ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

ঈদ বাজারে কেমন আছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

রায়হান আহমেদ | প্রকাশিত: ০৫:৪৯ এএম, ১৮ মার্চ ২০২৪

বঙ্গবাজারের কথা উঠলেই চোখে ভেসে ওঠে ভয়ঙ্কর সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। গত বছর ঈদের আগে আগুনে পুড়ে ছাই হয় রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী বঙ্গবাজার মার্কেট। এতে নিঃস্ব হয়েছিলেন সেখানকার হাজারো কাপড় ব্যবসায়ী। অগ্নিকাণ্ডের পর গত সাড়ে এগারো মাসেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তারা। এখন তাদের মধ্যে নেই কর্মচাঞ্চল্য। ব্যবসায়ীদের অনেকে নতুন দিনের অপেক্ষায় এখনো সময় গুনছেন। সুদিন কবে আসবে জানা নেই তাদের।

ঈদুল ফিতরের মাত্র কয়েক দিন আগে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টির মতো ইউনিট প্রায় সাত ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে তার আগেই পুরো মার্কেটটি পুড়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই গত দুটি ঈদ কেটেছে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের। আগুন লাগার পর সেখানকার চিরচেনা রূপ পাল্টে গেছে, নেই ক্রেতার ভিড়। তবে ব্যবসায়ীরা বাঁচার তাগিদে আর ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় সেখানেই চৌকি বিছিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে যতটুকু সম্ভব বেচাকেনা করছেন।

একসময় শীত, গ্রীষ্ম বারোমাস বঙ্গবাজার থাকতো জমজমাট। ঈদ কিংবা যে কোনো অনুষ্ঠান-পার্বণে ক্রেতারা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতাদের পাশাপাশি পাইকারদেরও ভিড় লেগে থাকতো। সেই বঙ্গবাজার এখন যেন চেনা নগরের অচিন এক ভূখণ্ড।

jagonews24

বছর ঘুরে আবারও দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। ঈদ ঘিরে এরই মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে মার্কেট, শপিংমলগুলোতে একটু একটু করে ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়ছে। এসময়ে কেমন আছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। কেমন কাটছে তাদের দিন। ব্যবসার হালচাল কী। ঈদ ঘিরে তাদের প্রস্তুতি কেমন। এসব বিষয়ে জানতে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ।

শীত, গ্রীষ্ম বারোমাস বঙ্গবাজার থাকতো জমজমাট। ঈদ কিংবা যে কোনো অনুষ্ঠান-পার্বণে ক্রেতারা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতাদের পাশাপাশি পাইকারদেরও ভিড় লেগে থাকতো। সেই বঙ্গবাজার এখন যেন চেনা নগরের অচিন এক ভূখণ্ড

সরেজমিনে বঙ্গবাজার (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট) ঘুরে দেখা গেছে, বঙ্গবাজার আর আগের মতো নেই। ব্যবসায়ীরা সেখানে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। চৌকি বিছিয়ে আর শামিয়ানা টাঙিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তাদের ব্যবসা। অধিকাংশ দোকানে নেই নিজস্ব সাইনবোর্ড। কেউ কেউ পরিচিত ক্রেতাদের সুবিধার্থে বাঁশের খুঁটিতে দোকানের নম্বরসহ সাঁটিয়েছেন ব্যানার। তবে ঈদের আমেজ বলতে কিছু নেই বঙ্গবাজারে। ক্রেতাদের ভীড় কম। চোখে পড়েনি তেমন বেচাকেনাও। তবে পুড়ে যাওয়া মার্কেটটিতে বর্তমানে অস্থায়ীভাবে পাঁচশোর বেশি দোকান রয়েছে বলে জানা গেছে।

