, ‘এফভি সি বার্ড’ ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর, ‘এফভি শাহপরী-০১’ ২০০৬ সালের ২৩ মার্চ, ‘এফভি মা আমেনা-১’ ২০১০ সালের ২১ নভেম্বর, ‘এফভি সাফা-১’ ২০১১ সালের ২১ জুন, ‘এফভি সি কুইন-০১’ ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর, ‘এফভি মায়া-১’ ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ‘এফভি আর হাসান-০২’ ২০১২ সালের ২০ মার্চ, ‘এফভি আর হাসান-০১’ ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, ‘এফভি আফিফ-১’ ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, ‘এফভি তাস-১’ ২০১৩ সালের ৪ জুলাই, ‘এফভি হুমায়রা-১’ ও ‘এফভি জুয়েল’ ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি, ‘এফভি শহীদুল-১’ ও ‘এফভি সাদিয়া’ ২০১৪ সালের ৩ মার্চ, ‘এফভি জ্যোতি’ ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ, ‘এফভি সি হারভেস্ট’ ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি, ‘এফভি গাংচিল-০১’ ২০১৫ সালের ২ আগস্ট, ‘এফভি সাগর-০১’ ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল, ‘এফভি এসঅ্যান্ডএ অফ বে অব বেঙ্গল-২’ ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ‘এফভি সাতকানিয়া-১’ ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর, ‘এফভি মায়া’ ২০২০ সালের ৯ মার্চ এবং ‘এফভি সোনারবাংলা’ ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ট্রায়াল ট্রিপে চলছে।

আরও পড়ুন

সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস এম সাজ্জাদ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রত্যেক ট্রিপে স্টিল বডি ফ্রিজার বাণিজ্যিক ট্রলারের ফি তিন হাজার টাকা এবং নন-ফ্রিজার ট্রলারের ফি দুই হাজার টাকা করে, সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ চালানের মাধ্যমে আদায় করা হয়।’

এসব জাহাজ মাসে দুটি ট্রিপও দেয়। সে হিসাবে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

‘ট্রায়াল ট্রিপ’ পাস নিয়ে সাগরে ২৫ বছর মাছ শিকার

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিমি এলাকাজুড়ে বাংলাদেশের সীমানায় মৎস্য শিকার করতে পারে দেশি নৌযানগুলো। বর্তমানে সামুদ্রিক জেলের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার। সামুদ্রিক যান্ত্রিক নৌযানের সংখ্যা ৬৭ হাজার ৬৬৯টি। সমুদ্রে মাছ শিকারের জন্য সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন পাওয়া বাণিজ্যিক জাহাজ (ফিশিং ভ্যাসেল) রয়েছে ২৩২টি (ট্রায়াল ট্রিপ বাদে)। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বঙ্গোপসাগর থেকে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মৎস্য আহরিত হয়েছে। এর মধ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা দ্বারা আহরণ হয়েছে পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন।

জানা যায়, বাংলাদেশ জলসীমায় ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে কিছু থাই ট্রলার (ফিশিং ভ্যাসেল) ধরা পড়ে। পরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এসব জাহাজ সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করে। এছাড়া ভারতীয় ও মিয়ানমারের কিছু ট্রলারও বাংলাদেশি জলসীমায় মাছ শিকারের সময় ধরা পড়ে। এসব জাহাজ সরকারি দপ্তর থেকে নিলামে নিয়ে মেরামত করে ট্রায়াল ট্রিপের অনুমতি নেন ভ্যাসেলগুলোর মালিকরা। আদালতের নির্দেশে ট্রায়াল ট্রিপের অনুমতি দেওয়া হলেও সরকার কোনো রাজস্ব পায় না বলে জানিয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর।

মেরিন হোয়াইট ফিশ ট্রলার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছু ট্রলার উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে সাগরে মাছ শিকার করতে যায়। বেশ কয়েক বছর আগে বঙ্গোপসাগরে অবৈধভাবে মাছ শিকারে আসা কিছু বিদেশি জাহাজ কোস্টগার্ড আটক করে মৎস্য অধিদপ্তরকে সোপর্দ করে। এসব জাহাজ মৎস্য অধিদপ্তর নিলামে বিক্রি করে।’

‘যারা নিলামে এসব জাহাজ কিনেছে তারা সাগরে মাছ শিকারের অনুমতি চাইলেও সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর তাদের জাহাজের অনুমতি দেয়নি। যে কারণে এসব জাহাজের মালিকরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। কয়েকবছর হয়ে গেলেও সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর বিষয়গুলো সুরাহা করছে না। এতে জাহাজ মালিকরা বিনিয়োগ করে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।’

এ বিষয়ে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক মো. আবদুস ছাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রায়াল ট্রিপে চলমান জাহাজগুলোর বিষয়ে আদালতের আদেশ আছে। আদালতের আদেশ মেনেই এ পর্যন্ত ৩১টি ফিশিং ভ্যাসেলকে ট্রায়াল ট্রিপের অনুমতি দিয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর।’

তিনি বলেন, ‘আগে ট্রায়াল ট্রিপে চলাচলকারী এসব জাহাজ থেকে কোনো ফি কিংবা রাজস্ব পাওয়া যেত না। আমরা এখন ফি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চলমান মামলাগুলো সুরাহার জন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। মন্ত্রণালয়ও জাহাজগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একমত হয়েছে। এখন আদালতে গিয়ে শুনানি করে দ্রুততম সময়ে আমরা সমস্যাগুলো সুরাহা করতে পারবো।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস