ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

কারিগরির সার্টিফিকেট বাণিজ্য

তালিকায় আরও ২৫-৩০ জন, রয়েছে দুদক কর্মকর্তার নাম

তৌহিদুজ্জামান তন্ময় | প্রকাশিত: ১০:১৩ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২৪

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনা মোড় নিচ্ছে ভিন্ন দিকে। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে সাপ। শুধু কারিগরি শিক্ষা বোর্ড নয়, এই জালিয়াতিতে উঠে আসছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামও। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত সূত্র জানাচ্ছে এমন তথ্য।

এ ঘটনায় এরই মধ্যে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলী আকবরের স্ত্রী মোছা. সেহেলা পারভীনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে মো. আলী আকবরকে।

ডিবি জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবরের সার্টিফিকেট বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কারিগরির সার্টিফিকেট বাণিজ্য, তালিকায় আরও ২৫-৩০ জন, রয়েছে দুদক কর্মকর্তার নাম

রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় হওয়া এ সংক্রান্ত মামলায় এখন পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান, তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল, কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, কামরাঙ্গীরচর হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি লালবাগ বিভাগ।

সার্টিফিকেট জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা এ কে এম শামসুজ্জামান
ডিবির আরেকটি সূত্র জানায়, যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের পাশাপাশি সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে আরও রাঘববোয়াল জড়িত। তাদের তালিকাও করা হচ্ছে। দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। দুদক কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ আরও কমপক্ষে ৩০ জন এই সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে ডিবি। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

এ বিষয়ে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই দুর্নীতির খনির ভেতরে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি। আরও কাজ বাকি। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের তালিকা করা হচ্ছে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুতই গ্রেফতার করা হবে।’

কারিগরির সার্টিফিকেট বাণিজ্য, তালিকায় আরও ২৫-৩০ জন, রয়েছে দুদক কর্মকর্তার নাম

এখন পর্যন্ত যাদের নামে উঠে এসেছে তদন্তে
ডিবি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে বোর্ডের সদস্য সাবেক চেয়ারম্যানসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে শুধু এই ছয়জন জড়িত নয়, বোর্ডের আরও কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।

জানা যায়, সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আরও তিন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতা আব্দুল বাছের, রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন সময় বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন ও জাল সার্টিফিকেট তৈরি করার কথা বলতেন।

আরও পড়ুন

তাদের দাবি অনুযায়ী, এ কে এম শামসুজ্জামান সার্টিফিকেট তৈরি ও রেজাল্ট পরিবর্তন করে দিতেন। তবে এজন্য তারা শামসুজ্জামানকে কোনো টাকা দিতেন না। একই বোর্ডের লোক হওয়ায় শামসুজ্জামান তাদের কাছে টাকা চাইতে সাহসও পেতেন না।

কারিগরির সার্টিফিকেট বাণিজ্য, তালিকায় আরও ২৫-৩০ জন, রয়েছে দুদক কর্মকর্তার নাম

নাম উঠে আসছে দুদক কর্মকর্তাদেরও
ডিবি সূত্রে জানা যায়, সার্টিফিকেট দুর্নীতির সঙ্গে খোদ দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরও নাম উঠে আসছে। দুদকের দুজন উপ-পরিচালক মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতির মামলায় এ ঘটনার মূলহোতা শামসুজ্জামানকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, শামসুজ্জামানের সার্টিফিকেট দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা হয় দুদকে। দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা মামলার তদন্তের জন্য শামসুজ্জামানকে ডাকেন। এরপর থেকে দুদকের ওই কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শামসুজ্জামান। কিন্তু সেই কর্মকর্তাকে ম্যানেজ না করতে পেরে দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তার দারস্থ হন।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে ডিবি অফিসে ডাকা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।- ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ

সেই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে তার বাড্ডার বাসায় ডেকে নেন। ওই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে বলেন, এখন যে কর্মকর্তার কাছে মামলার তদন্ত আছে তাকে ম্যানেজ করা যাবে না। তাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে হবে, এজন্য দুদকের এই কর্মকর্তাকে ৩০ লাখ দিতে হবে শামসুজ্জামানকে। শামসুজ্জামান ওই কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী ৩০ লাখ টাকার ডলার কিনে তাকে দেন। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়।

আরও জানা যায়, নতুন তদন্ত কর্মকর্তাও দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা। তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকার ওপরে শামসুজ্জামানের কাছ থেকে নিয়ে তাকে দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।

যেভাবে সংগ্রহ হতো সার্টিফিকেটের আসল কাগজ
রিমান্ডে থাকা শামসুজ্জামান ডিবিকে জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট কাগজ প্রতি বান্ডেলে ৫০০টি করে থাকে। বান্ডেলে করা এসব কাগজ শামসুজ্জামান শিক্ষা বোর্ডের অফিস থেকে সংগ্রহ করতেন। তবে তার কাছে জাল সার্টিফিকেট তৈরির এত চাহিদা থাকতো যে বোর্ড অফিসের কাগজ পর্যাপ্ত হতো না। কাগজের জোগান ঠিক রাখতে রাজধানীর পুরান ঢাকা ও রংপুরের একটি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের আসল কাগজের নমুনা দেখানোর পর তারা হুবহু সার্টিফিকেটের কাগজ তৈরি করে দিতেন শামসুজ্জামানকে।

কারিগরির সার্টিফিকেট বাণিজ্য, তালিকায় আরও ২৫-৩০ জন, রয়েছে দুদক কর্মকর্তার নাম

শামসুজ্জামান প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে এসব কাগজ দিয়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। এসব জাল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার কাজ করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল। রাজধানীর পীরেরবাগ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার জন্য। সেখানে এসব জাল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করতেন ফয়সাল। তারপর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে এসব জাল সার্টিফিকেট আপলোড করে দিতেন শামসুজ্জামান। আপলোড করার পর এসব জাল সার্টিফিকেট পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে ভেরিফিকেশন করা যেত।

যেভাবে সার্টিফিকেট তৈরির কলাকৌশল শেখেন শামসুজ্জামান
জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানান, তিনি ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সার্টিফিকেট তৈরির কাজ শেখেন। মোহাম্মদ শামসুল আলম নামে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্টের কাছ থেকে এই জালিয়াতি শেখেন। শামসুল আলম বিভিন্ন সময় ডিপ্লোমা পরীক্ষার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করতেন। শিক্ষার্থীদের কাছে জাল সার্টিফিকেটও বিক্রি করতেন তিনি। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী পাস করতে পারতো না তাদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন শামসুল। তার কাছ থেকে শিখে শামসুজ্জামান এসএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষার্থীদের জাল সার্টিফিকেট বানানোসহ পরীক্ষা প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দিতেন।

কত টাকায় বিক্রি হতো জাল সার্টিফিকেট?
ডিবি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রথমে দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। পরে দালালরা শামসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করত। পরে সেই অনুযায়ী শামসুজ্জামান জাল সার্টিফিকেট বানাতেন। জাল সার্টিফিকেটপ্রতি ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে। পরিচালকরা সার্টিফিকেটপ্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা দিলেও তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও মোটা অংকের টাকা নিতেন। প্রায় ৩০ জনের মতো দালাল ও পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শামসুজ্জামানের।

নরসিংদী, ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দালাল ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে গতকাল ওএসডি করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) তাকে ডিবি অফিসে ডাকা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

টিটি/এএসএ/জেআইএম