সেখানকার ব্যবসায়ীরা জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, গত বছর আগুন লাগার পর অনেকেই স্থান পরিবর্তন করে আশপাশের মার্কেটে চলে গেছেন। তাদের বেশিরভাগই বড় ব্যবসায়ী। কেউ কেউ ব্যবসা একদম গুটিয়ে নিয়েছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় যারা আবার ব্যবসা শুরু করেছেন তারাও ভালো নেই। অনেকে পরিচিত কাস্টমার হারিয়েছেন। বর্তমানে ছোট ছোট টং দোকান হওয়ায় পর্যাপ্ত মালের পসরা সাজাতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন

এছাড়াও সারাদেশ থেকে একসময় যারা বঙ্গবাজার এসে কেনাকাটা করতেন তারা এখন রাজধানীর অন্য জায়গা থেকে মাল সংগ্রহ করেন। আগুনে পোড়ার পর মার্কেটে যে অস্থায়ীভাবে দোকানপাট বসেছে, সেই খবর অনেকেরই জানা নেই। এ কারণে কাস্টমারও কম, এমন তথ্যই দিচ্ছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা।

এক বছর আগেও তিনটি দোকানের মালিক ছিলেন মায়ের দোয়া গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী সুমন। বর্তমানে একটি দোকান নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সারা পৃথিবী দেখেছে বঙ্গবাজারের আগুন। কিন্তু এখানকার ব্যবসায়ীরা কীভাবে আছেন, কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কখনো সেই খোঁজ নেয়নি। হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজি ছিল এখানে। এখন বাজার মরা। সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে সেটাও অজানা। আমাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবো কি না জানিনা।

এখন কেমন চলছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের বেচাকেনা তো নেই। ঈদ মৌসুমেও আমাদের বাজার ঠান্ডা। টুকটাক যা হয় তা দিয়েই খেয়ে-পরে কোনোভাবে বেঁচে আছি।

jagonews24

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন হেদায়েত উল্লাহ। তিনি রাকিব গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী। জাগো নিউজকে বলেন, অনেক পাইকারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বেচাকেনার সম্পর্ক ছিল। আগুন লাগার পর থেকে সব হারিয়েছি। অনেকে তো এখনকার টং দোকান খুঁজেই পায় না। কেউ কেউ আবার এসে সব মাল পায় না। তাই অন্য মার্কেটে চলে যায়। এভাবে আমাদের অনেক কাস্টমার ছুটে গেছে। এসব কারণে এখানকার ব্যবসায়ও মন্দা চলছে।

একই তথ্য দিচ্ছেন শেখ ফরিদ নামের অন্য একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমাদের দুইটা দোকান পুড়ে গেছে। অন্য সময়ে ঈদের আগে জমজমাট বেচাকেনা হত। পাইকাররা ধাপে ধাপে এসে ঈদের মালামাল নিত। এবার ব্যবসার আকার ছোট হয়ে গেছে। বেচাকেনাও কম। বড় কোনো অর্ডার পাচ্ছি না। আগের দোকানের যে অ্যাডভান্স ছিল সেই টাকা এখনো পাইনি। শুনলাম ঈদের পর অস্থায়ী দোকানগুলোও ভেঙে ফেলবে। এরপর আমাদের কোথায় ঠাঁই হবে এখনো জানিনা।

সারা পৃথিবী দেখেছে বঙ্গবাজারের আগুন। কিন্তু এখানকার ব্যবসায়ীরা কীভাবে আছেন, কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কখনো সেই খোঁজ নেয়নি। হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজি ছিল এখানে। এখন বাজার মরা। সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে সেটাও অজানা। আমাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবো কি না জানিনা

দোকান ছোট হওয়াতে সব ডিজাইন ও সাইজের মালামাল রাখতে পারছেন না বঙ্গবাজারের বর্তমান ব্যবসায়ীরা। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে পারছেন না তারা। পাইকাররাও ধীরে ধীরে আশপাশের মার্কেটগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

সোহাগ গার্মেন্টসের সোহেল নামের একজন জানান, দোকান আয়তনে ছোট হওয়ার কারণে সব ডিজাইন বা সাইজের মাল রাখতে পারি না। কাস্টমার এলে অনেক সময় ফিরে যেতে হয়। একজন কর্মচারী রাখলে দৈনিক খরচ, নিজের খরচ, ইফতার খরচ ও অনেক সময় ওঠে না। গত বছর থেকেই এভাবে টানাটানিতে আছি। বিগত সময়ে ঈদের আগে বেচাকেনার ধুম পড়ে যেতো। দোকান থাকতো মালামালে হাউজফুল, আমার গোডাউন ছিল দুইটা। এখন দোকানও ছোট হয়ে গেছে, বেচাকেনাও কমেছে।

বঙ্গবাজারে মালামাল কিনতে লক্ষ্মীপুর থেকে এসেছেন মুরাদ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, আগে এখানকার দোকানগুলোতে সব আইটেম থাকত, এখন পাওয়া যায় না। নিউমার্কেট, কেরানীগঞ্জ বা ইসলামপুর যেতে হয়। মালের দাম মোটামুটি কম থাকলেও এখন বিভিন্ন জায়গায় ছুটে কিনতে হয়।

আরও পড়ুন

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তাই বেচাকেনাও কিছুটা মন্দা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আমরা নিজ উদ্যোগে কম অ্যাডভান্সে আশপাশের মার্কেটে দোকান ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। প্রণোদনার কিছু টাকাও আমাদের হাতে আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দোকানদারদের তালিকাও রয়েছে। সেই টাকাও শিগগির দেওয়া হবে। ঈদের পর সিটি করপোরেশন মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করবে। মার্কেট নির্মাণ সম্পন্ন হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বঙ্গবাজারের স্থানটিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান’। নতুন এ বিপণি বিতানে তিন হাজার ৪২টি দোকান থাকবে। আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ থাকবে নানা সুযোগ-সুবিধা। ঈদের পর ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

jagonews24

২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে বারবার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল সিটি করপোরেশন মালিকানাধীন বঙ্গবাজারে (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেট (একাংশ), মহানগর শপিং কমপ্লেক্স (একাংশ), বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে তিন হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০৩ কোটি টাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বঙ্গবাজারের স্থানটিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান’। নতুন এ বিপণি বিতানে তিন হাজার ৪২টি দোকান থাকবে। আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ থাকবে নানা সুযোগ-সুবিধা। ঈদের পর ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে

গত বছরের ৪ এপ্রিল আগুনে পুরোপুরি পুড়ে যায় বঙ্গবাজার। সে সময় ডিএসসিসির করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৫। পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে মোট দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এর মধ্যে বঙ্গ ইউনিটে ৮৬৩টি, গুলিস্তান ইউনিটে ৮২৮টি, মহানগর ইউনিটে ৫৯৯টি, আদর্শ ইউনিটে ৬৭১টি দোকান ছিল। এছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে দোকান ছিল ৩৪টি।

আরও পড়ুন

গত ১৩ মার্চ ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস জানান, ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটসহ অবকাঠামো উন্নয়নে এই ওয়ার্ডে (২০ নম্বর ওয়ার্ড) আমাদের ৬০০ কোটি টাকার বেশি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, আগামী ঈদুল ফিতর পর্যন্ত বঙ্গবাজারে সেভাবেই ব্যবসা পরিচালিত হবে। ঈদের পরই আমরা সেখানে নতুন মার্কেট নির্মাণকাজে হাত দেবো। আমাদের দরপত্র কার্যক্রম প্রায় শেষ। সেখানে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমরা আবারও তাদের সেখানে উঠিয়ে দিতে পারবো। আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী এ মার্কেটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে বেজমেন্ট ১০ তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হতে পারে। নির্মাণব্যয়ের পুরো অর্থ নেওয়া হবে দোকানমালিকদের কাছ থেকে।

আরএএস/এমকেআর